রাজনীতি আমরা চাই, কিন্তু সঙ্কীর্ণ দলীয় রাজনীতি নয়
সর্বদলীয় সভায় জনস্বার্থে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব এস ইউ সি আই (সি)–র
রাজ্য সরকারের ডাকে ২৪ জুন নবান্নে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)–এর রাজ্য সম্পাদক কমরেড চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য ও রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য কমরেড তরুণ মণ্ডল৷ আমফান ও করোনা পরিস্থিতিতে রাজ্য সরকারের ব্যর্থতা ও বিরোধীদের ভূমিকা নিয়ে মত বিনিময় ও বিতর্ক শুরু হলে উপস্থিত প্রায় সকলেই বলতে শুরু করেন– আমরা রাজনীতি চাই না৷ কমরেড ভট্টাচার্য তখন বলেন, এখানে আমরা যারা বৈঠকে বসেছি, তারা সকলেই রাজনৈতিক দলের সদস্য৷ আমরা যদি বলতে থাকি আমরা রাজনীতি চাই না তা সাধারণ মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হবে না৷ ফলে বলা উচিত, মানুষের এই বিপন্নতার সময়ে, বিপদের সময়ে আমরা কেউ সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতি করব না৷ এই বক্তব্য উপস্থিত সকলেই গ্রহণ করেন৷
সভায় দলের পক্ষ থেকে প্রস্তাবগুলি তুলে ধরেন কমরেড ভট্টাচার্য এবং লিখিত আকারে সেগুলি মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশে পেশ করা হয়৷ প্রস্তাবে বলা হয়,
যখন দেশে লকডাউন ক্রমশ শিথিল করা হচ্ছে তখন এ দেশে এবং বিশ্বেও করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা লাফিয়ে বাডছে৷ পশ্চিমবঙ্গও এর ব্যতিক্রম নয়৷ লকডাউন শিথিল হওয়ার ফলে সংক্রমণের আর বিপদ নেই এই ভুল ধারণা যাতে না হয়, তার জন্য সরকারি উদ্যোগে ধারাবাহিক প্রচার ও উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন৷ এ কথা সত্য যে, জনসাধারণের আতঙ্কিত হওয়ার প্রয়োজন যেমন নেই, তেমনি এই অবস্থায় যথাযথ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণও অত্যন্ত জরুরি৷ বর্তমান পরিস্থিতিতে একদিকে আমফান বিধ্বস্ত অবস্থা ও অন্যদিকে করোনা সংক্রমণ রোধ, সংক্রমিতদের আইসোলেশনে রাখা, যথাযথ চিকিৎসা, বেসরকারি চিকিৎসায় ব্যয়ভার যথাসম্ভব কমানো, নন–কোভিড রোগীদের চিকিৎসা সুনিশ্চিত করা এবং পরবর্তী পরিস্থিতিতে পরিযায়ী শ্রমিক সহ অন্যান্য অসংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মহীন মানুষ, গরিব চাষি, খেতমজুর ও নিম্নবিত্ত জনসাধারণের প্রয়োজনীয় ত্রাণ ও কর্মসংস্থান আশু প্রয়োজন হিসেবেই দেখা দিয়েছে৷ আমরা তার ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি করছি৷
প্রস্তাবে বলা হয়েছে, দলের পক্ষ থেকে ২৩ মার্চের সর্বদলীয় বৈঠক ছাড়াও একাধিকবার আমাদের পরামর্শ ও সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব মুখ্যমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়েছে৷ এখন আমরা কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে তিনটি বিষয়ে সর্বদলীয় প্রস্তাব গ্রহণের জন্য উত্থাপন করতে চাই৷
প্রথমত, কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে হঠাৎ লকডাউন ঘোষণা, নিজ রাজ্যে ফেরানোর অব্যবস্থা এবং ‘গরিব কল্যাণ রোজগার অভিযান প্রকল্প’ থেকে পশ্চিমবঙ্গকে বাদ রাখার প্রতিবাদে, দ্বিতীয়ত, করোনা সংক্রমণের বিপর্যয়ের মধ্যেই বিশ্ববাজারে দাম কমা সত্ত্বেও উপর্যুপরি পেট্রোল–ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে এবং তৃতীয়ত, পশ্চিমবাংলার আমফান বিপর্যয়কে জাতীয় বিপর্যয় ঘোষণা করা ও উপযুক্ত পরিমাণ আর্থিক সাহায্যের দাবিতে৷
বলা হয়, বর্তমানে লকডাউন শিথিলতার এই পর্বে, জীবন–জীবিকার প্রয়োজনে সাধারণ মানুষের যাতায়াত স্বভাবতই বৃদ্ধি পাচ্ছে৷ এর ফলে, সংক্রমিতের সংখ্যা ও মৃত্যুর হারও বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে৷ এমনিতেই মাস টেস্টিং না হওয়ার কারণে সংক্রমিতের সংখ্যা প্রকৃতপক্ষে বহুগুণ বেশি৷ সরকারি তথ্যে আপাতত সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা কম থাকলেও তাতে আত্মসন্তুষ্ট না হয়ে সরকারকে এই প্রশ্ণে অত্যন্ত সতর্ক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে৷
এই অবস্থায় আমাদের সুনির্দিষ্ট মতামত হল :
ক) চিকিৎসা সংক্রান্ত বিষয় :
১) প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন, মাস টেস্টিং, আইসোলেশন, কোভিড হাসপাতালে প্রোটোকল অনুযায়ী ভর্তি এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা বহুগুণ বাড়াতে হবে৷ প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেনটাইন সেন্টারে থাকা–খাওয়া–চিকিৎসা যথাযথ ব্যবস্থা করতে হবে৷ বেসরকারি চিকিৎসার খরচ কমানোর জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে৷
২) সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক, নার্স এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রয়োজনীয় পিপিই সরবরাহ, নিয়মমাফিক বিশ্রাম, কোয়ারান্টিন, প্রয়োজনে টেস্ট সহ তাদের যাতায়াত ও থাকা–খাওয়ার সুব্যবস্থা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে৷ পৌর স্বাস্থ্যকর্মী ও আশাকর্মীদের যথোপযুক্ত ভাতা বৃদ্ধি এবং স্বাস্থ্য–সুরক্ষাও সুনিশ্চিত করতে হবে৷
৩) করোনা সংক্রমণ এবং অসুস্থ রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি বিবেচনায় রেখে হাসপাতাল বেড, ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে৷
৪) নন কোভিড রোগী তথা ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, ডায়ালাইসিস, টিবি, হৃদরোগ সহ অন্যান্য রোগীদের চিকিৎসা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং অনেকে চিকিৎসার অভাবে মারা যাচ্ছেন৷ এই বিষয়ে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে কোভিড আক্রান্ত ছাড়া অন্যান্য রোগীদের পরিষেবা অব্যাহত রাখার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে৷ সর্বত্র ডেঙ্গু প্রতিরোধে নজরদারি ও উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে৷
খ) পরিবহণ সংক্রান্ত বিষয় : সরকারি ও বেসরকারি পরিবহণের বর্তমান যে অবস্থা তাতে কোনও ভাবেই স্বাস্থ্যবিধিসম্মত শারীরিক দূরত্ব রক্ষা হচ্ছে না৷ এক্ষেত্রে একদিকে পর্যাপ্ত পরিবহণের ব্যবস্থা রাখতে হবে, অন্যদিকে সরকারি ও বেসরকারি কর্মক্ষেত্রগুলিকে একাধিক শিফটে চালিয়ে যেতে হবে৷ সেই অনুযায়ী পরিবহণের সময়সূচি নির্ধারণ করতে হবে৷ কোনওভাবে ভাড়া বৃদ্ধি না করে প্রয়োজনে ভর্তুকি দিতে হবে৷
গ) শ্রমিক সমস্যা সংক্রান্ত বিষয় : বহু দুর্ভোগ সহ্য করে ফিরে আসা পশ্চিমবাংলার পরিযায়ী শ্রমিকরা কাজ না পেয়ে দারিদ্রের জ্বালা এবং হতাশায় ভুগছেন, কেউ কেউ আত্মহত্যাও করেছেন৷ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাঁরা আবার ভিন–রাজ্যে যাওয়ারও দিন গুনছেন৷ তাদের নাম অবিলম্বে নথিভুক্ত করে জব কার্ড বা পরিচয়পত্র দিয়ে বিভিন্ন প্রকল্পের কাজে নিয়োগ করতে হবে এবং দৈনিক ন্যূনতম ৫০০ টাকা মজুরি দিতে হবে৷ কর্মচ্যুত চা–বাগান, চটকল সহ অন্যান্য কারখানার শ্রমিকদের রেশনে খাদ্য, স্বাস্থ্যপরিষেবা ও কাজ না পাওয়া পর্যন্ত মাসিক ৩০০০ টাকা অনুদান দিতে হবে৷ অবিলম্বে চা বাগান ও চটকলগুলো খোলার দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে৷ চা বাগান সহ বেসরকারি কর্মক্ষেত্রে লকডাউনের সময়কার পূর্ণ বেতন অবিলম্বে শ্রমিকদের দেওয়ার জন্য সরকারকে কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে হবে৷ অন্যান্য অসংগঠিত ক্ষেত্রে শ্রমিকসহ স্বনিযুক্ত কাজে (অটো, রিকশা, টোটো, ভ্যান চালক, পরিচারিকা সহ শ্রমিক) যাঁরা কর্মহীন হয়েছেন তাদের সকলকেই এই প্রকল্পে যুক্ত করার এবং ২০০ দিনের কাজের দাবি করছি৷ কাজ দেওয়া না গেলে মাথাপিছু মাসিক ন্যূনতম ৩০০০ টাকা দেওয়ার দাবি করছি এবং তাদের প্রত্যেককে মাথাপিছু (রেশন কার্ড না থাকলেও) ১০ কিলো চাল বা আটা, ৫ কিলো আলু, ১ কিলো সর্ষের তেল এবং ১ কিলো ডাল বিনামূল্যে সরবরাহ করার দাবি জানাচ্ছি৷ এছাড়া যুবশ্রী প্রকল্প কার্যকর করতে হবে৷ সরকারি অফিসে এবং শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়াকে কোনও কারণেই বন্ধ রাখা চলবে না৷
ঘ) আমফান সংক্রান্ত বিষয় : আমফানে ক্ষতিগ্রস্তদের খাদ্য, পানীয় জল ও স্বাস্থ্য পরিষেবার বন্দোবস্ত অবিলম্বে করতে হবে৷ গৃহ–সংস্কার বা পুনঃনির্মাণ, আমফান বিধবস্ত এলাকায় বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, রাস্তা মেরামত, নদীবাঁধ উঁচু ও মজবুত করা, জল ও মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ করা সহ উপযুক্ত পদক্ষেপ দ্রুত কার্যকর করতে হবে৷ প্রসঙ্গত, আয়লার ক্ষত এখনও নিরাময় হয়নি এবং প্রকল্পগুলির পূর্ণ রূপায়ণ ঘটেনি৷
ঙ) দুর্নীতি সংক্রান্ত বিষয় : করোনা ও আমফান বিধবস্ত মানুষের ত্রাণের ক্ষেত্রে যাদের কোনও রকম কার্ড নেই তাদের সকলের জন্য ফুড–কুপন দলীয় কর্মীদের মধ্যেই রেখে দেওয়া, রেশনে নির্ধারিত পরিমাণের কম খাদ্যশস্য বিতরণ করা, কোথাও গৃহনির্মাণের তালিকায় যাদের পাওয়ার কথা তাদের নাম না থাকা, খাদ্যদ্রব্য ও ত্রিপল বিতরণে দুর্নীতি ও দলবাজির কথা ইতিমধ্যেই সংবাদমাধ্যমে এসেছে৷ অনুদান সহ নানা ধরনের সরকারি ত্রাণ নিয়ে দুর্নীতির কথা আপনিও স্বীকার করেছেন৷ আমাদের দেশের কাঠামোতে এসব নিয়ে দুর্নীতি শাসক দলের পক্ষ থেকে যে হয়ে থাকে, তাও আপনার অজানা নয়৷ কিছু সরকারি অফিসারও এতে যুক্ত হয়ে পডেছেন৷ সেই কারণেই আমরা আমাদের দলের পক্ষ থেকে বিগত সরকারগুলির কাছে এই ত্রাণ বিতরণের ক্ষেত্রে তৃণমূল স্তরে সর্বদলীয় কমিটি গঠন করে তাদের দ্বারা প্রস্তুত তালিকা ও পরামর্শ নিয়ে সরকারি প্রশাসনকে দিয়েই ত্রাণ বিতরণের প্রস্তাব বার বার করেছি৷ যদিও তা কার্যকর হয়নি৷ বর্তমানেও তৃণমূল স্তরে সেই সর্বদলীয় কমিটি গঠনের দাবি করছি৷
চ) চাষি সমস্যা প্রসঙ্গে : আমফান এবং অসময়ের ঝডবৃষ্টিতে ভুট্টা চাষ, পান সহ সবজির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে৷ ক্ষতিগ্রস্ত এই চাষিদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে এবং সবজিসহ সমস্ত ফসল পঞ্চায়েতভিত্তিক ক্রয়কেন্দ্রে উপযুক্ত মূল্যে সরকারকে ক্রয় করতে হবে৷ আগামী মরসুমে চাষের জন্য চাষিদের উপযুক্ত সাহায্য করতে হবে৷ প্রচেষ্টা প্রকল্প, কৃষাণ ক্রেডিট কার্ড সহ বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পে সাহায্য পাওয়ার প্রক্রিয়াকে সহজ করতে হবে এবং এই প্রকল্পগুলিতে ভূমিহীন চাষিদের স্বার্থ সুরক্ষিত করতে হবে৷
ছ) উচ্চমাধ্যমিকের অবশিষ্ট পরীক্ষা যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে করতে হবে৷ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শ্রেণির চূড়ান্ত বর্ষ/সেমেস্টারের পরীক্ষা/মূল্যায়ন অনলাইন বা প্রথাগত উপস্থিতিতে না করিয়ে হোম অ্যাসাইনমেন্ট পাঠিয়ে, ফোনে মৌখিক প্রশ্নোত্তরে ও পূর্ববর্তী পরীক্ষার ফলাফলের সমষ্টির ভিত্তিতে করতে হবে৷
জ) বিদ্যুৎ গ্রাহকদের রিডিং ছাড়া বিল পাঠানো বন্ধ রাখতে হবে৷ বর্তমানে বিল মকুব করতে হবে৷ বন্ধ বাজারগুলিতে এই সময়ে বিদ্যুৎ বিল মকুব করতে হবে৷
বৈঠকে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে সর্বদলীয় প্রস্তাবের খসড়াগুলি গৃহীত হয়৷ এই খসড়াকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেওয়ার জন্য যে কমিটি গঠিত হয় তাতে আমাদের দলের প্রতিনিধি রয়েছেন৷ যদিও ত্রাণ বিতরণের ক্ষেত্রে দুর্নীতি রোধে সর্বনিম্ন স্তরে সর্বদলীয় কমিটি করার যে প্রস্তাব আমরা দিয়েছি, তা সরকারের পক্ষ থেকে মেনে নেওয়া হয়নি৷ তবে বিষয়টি প্রশাসন দিয়ে দেখা হবে বলে জানানো হয়েছে৷