করোনার প্রতিষেধক হিসাবে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন ওষুধ না পাঠালে ‘ভারতকে তার ফল ভোগ করতে হবে’। এই নাকি ট্রাম্প সাহেবের সাহায্য চাইবার ভাষা! দেশপ্রেমিক ভারতীয় মাত্রেই এতে অপমানিত বোধ করেছেন। তাই এই হুমকির বিরুদ্ধে সারা দেশেই শোনা গেছে ধিক্কারের ধ্বনি। কিন্তু যারা দেশপ্রেমের ঠিকাদারি নিয়ে মানুষকে তাড়িয়ে বেড়ায় সেই বিজেপি এবং তার পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকার যেভাবে হুমকির দু’দিনের মধ্যে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন রপ্তানির উপর জারি থাকা নিষেধাজ্ঞা আংশিকভাবে তুলে নিয়ে মার্কিন মুলুকে তড়িঘড়ি ওষুধ পাঠিয়ে দিল, তা মানুষকে অবাক করে দিয়েছে। একটা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের উদ্দেশে এক রাষ্ট্রপ্রধানের এমন চূড়ান্ত অভব্য শব্দ প্রয়োগের কোনও প্রতিবাদই ভারত সরকার করল না। করোনায় আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যার দিক থেকে আমেরিকা একেবারে উপরের দিকে অবস্থান করছে। তুলনায় ভারতের স্থান এখনও অনেকটা পেছনে। ফলে একটি আক্রান্ত দেশ অপর একটি দেশের কাছে পরিস্থিতি মোকাবিলায় সাহায্য চাইতেই পারে। এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। কিন্তু সাহায্য চাওয়া এবং ‘সাহায্য না দিলে তার ফল ভোগ করতে হবে’ বলে চোখ রাঙানো যে এক জিনিস নয়, তা ব্যাখ্যা করে বলার অপেক্ষা রাখে না।
বস্তুত, সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার এটাই আসল চেহারা। কোনও আন্তর্জাতিক নিয়ম-রীতি, অপর দেশের সম্মান-মর্যাদা-অধিকার, কোনও কিছুরই তোয়াক্কা তারা করে না। শক্তির দম্ভ, হুমকি, রক্তচক্ষু প্রদর্শন, আগ্রাসন, আধিপত্য বিস্তারের পথেই তারা বারবার তাদের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ ও উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে চেয়েছে। বিশ্বে সমাজতান্ত্রিক শিবিরের অনুপস্থিতি এবং দেশে দেশে মার্কিন দাদাগিরি ও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে কোনও শক্তিশালী আন্দোলন না থাকার সুযোগে আজ সে অনেক বেশি বেপরোয়া। তার ঔদ্ধত্য এতটাই যে এমনকি বর্তমানের ভয়াবহ করোনা-পরিস্থিতিতেও ওষুধের জন্য অপর দেশকে চোখ রাঙাতে তার আটকায় না। আমেরিকার এই দাদাগিরি ও ঔদ্ধত্য দেশে দেশে শান্তি, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রকে চূড়ান্ত বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছে, যার বিরুদ্ধে প্রায় সর্বত্রই গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষ সোচ্চার হচ্ছেন।
কিন্তু একটা ওষুধের জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্টকে এভাবে হুমকি দিতে হল কেন? নরেন্দ্র মোদির সাথে তাঁর সখ্যতার অভাব ঘটার কথা তো শোনা যায়নি! আসলে করোনা মহামারি সারা বিশ্বের সামনে মহাশক্তিধর আমেরিকার মানুষের দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থাকে একেবারে বেআব্রু করে দিয়েছে। দেশের মানুষের স্বাস্থ্য, তাদের প্রকৃত সুরক্ষাকে জলাঞ্জলি দিয়ে কীভাবে মার্কিন শাসকরা মুষ্টিমেয় ধনকুবের গোষ্ঠীর বাজারের প্রয়োজনে যুদ্ধাস্ত্র, রণতরী, যুদ্ধবিমান আর সামরিক বাহিনীর তাকত বাড়ানোর উপরই জোর দিয়েছে, দেশের বেশিরভাগ সম্পদকে ঢেলেছে এই কাজেই– তা দেখেছে বিশ্বের মানুষ। আজ তাদের দেশের মানুষ যখন অসহায়ভাবে হাজারে হাজারে মরছে, তখন সামান্য একটা ওষুধের জন্য নির্ভর করতে হচ্ছে অন্য দেশের ওপর। মার্কিন তাকত সম্বন্ধেই বিশ্বের মানুষের মনে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। গোটা ইউরোপ এখন করোনা রোধে চীনা ওষুধ, ভেন্টিলেটর যন্ত্র, মাস্ক এমনকি চীন থেকে আসা ডাক্তারদের দিকে তাকিয়ে আছে। ফলে মার্কিন ধনকুবেররা বাজার হারানোর আশঙ্কায় ভুগছে। এর সাথে এই বিশ্বজোড়া চিকিৎসা সংকটে পুঁজিবাদের ব্যর্থতা প্রকট হয়ে উঠছে। ফলে সাম্রাজ্যবাদী দস্যুতার নখ দেখাতে না পারলেও অন্তত দাঁত দেখিয়ে সকলকে একটু হুমকি দিয়ে রাখার দরকার ট্রাম্পের ছিল। আর এক্ষেত্রে মোদিজির মতো কলসির কানার ঘা খেয়েও বশংবদ থাকা লোক বিশ্বে তিনি খুব বেশি পাননি। এর সাথে যুক্ত হয়েছে আগামী নভেম্বর নাগাদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বিষয়টি। ট্রাম্প সরকার যে দেশের মানুষকে রক্ষায় পুরোপুরি ব্যর্থ, ভোটারদের কাছে তা স্পষ্ট হয়ে গেছে। ফলে ডোনাল্ড ট্রাম্প সাহেবের প্রয়োজন, তিনি যে দেশের মানুষের জন্য কিছু করছেন তা একটু জোর দিয়ে দেখানো। তাই একটা গর্জন করে নিজের দুর্বলতা ঢাকার চেষ্টা করেছেন তিনি।
কিন্তু নরেন্দ্র মোদি কিল খেয়ে কিল হজম করলেন কেন? বেশ কিছুদিন ধরেই শোনা যাচ্ছে, ভারত-মার্কিন সম্পর্ক নাকি বর্তমানে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ এবং এর প্রধান রূপকার হলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এই ঘনিষ্ঠতা বোঝাতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সুযোগ পেলেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বুকে জড়িয়ে ধরেছেন। কয়েকশো কোটি টাকা খরচ করে গত বছর আমেরিকায় ‘হাউডি মোদি’ এবং এ বছর ভারতে ‘নমস্তে ট্রাম্প’-এর মতো অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন। এমনকি সমস্ত আন্তর্জাতিক রীতি-নীতি লঙ্ঘন করে, বুকের ছাতি ফুলিয়ে আমেরিকায় ‘আগলি বার ট্রাম্প সরকার’ স্লোগানও তুলেছেন নরেন্দ্র মোদি। প্রশ্ন হল, তাঁর সেই ‘বন্ধু’-ই আজ যখন ওষুধ চেয়ে চোখ রাঙাচ্ছেন, তখন মোদি নীরব কেন? কেন মুখ বুজে তিনি তা হজম করছেন? শুধু তো হজম করাই নয়, হুমকির সামনে একেবারে মাথা নিচু করে, প্রায় সঙ্গে সঙ্গে নিষেধাজ্ঞা পাল্টে ফেলে নতুন করে ঘোষণা করছেন– প্রতিবেশী দেশ এবং অন্যান্য আক্রান্ত দেশেও ওষুধ পাঠানো হবে! সমস্ত ঘটনাপ্রবাহ কি একটা স্বাধীন, গণতান্ত্রিক দেশের পক্ষে লজ্জা ও অপমানের নয়? মোদি সরকারের দেশি-বিদেশি পুঁজিপতিদের এই চাটুকারবৃত্তির জন্যই কি দেশবাসীকে এই অপমান সহ্য করতে হল না?
আরও লজ্জার বিষয়, শুধু হুমকির সামনেই ভারতকে এভাবে নতজানু হতে দেখে ‘বন্ধু’ ট্রাম্প ৮ এপ্রিল পুনরায় ‘মোদি মহান’ বলে তাঁর জয়গান গেয়েছেন। এখানেও যুক্ত আছে ভারতীয় একচেটিয়া ধনকুবের গোষ্ঠীর স্বার্থ। দেশপ্রেম বলে সাধারণ মানুষ যা বোঝেন, একচেটিয়া মালিকদের অভিধানে তার অর্থ অন্য। দেশের কোটি কোটি মানুষকে শোষণে ছিবড়ে করে দিয়ে তারা বাজার ধরতে যখন অন্য দেশে ঝাঁপায় তখন দেশের মানুষকে ছদ্ম-দেশভক্তিতে ভুলিয়ে রাখা হয়। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সাথে গাঁটছড়া বেঁধে অন্য দেশের বাজারকে শোষণ করতে গেলে মাঝে মাঝে একটু মার্কিন ধাতানি, অপমান, গালাগালি সহ্য করতে হয়, সে সব গায়ে মাখলে তাদের চলে না। করোনা সংকটকে কাজে লাগিয়ে মার্কিন সরকার এখন এই ভারতীয় ধনকুবেরদেরই হাত ধরতে চাইছে এশিয়ার বাজারে চীনের জায়গাটা দখল করতে। দু’পক্ষের স্বার্থেই নরেন্দ্র মোদিকে এশিয়ার ত্রাতা হিসাবে তুলে ধরতে চাইছে আমেরিকাও। একই সাথে আমেরিকাতে পর্যন্ত ওষুধ পাঠানোর নজির দেখিয়ে ভারতীয় বহুজাতিকদের এশিয়া জুড়ে ওষুধ ব্যবসার সুযোগ করে দিতে পারা যাবে। এই হিসাব কষেই ক’দিন আগে নিজেদের স্বীকার করা ওষুধের ঘাটতির কথা গিলে ফেলে রপ্তানির দরজা খুলে দিল সরকার। এই কারণেই রাষ্ট্রায়ত্ত বেঙ্গল কেমিক্যালকে অর্ডার না দিয়ে এই ওষুধ তৈরির বরাত দেওয়া হয়েছে গুজরাট ও মহারাষ্ট্রের দুটি প্রাইভেট কোম্পানিকে।
প্রশ্ন হল, ওষুধ কি সত্যিই দেশে মজুত? কেন্দ্রীয় সরকার কি আদৌ জানে, দেশে কত ওষুধ মজুত আছে? আইসিএমআর কিন্তু বলছে, দেশে কত হাইড্রি’ক্লোরোকুইন আছে, তার হিসাব তাদের জানা নেই। আরও উদ্বেগের বিষয় হল, এই ওষুধ তৈরি করতে যে কাঁচামাল লাগে, তার ৮০ শতাংশ আসে চীনের উহান থেকে। বর্তমান অবস্থায় সেখান থেকে এই কাঁচামাল আসার কোনও সম্ভাবনা নেই, তা বলা বাহুল্য। লকডাউনের মধ্যেও আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা যেভাবে লাফিয়ে বাড়ছে, তাতে আগামী দিনে সংখ্যাটা কোথায় গিয়ে পৌঁছবে– কেউ জানে না। সেই পরিস্থিতি মোকাবিলায় পর্যাপ্ত ওষুধ যদি দেশে না থাকে, তার পরিণাম কতটা ভয়াবহ হতে পারে, সে কথা ভাবলে কল্পনাতেও যে কেউ শিউরে উঠবেন।
ট্রাম্প মোদি দুজনে দুজনের পিঠ যত খুশি চাপড়ান, গলাগলি কিংবা গালাগালি করুন, বুঝতে হবে তাতে দেশের সাধারণ মানুষের প্রকৃত স্বার্থ জড়িত নেই।