গণতন্তে্রর নাম করে পুঁজির শোষণ-জুলুম যত বাড়ছে, রাশিয়ার জনগণ ততই মহান স্ট্যালিন এবং সমাজতন্তে্রর স্লোগান তুলছেন। ‘দি মস্কো টাইমস’ পত্রিকায় গত ১৬ এপ্রিল ২০১৯ তারিখে সমীক্ষা করে লেখা হয়েছে, রাশিয়ার প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ স্ট্যালিন-শাসন সময়কে সমর্থন করছেন।
শুধু দারিদ্র, বেকারত্ব, নারীনিগ্রহ, মানবপাচার, মাদকাসক্তি, যুদ্ধাবস্থা ইত্যাদির বাড়বাড়ন্তের জন্যই নয়– স্বাধীনতা, গণতান্ত্রিক অধিকার বজায় থাকার প্রশ্নেও বর্তমান পুঁজিবাদী রাশিয়ার একটা বড় অংশের মানুষ ফিরে পেতে চাইছেন পূর্বতন সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে। গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রিক ব্যবস্থার পতনে উল্লসিত হয়ে বিশ্বের বুর্জোয়া প্রচার মাধ্যম বারবার বলতে শুরু করেছিল, সোভিয়েত ভেঙে যাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ, মানুষের স্বাধীনতাকে স্টালিন মূল্য দেননি এবং পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিকে রাশিয়া জোর করে দখলে রেখেছিল।
অথচ, রাশিয়ায় সোভিয়েত ভেঙে যাওয়ার এবং পুঁজিবাদ পুনঃপ্রতিষ্ঠা হওয়ার কয়েক বছরের মধ্যেই দেখা গেল, রাশিয়ার যে সব মানুষজন খুশি হয়েছিলেন তাদের অনেকেই অন্তর থেকে অনুতাপ করছেন। সাম্প্রতিক সময়ে (ফেব্রুয়ারি ২০২০) যাদের বয়স ৩৫-৪০ থেকে শুরু করে ৬৫-৭০ এর কমবেশি তারা বলছেন, ‘এখনকার রাশিয়ায় স্বাধীনতার নামে চলছে লাগামছাড়া শোষণ। সরকারের বিরুদ্ধে কার্যকরী প্রতিবাদ করার কোনও অধিকার মানুষের নেই।’ অনেকেই বলছেন, ‘এখনকার চেয়ে সমাজতন্ত্রে আমরা অনেক ভাল ছিলাম।’ পূর্ব ইউরোপের দেশগুলির মানুষ বলছেন, ‘সোভিয়েত থেকে বেরিয়ে গিয়ে আমরা মহা ভুল করেছিলাম।’ এ-কথাগুলি এখন প্রায়শই সংবাদপত্রের শিরোনাম হচ্ছে।
পূর্ব জার্মানি, হাঙ্গেরি, চেক প্রজাতন্ত্র, যুগোস্লাভিয়া, রোমানিয়া, ইউক্রেন, লিথুয়ানিয়া, বুলগেরিয়া ইত্যাদি সহ রাশিয়ার মানুষের এহেন মানসিকতার ক্রমবৃদ্ধির জন্য বহু সামাজিক প্রতিষ্ঠান, সংস্থা, পত্র-পত্রিকা নানা সময়ে নানা স্তরে জনমত সমীক্ষা করে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। সেগুলিতে দেখা যাচ্ছে, শুধু মধ্যবয়স্ক বা প্রবীণ মানুষেরাই নন, এমনকি যারা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা, গবেষণা করছেন সেইসব ছাত্রছাত্রী, গবেষকদেরও একটা ভাল অংশ স্ট্যালিন এবং পূর্বতন সমাজতন্ত্রের পক্ষে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে কথা বলছেন। জনগণের মধ্যে এ-ধরনের মেজাজ দেখে বুর্জোয়া প্রচার মাধ্যম বলতে শুরু করেছে, ‘এ হল নস্টালজিয়া’। তারা বলছে, ‘আসলে মানুষের স্বভাবই হল অতীত সম্পর্কে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়া। প্রবীণরা সবসময়ই তাদের যৌবন ফিরে পেতে চায়।’
সত্যিই কি তাই? কেবলমাত্র অতীত আবেগের কারণেই কি বর্তমান রাশিয়ার প্রায় কয়েক কোটি মানুষ স্ট্যালিন এবং সমাজতন্ত্রের দিকে যেতে চাইছেন? অন্যান্য পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী দেশের মতোই বর্তমান রাশিয়ার শ্রমজীবী জনগণের দুরবস্থার কিছু কিছু কথা মাঝেমধ্যেই প্রকাশিত হয়ে পড়ে নানা মাধ্যমে। যেমন, (১) বেকারত্ব। কর্মহীন মানুষের সংখ্যা লাগাতার বাড়ছে রাশিয়ায়। তথ্য বলছে, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে বেকারত্ব বৃদ্ধির হার ছিল ৪.৬ শতাংশ। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে তা হয়েছে ৪.৭ শতাংশ। সরকারি হিসাবে এখন বেকারের সংখ্যা প্রায় ৩.৫ মিলিয়ন। আদতে সংখ্যাটি যে প্রায় দ্বিগুণ তা লেখাই বাহুল্য। সেখানকার সমাজতাত্ত্বিকরা বলছেন, কর্মহীনতার এই হারবৃদ্ধি সাম্প্রতিককালে সর্বোচ্চ। (ট্রেডিং ইকোনমিস্ক, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২০)
(২) দারিদ্র্য। দেশের কতিপয় ধনকুবের যখন ক্রমাগত আরও সম্পদের মালিক হচ্ছে, তখন গরিব মানুষের সংখ্যাও ক্রমাগত বাড়ছে। সূত্র অনুসারে, এখন রাশিয়ায় দারিদ্রসীমার নিচে বসবাসকারীর সংখ্যা সরকারি হিসাবে প্রায় ২ কোটি। ২০১৯ সালে প্রেসিডেন্ট পুতিন তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, এই সংখ্যাকে তিনি দ্রুত অর্ধেক করে দেবেন। অথচ দেখা যাচ্ছে দারিদ্র্য ক্রমশ বাড়ছে। (বিজনেস ইনসাইডার, ১৬ এপ্রিল ২০১৯)
(৩) অনাহার মৃত্যু। সরকারি স্বাস্থ্য ও খাদ্য সরবরাহ বিভাগের গাফিলতি এবং অব্যবস্থার কারণে রাশিয়ায় প্রতিদিন গড়ে ৭০০ জন মানুষের মৃত্যু ঘটে। (বিজনেস ইনসাইডার, ১৬ এপ্রিল ২০১৯)।
(৪) নেশাসক্তি ও পতিতাবৃত্তি। রাশিয়ায় বিশেষত হতাশাগ্রস্ত যুবকের সংখ্যা যত বাড়ছে, নেশাসক্তিও তত বাড়ছে। জীবনযাপনের সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত অসহায় নারীকে শাসকেরা বাধ্য করছে পতিতাবৃত্তিতে যেতে।
এগুলি তো আছেই। এর সাথে রয়েছে স্বচ্ছ পানীয় জলের অভাব। রাশিয়ার অর্ধেকের বেশি মানুষ স্বচ্ছ পানীয় জল থেকে বঞ্চিত। আর, পরিবেশ দূষণ তো মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। অথচ, সরকার নির্বিকার এবং উদাসীন। সাধারণ মানুষের জীবনের প্রতি তার কোনও দৃষ্টি নেই। বরং, এই চূড়ান্ত অব্যবস্থা ও বিরুদ্ধে পুঁজিবাদী শোষণ-জুলুমের বিরুদ্ধে যারা প্রতিবাদ করছে তাদের উপর নেমে আসছে বর্বর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। ২০১৬ সালে ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’ সংস্থা তথ্য-পরিসংখ্যান দিয়ে দেখিয়েছে, রাশিয়াতে মানবাধিকার ব্যাপারটির অবস্থা ক্রমাগত খারাপ হচ্ছে।
সোভিয়েত ইউনিয়নে কি জনজীবনের প্রতি রাষ্টে্রর এই দৃষ্টিভঙ্গি ছিল? ছিল না। সেখানে প্রত্যেক মানুষকে যথার্থ অর্থেই সমাজের মূল্যবান সম্পদ হিসাবে গণ্য করা হত। এই মূল দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই বিপ্লবের পর লেনিন এবং স্ট্যালিনের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া সমস্ত দিক থেকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ আসনে উন্নীত হয়েছিল। বিশেষত, লেনিনের পর স্ট্যালিনের কাঁধে যখন সমাজতন্ত্রকে রক্ষা এবং বিকশিত করার দায়িত্ব অর্পিত হল, তখন সেভিয়েতের সামনে ছিল বিরাট বিপদ। একদিকে, আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের ষড়যন্ত্র এবং নৃশংস আক্রমণ। অন্যদিকে, সেই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসাবে দেশের মধ্যে একের পর এক প্রতিবিপ্লবী অভ্যুত্থানের চেষ্টা। এমনকি, কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যেও ক্ষমতার লোভে নানা চক্রান্ত। এই সমস্ত কিছুকে প্রতিরোধ করে সর্বাত্মক শিল্পায়ন এবং যৌথ মালিকানাধীন উন্নত কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তোলার কঠিন সংগ্রাম করেছিলেন স্ট্যালিন। কাজটা কঠিন এই কারণে যে, এই কাজের পিছনে মূল দৃষ্টিভঙ্গি ছিল আমলাতান্ত্রিক কায়দায় শ্রমিক শোষণ করে মুনাফা অর্জন নয়। বরং ব্যাপক জনগণকে যুক্ত করে, তাদের সংস্কৃতি, আবেগ, মনন জগতকে পরিবর্তন করে নতুন মানুষ হিসাবে গড়ে তোলার মাধ্যমে এক সুবিশাল সম্পদভাণ্ডার গড়ে তোলা। ১৯২৯ সালে আইন করে ‘রাষ্ট্র ছাড়া আর কেউ ব্যক্তিগত প্রয়োজনে কর্মী নিয়োগ করতে পারবে না’ এই মর্মে আইন পাশ হয়। সমাজতান্ত্রিক কৃষি উৎপাদনের প্রয়োজনে ক্ষুদ্র চাষিদের ছোট ছোট জোতকে যুক্ত করে এবং মেশিন-ট্রাক্টর ব্যবহার করে গড়ে উঠেছিল যৌথ খামার, বৃহৎ রাষ্ট্রীয় খামার। কৃষি পণ্যের ক্ষেত্রে খোলা বাজার ব্যবস্থা বন্ধ করে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় বাণিজ্য চালু করা হয়। এর ফলে দ্রুত কৃষির উন্নতি ঘটে এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন দেশের জনগণের সামগ্রিক প্রয়োজনের থেকেও অনেক বেশি খাদ্যশস্য উৎপাদন করে খাদ্যশস্যের দাম কমিয়ে এনে প্রায় বিন্যমূল্যে তা জনতাকে দেওয়ার জায়গায় চলে আসে। সোভিয়েত রাশিয়াই বিশ্বে প্রথম যারা দেশ থেকে ক্ষুধা, অনাহার, খাদ্যে ভেজাল এসব বহুকালের সমস্যা সম্পূর্ণ দূর করে দিয়েছিল। ব্যাপক উৎপাদন কর্মের ব্যবস্থা করে তারাই প্রথম বেকারহীন রাষ্ট্রের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। পতিতাবৃত্তি নিশ্চিহ্ন করে ফেলেছিল তারাই। স্থাপন করেছিল নারীর যথার্থ মর্যাদার আসন। আবার, শুধু জীবনযাপনের নিরাপত্তাই নয়– শিল্পকলা, সাহিত্য, বিজ্ঞান, খেলাধুলা ইত্যাদি সমস্ত ক্ষেত্রে তারা বিশ্বে প্রথম স্থানে চলে গিয়েছিল।
এই অভূতপূর্ব অগ্রগতির কারণেই কমিউনিস্ট না হয়েও আমাদের দেশের রবীন্দ্রনাথ, নেতাজি সহ বিশ্বের অগণিত মানবতাবাদী বিদ্বজ্জন মহান স্ট্যালিন এবং সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছিলেন। সারা বিশ্ব সহ আমেরিকা, ইউরোপের বহু লেখক, সাংবাদিক স্ট্যালিনের রাশিয়ায় গিয়েছেন, ঘুরেছেন, থেকেছেন। তাঁরা তাঁদের মতন করে কথা বলেছেন নানা স্তরের মানুষের সাথে। সেসব নিয়ে লিখেছেন, বই প্রকাশ করেছেন। যেগুলিতে সোভিয়েত সমাজ এবং স্ট্যালিন সম্পর্কে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে তাঁদের বক্তব্য প্রকাশ করেছেন। সেগুলি আজ যারা পড়ছে, তারা বুঝতে পারছে সোভিয়েতের মহত্ত। এক সাংবাদিক এক চাষিকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনার যে ৩ বিঘা জমি ছিল, তা তো বলশেভিকরা জোর করে নিয়ে নিয়েছে। আপনার এখন কী অবস্থা?’ চাষিটি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘ওঁরা কেড়ে নেননি। আমি তো প্রথমে যৌথ খামারে জমি দিইনি। পরে দেখলাম ওখানে দারুণ কাজ হচ্ছে। তখন ভাবলাম, আমার জমি ওখানে দিলে মন্দ হয় না। তাই দিয়ে দিলাম।’ সাংবাদিক বললেন, ‘তার পর?’ চাষিটি হাসিমুখে বললেন, ‘তার পর আর কী! দিলাম ৩ বিঘা, বিনিময়ে পেলাম গোটা রাশিয়া।’ এই ছিল সমাজতন্ত্রেরর ভিত্তি। এই ভিত্তির উপর দাঁড়িয়েই লালফৌজের পাশাপাশি গোটা দেশ লড়েছিল নৃশংস হিটলারের বিরুদ্ধে। সারা বিশ্বকে ফ্যাসিস্ট শক্তির হাত থেকে রক্ষা করেছিল তারা।
প্রশ্ন উঠতে পারে স্বাধীনতার। অন্যান্য পুঁজিবাদী দেশের মতোই বর্তমান পুঁজিবাদী রাশিয়ার জনগণও এখন বেশ বুঝতে পারছে, পুঁজিবাদী সমাজে পুঁজি ছাড়া আর কোনও কিছুর স্বাধীনতা নেই। অথচ এই কথাটা মহান মার্কস বলে গেছেন কত বছর আগে। রাশিয়ার শ্রমজীবী জনগণ নির্মম শোষণ-জুলুমের সামনে পড়ে স্বাধীনতার কথা প্রায় ভুলতে বসেছেন। মানবাধিকার বলে কোনও কিছু প্রায় নেই-ই। আর, কমিউনিস্ট না হয়েও বিশ্বখ্যাত নাট্যকার জর্জ বার্নাড শ’ বলেছিলেন, ‘যদি স্বাধীনতা পেতে চাও, তবে সোভিয়ে রাশিয়ায় যাও। ওখানে স্ট্যালিন এখনও বেঁচে আছেন।’ তাই বর্তমান রাশিয়ার শোষণ-জর্জরিত মানুষ, প্রবীণ হোক বা শিক্ষিত নবীন, সভা-সমিতিতে সমাজতন্ত্রেরর কথা তুলছেন। মহান স্ট্যালিনের ছবি বুকে ধরে পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী মিছিলে হাঁটছেন। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলির মানুষও একই স্লোগান তুলছেন। একে কি নস্টালজিয়া বলে চাপা দেওয়া যাবে? যাবে না। ইতিহাসের শিক্ষা, প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি কিছু কালের জন্য মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পারে, কিন্তু মানুষ শেষপর্যন্ত প্রগতির পথেই হাঁটবে। সেই শিক্ষার ভিত্তিতে ভারতবর্ষেও এসইউসিআই (সি) দলের পক্ষ থেকে মহান স্ট্যালিনের জীবনসংগ্রামের সৃজনশীল চর্চা অব্যহত রয়েছে।