পুলওয়ামায় ৪০ জন জওয়ানের মর্মান্তিক মৃত্যুর এক বছর পার হয়ে গেল। বর্ষপূর্তিতে বিজেপি স্থানে স্থানে ‘শহিদ’ দিবস পালন করল। কিন্তু আজও তার তদন্ত করল না কেন্দ্রের বিজেপি সরকার।
২০১৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি কাশ্মীরের পুলওয়ামায় ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণে উড়ে গিয়েছিল বিরাট সেনা কনভয়। কফিনবন্দি সারি সারি জওয়ানের দেহের সামনে কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং সহ সেনাবাহিনীর কর্তারা কত দুঃখপ্রকাশ করেছিলেন। আর একটি ছবিও দেখা গিয়েছিল সেদিন। মৃতদেহ আঁকড়ে আছাড় খাচ্ছেন কোনও জওয়ানের মা, কারও স্ত্রী, কারও শিশু সন্তান। স্বজন হারানো মানুষগুলির এই শোকের কি মূল্য দিল বিজেপি সরকার?
এতজন জওয়ানের মৃত্যু কি অনিবার্য ছিল? সেই প্রশ্ন আবারও ফিরে ফিরে আসছে। আজও তদন্ত হল না কেন পুলওয়ামা বিস্ফোরণের? কে বা কারা জড়িত তার কোনও হদিস পেল না কেন মৃতদের পরিজনরা কিংবা দেশের মানুষ? আজ পর্যন্ত কোনও চার্জশিট দিতে পারল না কেন জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা? সীমান্তে কড়া সেনা পাহারার নজর এড়িয়ে কীভাবে ৮০ কেজি বিস্ফোরক ঢুকতে পারল? এর জবাব তো কেন্দ্রীয় সরকারকে দেশবাসীর সামনে দিতে হবে।
এই ঘটনার পর পাকিস্তানের দিকে ছদ্ম-গোলা নিক্ষেপ করে মানুষের দেশাত্মবোধের সেন্টিমেন্টে সুড়সুড়ি দিয়ে জাতীয়তাবাদের জোয়ারে দেশের মানুষকে মাতিয়ে দিয়ে দিব্যি মসনদে বসেছিল বিজেপি। বিস্ফোরণের ১২ দিনের মাথায় পাকিস্তানের বালাকোটে বিমান হানা চালিয়ে সরকার দাবি করেছিল, সন্ত্রাসবাদী জইশের ঘাঁটি গুঁড়িয়ে ফেলা হয়েছে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই আন্তর্জাতিক মিডিয়ার দৌলতে এই দাবির সত্যতা প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়েছে। যদিও এতে ভোট-বৈতরণী পেরোতে অসুবিধা হয়নি বিজেপির। প্রধানমন্ত্রী এবং বিজেপি নেতারা মানুষের ভাবাবেগকে পুঁজি করতে সরাসরি পুলওয়ামায় নিহত জওয়ানদের নাম করে ভোট চেয়েছিলেন।
বেকারি-মূল্যবৃদ্ধিতে জর্জরিত মানুষ সাময়িকভাবে সরকার বিরোধী ক্ষোভ ভুলে দেশপ্রেমের জোয়ারে ভেসে ২০১৯ সালে পুনরায় বিজেপিকে ক্ষমতায় নিয়ে এসেছে। ৩০৩টি আসন নিয়ে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে বিজেপি। এই সংখ্যাগরিষ্ঠতার পিছনে কি ওই ৪০ জন জওয়ানের বলিদানের ভূমিকা ছিল না? ভারত সরকারের সর্বোচ্চ কমান্ডো বাহিনী এনএসজি এবং ‘র’-এর কর্তারা পর্যন্ত এ প্রশ্ন তুলেছেন (আজকাল-১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২০)।
কাশ্মীর পুলিশ, সিআরপিএফ, আইবি কিংবা ‘র’ দ্রুত ৪০ জন জওয়ানের হত্যার তদন্ত করতে পারল না কেন? এই ঘটনার যথাযথ তদন্ত করে সত্যিকারের অপরাধী সাব্যস্ত করে তাদের শাস্তি দেওয়া হচ্ছে না কেন? নাকি পুলওয়ামার ঘটনার সত্যতা বেরিয়ে এলে সরকারের অস্বস্তি বাড়বে? সেই কারণেই কি তদন্তে তাদের অনীহা?
পুলওয়ামা বিস্ফোরণের ঠিক ৬ দিন আগে জম্মু-কাশ্মীর পুলিশের এক সিনিয়র অফিসারের স্বাক্ষর করা একটি সরকারি নির্দেশনামা সিআরপিএফ, জম্মু-কাশ্মীর পুলিশ, আইবি এবং সামরিক বাহিনী-পুলিশ যৌথ কমান্ডোর সর্বোচ্চ অধিকারীদের কাছে পৌঁছেছিল। তৎকালীন জম্মু-কাশ্মীরের রাজ্যপাল টিভি চ্যানেলের সামনে ঘটনার দিনই স্বীকার করেছিলেন এই নির্দেশনামার কথা। যেখানে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছিল, খুব শীঘ্রই সামরিক বা আধাসামরিক বাহিনীর ওপর অত্যন্ত বড় মাপের আইইডি হামলা হতে চলেছে। তার পরেও সিআরপিএফ এত বড় কনভয় নিয়ে গেল কী করে? বাধ্যতামূলক আকাশপথে নজরদারি ছাড়াই প্রায় ৭৮টি গাড়ি এবং ২৫০০-এর বেশি জওয়ান নিয়ে এতটা রাস্তা পাড়ি দিলই বা কেন? এত বড় বাহিনীকে আকাশপথে নিয়ে যাওয়ার সিআরপিএফ-এর আবেদন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক কেন না-মঞ্জুর করল?
নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা পর্যন্ত প্রশ্ন তুলেছেন, গোয়েন্দা দপ্তরের এত বড় ব্যর্থতা হল কী করে? এ কি ব্যর্থতা, নাকি পূর্বপরিকল্পনা প্রসূত? কাশ্মীর উপত্যকায় যেখানে প্রতিটি জেলা বা শহর শুধু নয়, প্রতিটি গ্রামেও আইবি, কাশ্মীর পুলিশের হাজার হাজার চর ছড়ানো রয়েছে। প্রতিটি গাড়ির গ্যারাজ, প্রতিটি মোবাইলের দোকান এই ‘চরদের’ নজর এড়িয়ে কিছু করতে পারে না। এমনকি প্রতিটি মুদির দোকানের ওপরেও শ্যেনদৃষ্টি থাকে গোয়েন্দাদের। কোনও বাড়িতে স্বাভাবিকের থেকে যদি দশ কিলো চালও বেশি যায়, সেই খবর পৌঁছে যায় গোয়েন্দাদের কাছে। কোনও বাড়িতে কোনও অতিথি এলে সেই খবর সঠিক সময়ে ‘সঠিক’ জায়গায় পৌঁছে যায়।
এই পরিস্থিতিতে কী করে পাচার হল তিনশো কেজি বিস্ফোরণ? গোয়েন্দা দপ্তর কি ঘুমিয়েছিল? নাকি তাদের ঘুমোতে বলা হয়েছিল? ৪০ জন জওয়ানের মৃত্যু প্রধানমন্ত্রীর কাছে এসব প্রশ্নের উত্তর চায়।