রেললাইন, স্টেশন, বিভিন্ন সরকারি দপ্তর সহ শহরের নোংরা-আবর্জনা, বর্জ্য ইত্যাদি পরিষ্কার করেন যাঁরা তাঁদের পরিচিতি ধাঙড়, মেথর, ঝাড়ুদার, জমাদার ইত্যাদি নামে। বলতে গেলে, নগরজীবনকে দুর্গন্ধের, দূষণের কবল থেকে মুক্ত রাখেন তাঁরা। যাঁরা একদিন কাজ না করলে নগরজীবন বসবাসের অযোগ্য হয়ে যায়, সেই মানুষরা তীব্র সরকারি বঞ্চনার শিকার। না আছে তাঁদের বাঁচার মতো মজুরি, না আছে শ্রমিক হিসাবে স্বীকৃতি। এমনকী সাফাই করার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামগুলিও ঠিকমতো সরবরাহ করা হয় না। বছরের পর বছর ধরে তাঁরা কর্মরত থাকলেও তাঁদের স্থায়ীকরণের বিষয়টি সম্পূর্ণ অবহেলিত।
যাঁরা এ পেশায় যুক্ত তাঁরা প্রায় সকলেই তথাকথিত নিম্নবর্ণ দলিত সম্প্রদায়ভুক্ত। তাদের এই বঞ্চানার মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই পুঁজিবাদী বঞ্চনার সাথে জাতিবাদী বঞ্চনা মিশে রয়েছে। ফলে এঁদের সমস্যা সমাধানের বিষয়ে সরকারি বা প্রশাসনিক উদ্যোগ চোখে পড়ে না। দিনের পর দিন নোংরা আবর্জনা পরিষ্কার করে এঁদের অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। অনেকেই নর্দমার বিষাক্ত গ্যাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। সাফাই করতে গিয়ে সরকারি হিসাবেই– ২০১৫ সালে ৫৭ জন কর্মী, ‘১৬ সালে ৪৮ জন, ‘১৭ সালে ৯৩ জন, ‘১৮ সালে ৬৮ জন, ‘১৯ সালে ১১০ জন কর্মী মারা গেছেন। স্বাস্থ্য সুরক্ষার আধুনিক পদ্ধতি মেনে যন্তে্রর সাহায্যে এ কাজ করা হলে এভাবে এতগুলি মানুষের প্রাণ যেত না।
খালি হাতে সাফাই নিষিদ্ধ করে ১৯৯৩ সালে পার্লামেন্টে আইন পাশ হয়েছিল। বলা হয়েছিল, এ কাজ আধুনিক পদ্ধতিতে যন্ত্রের সাহায্যে করাতে হবে। কিন্তু সেই আইনে বলা হয়নি, আইনভঙ্গ করলে কী শাস্তি হবে? এই না বলা কি ভুল করে, না কি সচেতনভাবে? স্বাভাবিকভাবেই আইনের কোনও প্রয়োগ হয়নি। ২০১৩ সালে এই আইনের সামান্য অদল-বদল করে ‘প্রোহিবিশন অব এমপ্লয়মেন্ট অ্যাজ ম্যানুয়াল স্ক্যাভেনজার্স অ্যান্ড দেয়ার রিহ্যাবিলিটেশন অ্যাক্ট’ প্রণয়ন করা হয়। বলা হয়, যাঁরা খালি হাতে সাফাইয়ের কাজে শ্রমিক নিয়োগ করবে তাদের হয় এক বছর জেল বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় শাস্তিই হবে। কিন্তু আইন পর্যন্তই সার। কোনও সরকারই তা প্রয়োগ করল না।
এই আইন প্রণয়নের পর গত চার বছরে অবৈধভাবে কাজ করানোয় ৩৭৬ জন কর্মী মারা গেলেও কোনও নিয়োগকারীরই সাজা হয়নি। এই সময়ে কেন্দে্র ক্ষমতায় রয়েছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি সরকার। বিভিন্ন রাজ্যেও তারা ক্ষমতায়। কিন্তু তাদের পরিচালিত কোনও সরকারই সুইপারদের এই সমস্যা সমাধানে কোনও উদ্যোগ নেয়নি।
কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন গত বছরের বাজেট বত্তৃতায় বলেছিলেন, ‘সুইপারদের কাজের নানা সরঞ্জাম সরবরাহ করা হবে। এজন্য বরাদ্দ করেছিলেন ১১০ কোটি টাকা। কিন্তু কোনও যন্ত্রই সরবরাহ করা হয়নি। সদ্য পেশ করা বাজেটেও তিনি একই প্রতিশ্রুতি দিয়ে একই পরিমাণ টাকা বরাদ্দ করেছেন যন্ত্রীকরণের জন্য। এবারের প্রতিশ্রুতিও কি হবে একইরকম অন্তসারশূন্য?
বিজেপি শাসনে দলিতদের উপর অত্যাচার নানাভাবে বেড়েছে বহুগুণ। খুন, ধর্ষণ, সম্পত্তি লুঠ, অগ্নি সংযোগ সবই বেড়ে চলেছে। সুতরাং আইনি সুরক্ষা দিতে হলে, জাতপাতের রাজনীতি থেকে সরকার ও প্রশাসনকে মুক্ত করতে হবে। এরই সঙ্গে চাই সাফাই কর্মীদের নিজস্ব দাবি-দাওয়া ভিত্তিক আন্দোলন। বরাদ্দ ১১০ কোটি টাকা দিয়ে আধুনিক সাফাই সরঞ্জাম সরবরাহের দাবিতে কর্মীদের আন্দোলনই পারে স্থবির এ সরকারকে কিছু কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করাতে।