কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে রাজ্যের বিজেপি সভাপতি সবার মুখে অনুপ্রবেশের কথা খুব শোনা যাচ্ছে। তাঁদের কেউ বলছেন এ রাজ্যে অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যাটা এক কোটি, কেউ বলছেন, ২ কোটি।
বিজেপি নেতারা মানুষকে বোঝাচ্ছেন, যেভাবে অনুপ্রবেশ হচ্ছে তাতে দেশটা অনুপ্রবেশকারীতেই ভরে যাবে। আর মানুষের এই যে দুরবস্থা, এই যে মূল্যবৃদ্ধি, এত যে বেকারি, এই সব কিছুর জন্য দায়ী এই অনুপ্রবেশকারীরা। তারাই মানুষের রুজি-রোজগার সব লুঠ করে নিচ্ছে। তাই অনুপ্রবেশকারীদের খুঁজে বের করে বিজেপি নেতারা তাদের তাড়িয়েই ছাড়বেন এবং দেশের মানুষের রুটি-রুজির গ্যারান্টি ফিরিয়ে আনবেন।
কিন্তু তাঁরা যে বলছেন, দু’কোটি কিংবা কোটি কোটি অনুপ্রবেশকারী ভারতে ঢুকে পড়েছে, এই সংখ্যাটা তাঁরা পেলেন কোথায়? তাঁরা কি সরকারি রেকর্ড থেকে এই সংখ্যা দিচ্ছেন, নাকি নিজেরা কোনও সমীক্ষা করেছেন, নাকি তাঁদের যার যা মনে আসছে তাই বলছেন। যদি সরকারি সমীক্ষা থেকে তাঁরা এই সংখ্যার উল্লেখ করেন তবে কোন সে সমীক্ষা, যার থেকে তাঁরা উদ্ধৃতি দিচ্ছেন?
ভদ্রলোকের এক কথা
তাঁদের বক্তব্য সম্পর্কে এই প্রশ্নের কারণ আজ থেকে প্রায় দু’দশক আগে (২০০২) বিজেপির প্রথম সারির নেতা লালকৃষ্ণ আদবানি যখন কেন্দ্রীয় সরকারের উপপ্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তিনি পশ্চিমবাংলায় এসে যথারীতি অনুপ্রবেশ নিয়ে একই রকম উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছিলেন, এ রাজ্যে ২ কোটি অনুপ্রবেশকারী রয়েছে এবং সরকার তাদের খুঁজে বের করবে। তাঁরা আরও বলছেন, প্রতিদিন দলে দলে বাংলাদেশি সীমান্ত পার হয়ে এ রাজ্যে ঢুকে যাচ্ছে। এটা সত্যি হলে অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা একই রয়ে গেল কী করে? তবে কি তাঁদের এ অভিযোগ সত্যি নয়? তা হলে এই যে বিজেপি নেতারা মানুষের জীবনের গুরুতর সমস্যাগুলি, মূল্যবৃদ্ধি, বেকারি, চিকিৎসার সংকট, নারী নির্যাতন, সেগুলিকে বাদ দিয়ে শুধু অনুপ্রবেশ নিয়েই হইচই করছেন, এর কারণটা কী?
নিছকই প্রচার
২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনের আগেকার কথা অনেকেরই মনে আছে। কংগ্রেসের দ্বিতীয় ইউপিএ সরকার দুর্নীতিতে গলা পর্যন্ত ডুবে গেছে। মূল্যবৃদ্ধি থেকে বেকারি– কংগ্রেসের অপশাসনে জর্জরিত সাধারণ মানুষ কেন্দ্রীয় সরকারের পরিবর্তন চাইছে। কিন্তু মানুষ তো শুধু সরকারের পরিবর্তন চাইছে না, পরিবর্তন চাইছে আসলে সরকারের জনবিরোধী নীতির। তারা চাইছে এমন একটা নীতি, যা তাদের জীবনে কল্যাণ নিয়ে আসবে। কিন্তু কোন দল সেই নীতি নিয়ে আসবে? বেশির ভাগ জনগণের তা জানা নেই। তারা নীতির পরিবর্তন চায়, কিন্তু কোন পথে তা আসবে তা তাদের জানা নেই। সক্রিয় হয়ে উঠল দেশের পুঁজিপতি শ্রেণি। মানুষের এই পরিবর্তনের আকাঙ্খাটাকে তারা ভয় পায়। কে জানে, বলা তো যায় না, এই আকাঙ্খা না পুঁজির আসন ধরে টান দেয়! ঝাঁপিয়ে পড়ল তাদের পরিচালিত সংবাদমাধ্যমগুলি। কংগ্রেসের মতোই তাদের অপর একটি অনুগত দল বিজেপিকে সামনে নিয়ে এল। কিন্তু সামনে নিয়ে এলে তো হবে না, মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলা চাই তো। এমন করে তুলে ধরতে হবে যেন মানুষ মনে করে, হ্যাঁ, এরাই তাদের মঙ্গল করবে, এদের নীতি কংগ্রেসের থেকে আলাদা। তাই বিজেপি নেতাদের মুখ দিয়ে প্রতিশ্রুতির বন্যা বইয়ে দেওয়া হল। মূল্যবৃদ্ধি রোধ, কর্মসংস্থানের স্বপ্ন দেখানো হল, ‘আচ্ছে দিনের’ গল্প শোনানো হল। বিজেপি নেতা নরেন্দ্র মোদিকে ‘বিকাশ পুরুষ’ হিসাবে তুলে ধরা হল। এ-সব প্রচারের জন্য টাকা ঢেলে দিল বড় বড় ব্যবসায়ী ও পুঁজিপতিরা। হই হই করে জিতে সরকার গড়ল বিজেপি।
কিন্তু এক মাঘে তো শীত যায় না। ২০১৯-এ আবার এল নির্বাচন। ততদিনে মানুষ বুঝে গেছে, গতবারের প্রতিশ্রুতি সবই ছিল ভাঁওতা, অমিত শাহের ভাষায়– জুমলা। তাই এবারের নির্বাচনের আগে পুলওয়ামা ঘটাতে হল, বালাকোটের গল্প ফাঁদতে হল। উগ্র জাতীয়তাবাদের জিগির তুলতে হল। আবার এল জয়। কিন্তু বিজেপি নেতারাও জানেন নকল দেশভক্তির এই ফানুস ফাটবেই। কারণ এ দিয়ে ক্ষুধার্ত মানুষের পেট ভরবে না। তাই এবার চাই নতুন স্লোগান, নতুন ইস্যু। এমন ইস্যু তুলতে হবে যাতে সরকার হিসাবে তাদের এতদিনের ব্যর্থতাকে চাপা দেওয়া যায়। বেকারি, মূল্যবৃদ্ধি, ছাঁটাই, মন্দা সবকিছুকে চাপা দিয়ে দেওয়া যায়। শোষণমূলক পুঁজিবাদী ব্যবস্থার পরিবর্তে দায়ী করা যায় অন্য কিছুকে, অন্য কাউকে। বিজেপি নেতারা সামনে নিয়ে এলেন ‘অনুপ্রবেশ’ ইস্যুটিকে।
অনুপ্রবেশ যদি হয় তবে তা ঘটছে কী করে
বিজেপি নেতারা কাদের অনুপ্রবেশকারী বলছেন? যাঁরাই বাংলাদেশ কিংবা পাকিস্তান থেকে এ দেশে এসেছেন তাঁরা কি এমন সবাইকেই অনুপ্রবেশকারী বলছেন? না। প্রথমে দেশভাগ এবং তারপর বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময়ে এই দুই দেশ থেকে যাঁরা এ দেশে এসেছেন, বিজেপি নেতারা তাঁদের ধর্মের ভিত্তিতে দু’ভাগে ভাগ করছেন। যে সব হিন্দুরা এই সব দেশ থেকে এসেছেন তাঁদের তাঁরা বলছেন শরণার্থী। আর যে মুসলমানরা এসেছেন তাঁদের বলছেন অনুপ্রবেশকারী। বাস্তবে দেশভাগের সময়ে এসেছে কারা? মূলত হিন্দুরা। আর বহু মুসলিম দেশভাগের আগে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং পরে বাংলাদেশে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে এ দেশ থেকে বাংলাদেশে চলে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময়েও এসেছে মূলত হিন্দুরাই। তা হলে কোটি কোটি অনুপ্রবেশকারী কখন ঢুকল?
দ্বিতীয়ত, অনুপ্রবেশ নিয়ে যদি বিজেপি নেতারা সত্যিই উদ্বিগ্ন হতেন তবে তাদের ধর্মের ভিত্তিতে এভাবে ভাগ করতেন না। আসলে অনুপ্রবেশ নয়, বিজেপি নেতারা চিন্তিত অনুপ্রবেশকে ইস্যু করে হিন্দু ভোটব্যাঙ্ক তৈরি নিয়ে। বাস্তবে অনুপ্রবেশ ইস্যুটি হল বছরে ২ কোটি চাকরি কিংবা সবার অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা ভরে দেওয়ার মতোই আর একটি গাঁজাখুরি গপ্পো। না হলে উত্তরপ্রদেশে মাত্র ৩৬৮টি পিওন পদের জন্য যে ২৩ লক্ষ বেকার আবেদন করেছিল, তার জন্য কি অনুপ্রবেশ দায়ী? নাকি দেশের ৭০ শতাংশ সম্পদ যে এক শতাংশ ধনকুবেবের হাতে জমা হয়েছে তার জন্য অনুপ্রবেশ দায়ী? কিংবা প্রতিদিন যে শত শত কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তার জন্য অনুপ্রবেশ দায়ী? এ সব প্রশ্নের উত্তর বিজেপি নেতারা দেবেন না। কারণ তা হলে তাঁদের প্রতারণার রাজনীতির মুখোশটা খুলে যাবে।
সরকারি হিসেব কী বলছে
বিজেপি নেতারা মুসলিম অনুপ্রবেশের ফলে মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির যে জুজু দেশের মানুষকে দেখাচ্ছেন, তা প্রমাণ করার মতো তাঁদের কাছে কোনও তথ্যই যে নেই, তা অত্যন্ত স্পষ্ট। অথচ প্রতি দশ বছর অন্তর জনগণনার রিপোর্ট সরকারের হাতে রয়েছে। সেই রিপোর্ট বিচার করলেই সত্যটা একেবারে জলের মতো পরিষ্কার হয়ে যাবে। অনুপ্রবেশের পরিমাণ যদি খুব বেশি হয় তবে জনগণনায় তা ধরা পড়বে। যে রাজ্যে এমন অনুপ্রবেশ ঘটছে সেখানকার জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার দেশের গড় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের থেকে অনেকখানি বেশি হবে। বিজেপি নেতাদের কথামতো অনুপ্রবেশের সংখ্যা যদি এমন কোটিতে কোটিতে হত তবে ভারতের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারটাও সেই অনুপাতে হঠাৎ বেড়ে যেত। বাস্তবে জনগণনার পরিসংখ্যান কী বলছে?
১৯৯১ সালের গণনা অনুযায়ী দেশে জনসংখ্যাবৃদ্ধির হার ছিল ২৩.৯ শতাংশ। ২০০১-এর গণনায় তা কমে হয়েছে ২১.৫ শতাংশ। ২০১১-র গণনা দেখিয়েছে এই বৃদ্ধির হার আরও কমে হয়েছে ১৭.৬। কেউ ভাবতে পারেন, অন্য রাজ্যের বৃদ্ধির হার কম এবং পশ্চিমবঙ্গের বৃদ্ধির হার বেশি হলেও গড়ে এ রাজ্যের হার কমে যেতে পারে। তা হলে আলাদা করে পশ্চিমবঙ্গের বৃদ্ধির হার দেখা যাক। জনগণনার রিপোর্ট অনুযায়ী, ‘৯১-এর গণনায় পশ্চিমবাংলায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ২৪.৭৩ শতাংশ। ‘০১ সালের গণনায় তা নেমে আসে ১৭.৭৭-এ। ২০১১ সালের রিপোর্টে তা আরও নেমে দাঁড়িয়েছে ১৩.৯৩ শতাংশে। ‘৮১-র গণনা থেকেই দেখা যাচ্ছে এই হার ক্রমাগত নেমে আসছে। তা হলে বিজেপি নেতাদের কথা মতো যে কোটি কোটি বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী এ দেশে প্রতিদিন ঢুকে পড়ছে এবং স্থানীয় মাতব্বরদের সহায়তায় ভোটার তালিকায় নাম তুলে দিব্বি নাগরিক হয়ে বসে থাকছে, তারা সব গেল কোথায়? কোনও তথ্য বা যুক্তির পরোয়া না করেই বিজেপি নেতারা ছড়িয়ে দিচ্ছেন যে, দলে দলে বাংলাদেশির ভারতে ঢুকে পড়ে ভারতের অর্থনীতিকে তছনছ করে দিচ্ছে। এর জন্যই চাই নাগরিক পঞ্জি এবং সিএএ।
মুসলিম জনসংখ্যা কি হিন্দুদের ছাড়িয়ে যাবে
বিজেপি নেতারা আরও একটা প্রচার করছেন যে, অনুপ্রবেশের ফলে মুসলমানের সংখ্যা এত হারে বাড়ছে যে অতি দ্রুত মুসলমানদের সংখ্যা হিন্দুদেরও ছাড়িয়ে যাবে। এই দাবিটা বিচার করে দেখা যাক। ২০১১-র গণনায় দেখা যাচ্ছে মুসলমানদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ক্রমাগত কমছে। ২০০১-এ এই হার ছিল ২৯.৬ শতাংশ, ২০১১-য় তা কমে দাঁড়িয়েছে ২৪.৬ শতাংশ। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমে যাওয়ার হিসেব কষলে দেখা যাচ্ছে হিন্দুদের বৃদ্ধি যে হারে কমছে তার চেয়ে ৫০ শতাংশেরও বেশি হারে কমছে মুসলমানদের জনসংখ্যা। বৃদ্ধির হারের এই কমতি ‘৮১-র গণনা থেকে দেখা যাচ্ছে টানা কমে আসছে। ‘৮১ থেকে ‘৯১ এই হার ছিল ৩২.৯ শতাংশ, ‘৯১-‘০১-এ ছিল ২৯.৬ শতাংশ, ‘০১-‘১১তে দাঁড়িয়েছে ২৪.৬ শতাংশ। কিন্তু চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনি। বিজেপি নেতাদের সঙ্গে সত্যের দূরত্ব যেহেতু বহু যোজনের তাই তাঁরা এই মিথ্যা প্রচার চালিয়েই যাবেন।
মুসলমান মহিলাদের মাথাপিছু গড় সন্তানের সংখ্যা ৩.১, আর হিন্দুদের ২.৭ এবং খ্রিস্টানদের ২.৩টি। মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির এটি একটি উল্লেখযোগ্য কারণ– অনুপ্রবেশ নয়। আবার মেয়েদের গড় বয়স কম হওয়া সত্ত্বেও যে মুসলমানদের মধ্যে দ্রুত হারে জনসংখ্যাবৃদ্ধি নিম্নমুখী, তাতে বোঝা যায়, এই অংশের মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ছে। যতই শিক্ষার হার বাড়বে, মেয়েরা কাজের জগতে বেশি করে আসবে ততই এই হার আরও দ্রুত নামতে থাকবে। হিসাবে দেখা যাচ্ছে, হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে জনসংখ্যার যে অংশের মধ্যে সচেতনতা এবং শিক্ষার হার কম সেই অংশের জন্মহার উভয় ক্ষেত্রেই প্রায় সমান এবং তা গড় হারের থেকে অনেক বেশি। ফলে এর সঙ্গে ধর্মের কোনও সম্পর্ক নেই।
সীমান্ত পেরিয়ে দলে দলে ঢোকা কি সম্ভব
বিজেপি নেতাদের বক্তব্য, প্রতিদিন অজস্র বাংলাদেশি মুসলমান সীমান্ত পেরিয়ে এ দেশে ঢুকে পড়ছে। কিন্তু বাস্তবে কি তা সম্ভব? কেন সম্ভব নয়? সম্ভব নয় কারণ, বিজেপির মতো সাম্প্রদায়িক, হিন্দুত্ববাদী, মুসলিম বিদ্বেষী একটি দল অনুপ্রবেশকে ভোটের ইস্যু করার জন্য দীর্ঘ দিন ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে অনুপ্রবেশ ঘটলে স্থানীয় মানুষের মধ্যে তার প্রতিক্রিয়া হবে। আর এখন তো দীর্ঘ দিন ধরে কেন্দ্রের বিজেপিরই সরকার। সীমান্তে প্রহরারত রয়েছে যে নিরাপত্তা বাহিনী তা তো কেন্দ্রীয় সরকারেরই অধীন। সেই বাহিনীর নিশ্ছিদ্র প্রহরা এড়িয়ে প্রতিদিন হাজারে হাজারে বাংলাদেশি এ দেশে ঢুকে পড়ছে, এটা কি বাস্তবে ঘটতে পারে? তা যদি সত্যি হয় তবে তো সবার আগে নিরাপত্তা বাহিনীর দক্ষতা নিয়েই প্রশ্ন উঠে যাবে। দেশের নিরাপত্তাও প্রশ্নের মুখে পড়ে যাবে। তাই যদি হয়, তবে তো সবার আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে অমিত শাহকেই নিজের ব্যর্থতার কথা, অপদার্থতার কথা স্বীকার করতে হয়। তা তিনি করবেন কি? তা ছাড়া তাঁরা কেন বলছেন না যে, সীমান্তে তাঁরা এমন ব্যবস্থা নেবেন যে আর কোনও অনুপ্রবেশকারী এ দেশে ঢুকতে পারবে না? এর থেকেই তো বোঝা যায় সত্যিই অনুপ্রবেশটা তাঁদের কাছে কোনও সমস্যা নয়, তাঁরা শুধু এটা প্রচার করে এর থেকে ফয়দা তুলতে চান।
গত দশকের শেষ থেকেই দেশের অর্থনীতিকে গ্রাস করেছে এক মহামন্দা। আজও সেই মন্দায় হাবুডুবু খাচ্ছে অর্থনীতি। অর্থনীতির বৃদ্ধির হার নেমে এসেছে ৫-এর নিচে। তার পরিণতিতে উৎপাদন শিল্পে লকআউট লে-অফ লেগেই আছে। ছাঁটাই হয়ে যাচ্ছে লাখ লাখ শ্রমিক-কর্মচারী। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। অর্থনীতির কোনও বিশেষজ্ঞই কিন্তু এই সংকটের জন্য অনুপ্রবেশকে দায়ী করেননি। প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী কিংবা বিজেপির কোনও নেতা-মন্ত্রীও বলেননি যে এর জন্য অনুপ্রবেশকারীরা দায়ী। বরং তাঁদের সরকারের পুঁজিবাদী নীতিই যে এর জন্য দায়ী, সেটিকে আড়াল করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মন্দাকেই দায়ী করেছেন। তা হলে বিজেপি নেতাদের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা একরকম, আর রাজনৈতিক ব্যাখ্যাটা কি অন্য রকম? এর থেকেই বোঝা যায়, অনুপ্রবেশ নিয়ে তাঁদের প্রচার আসলে উদ্দেশ্যমূলক।
এমন প্রচারের উদ্দেশ্য কী
বিজেপি নেতাদের এসব যুক্তি জানা নেই, এমনটা হতে পারে না। তবু যে তাঁরা এই প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন তার কারণ তাঁরা তো দেশের কল্যাণ, মানুষের কল্যাণের লক্ষে্য এসব করছেন না, করছেন ভোটের লক্ষ্যে। যেভাবে হোক হিন্দু মনকে আতঙ্কগ্রস্ত করে ভোটব্যাঙ্ক গড়ে তোলাই তাদের লক্ষ্য। তাই গোয়েবলসীয় কায়দায় মিথ্যাকে তারা বারে বারে বলে মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে চান। যেহেতু পুঁজিবাদী শোষণে এবং শাসক বুর্জোয়া দলগুলির লাগাতার প্রতারণায় মানুষের মন ক্ষুব্ধ হয়ে রয়েছে, তাই এমন একটা চটকদার প্রচারে অনেকে বিভ্রান্তও হয়ে যান। কিন্তু তাঁরাও যদি একটু তলিয়ে বিচার করেন তবে এর মিথ্যার দিকটা সহজেই ধরতে পারবেন।
বাস্তবে অনুপ্রবেশ কি ঘটছে না? ঘটছে। বিশ্বের সব দেশেই কম-বেশি ঘটে চলেছে। প্রতিবেশী দুটি দেশের মধ্যে অপেক্ষাকৃত উন্নত অর্থনীতির দেশে মানুষ কাজের খোঁজে, জীবন-জীবিকার অপেক্ষাকৃত উন্নত সুযোগের আশায় অনেক সময়েই চলে আসে। আর সে দুটি দেশ যদি একই ভাষাভাষী হয়, একটি মূল দেশ ভেঙেই দুটি দেশ তৈরি হয় তবে তো কথাই নেই। কিন্তু সেই সংখ্যাটাও বিজেপি নেতারা যেভাবে প্রচার করছেন তার ধারেকাছেও আছে বলে কোথাও কোনও প্রমাণ নেই। জীবিকার খোঁজে এমন অনুপ্রবেশ বিশ্বের প্রায় সব দেশেই রয়েছে। উন্নত অর্থনীতির দেশ আমেরিকাতে কি প্রতিবেশী মেক্সিকোর মানুষ আসছে না? আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্যের ভেঙে পড়া অর্থনীতির দেশগুলি থেকে এখন তো দলে দলে মানুষ ইউরোপের দেশগুলিতে ঢুকছে। ভারত বাংলাদেশ সহ এশিয়ার দেশগুলি থেকে বহু মানুষ বৈধ এবং অবৈধ উপায়ে ইংল্যান্ডে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিতে গিয়ে বসবাস করছে। কোথাও সেখানকার অধিবাসীরা এ নিয়ে এমন গেল গেল রব তোলেনি। একমাত্র কিছু উগ্র জাতীয়তাবাদী শক্তিই এ নিয়ে হইচই করছে। ঠিক যেমন এখানে বিজেপি করছে। বরং সেখানকার সাধারণ মানুষ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এই সব আশ্রয়প্রার্থীদের আশ্রয় দিতে সরকারকে বাধ্য করছে।
বাংলাভাষী মাত্রেই মিথ্যা প্রচারের শিকার
বিজেপির মিথ্যা প্রচারে দেশের কিছু সংখ্যক হলেও, এ রাজ্যের এমনকি একটা শিক্ষিত অংশও খানিকটা বিশ্বাস করে ফেলছেন। তাঁরা এর আর একটা মারাত্মক দিক খেয়াল করছেন না। বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবাংলা উভয়েরই ভাষা বাংলা। অনুপ্রবেশকারীরা বাংলাভাষী– এই প্রচারে বিশ্বাস করে বিশেষত বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে বাংলাভাষী মাত্রেই অনুপ্রবেশকারী এমন সিদ্ধান্ত এমনকি প্রশাসনে পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়তে দেখা যাচ্ছে। বেঙ্গালুরুতে পশ্চিমবাংলা থেকে কাজের জন্য যাওয়া শ্রমজীবী মানুষদের বাসস্থান কোনও বাছবিচার না করে ভেঙে ফেলা হয়েছে। তাঁদের রীতিমতো অপদস্থ করা হয়েছে। তদন্তে দেখা গেছে, এমনকি প্রশাসনিক কোনও নির্দেশ ছাড়াই পুলিশ এ কাজ করেছে। দেশের রাজধানী দিল্লিতে পর্যন্ত এ রাজ্যের মানুষকে হেনস্থা করা হচ্ছে। শুধু শ্রমজীবী মানুষেরাই নয়, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-অধ্যাপক এবং অন্য ক্ষেত্রে কর্মরত মানুষদেরও এই প্রচারের শিকার হতে হচ্ছে। উত্তরপ্রদেশে এ রাজ্য থেকে কাজ করতে যাওয়া মানুষদের নানা ভাবে হেনস্থা করা হচ্ছে। একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসাবে দেশের এক স্থানের যে কোনও মানুষের অপর যে কোনও অংশে বসবাস করার অধিকার রয়েছে। বিজেপির এই সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষপূর্ণ প্রচার সেই স্বাভাবিক অধিকারকেও কেড়ে নিচ্ছে।
এই অবস্থায় অনুপ্রবেশ নিয়ে বিজেপির সর্বনাশা রাজনীতিটি আজ সকলকেই বুঝতে হবে। কারণ এটি এমন একটি ইস্যু যা দুই সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে পারস্পরিক ঐক্যে ফাটল ধরিয়ে জনসাধারণের শোষণমুক্তির আন্দোলনে প্রভূত পরিমাণে ক্ষতি করবে এবং শাসক শ্রেণির হাতকেই শক্তিশালী করবে। তাই অত্যন্ত খোলা মন নিয়ে বিষয়টিকে বিচার করতে হবে এবং বিজেপি নেতাদের মিথ্যার মুখোশকে খুলে দিতে হবে।