নবজাগরণের পথিকৃৎ বিদ্যাসাগর (২৯) — বিদ্যাসাগর ও বর্ণপরিচয়

নবজাগরণের পথিকৃৎ বিদ্যাসাগর

ভারতীয় নবজাগরণের পথিকৃৎ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দ্বিশত জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে এই মহান মানবতাবাদীর জীবন ও সংগ্রাম পাঠকদের কাছে ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হচ্ছে৷

(২৯)

বিদ্যাসাগর ও বর্ণপরিচয়

আধুনিক শিক্ষার বিস্তার ঘটাতে গিয়ে বিদ্যাসাগর বাংলা ভাষার সংস্কার করার প্রয়োজন অনুভব করেছিলেন৷ সেই অনুভূতিরই যুগান্তকারী ফসল ‘বর্ণপরিচয়’৷ ১৮৫৫ সালের এপ্রিলে ‘বর্ণপরিচয়’–এর প্রথম ভাগ এবং জুনে দ্বিতীয় ভাগ তিনি প্রকাশ করেন৷ ‘বর্ণপরিচয়’–এর আগে ‘লিপিধারা’ (১৮১৫), ‘জ্ঞানারুণোদয়’ (১৮২০) ‘বাঙ্গালা শিক্ষাগ্রন্থ’ (১৮২১), ‘বঙ্গবর্ণমালা’ (১৮৩৫),  দু’ভাগে ‘শিশুশিক্ষা’ (১৮৪৯, ’৫০), দু’ভাগে ‘বর্ণমালা’ (১৮৫৩, ’৫৪), তিন ভাগে ‘শিশুসেবধি’ (১৮৫৪) ইত্যাদি বইগুলি ছিল৷ তা সত্ত্বেও ‘বর্ণপরিচয়’– লেখবার কথা কেন মনে করলেন বিদ্যাসাগর? বস্তুত, তাঁর এই মানসিকতার মধ্যে রয়েছে ঐতিহ্যবাদের বিরুদ্ধে বিজ্ঞানমনস্ক্তার ছাপ৷ ‘বর্ণপরিচয়’–এর দ্বারা বাংলা ভাষাকে তিনি সংসৃক্তের অহেতুক শাসনজাল থেকে মুক্ত করে আধুনিক বৈজ্ঞানিক ভিত্তির উপর দৃঢ়ভাবে দাঁড় করিয়েছিলেন৷

‘বর্ণপরিচয়’–এর আগে প্রকাশিত বইগুলি শিশুদের ক্ষেত্রে যথার্থ অর্থে উপযুক্ত ছিল না৷ কারণ, বইগুলি শুধু বর্ণশিক্ষার জন্য ছিল না৷ বইগুলির শিক্ষণপদ্ধতি ছিল জটিল এবং সেগুলির মধ্যে আরও নানা বিষয় যুক্ত ছিল, যা প্রাথমিক শিক্ষার্থীর কাছে ছিল বাধাস্বরূপ৷ যেমন, ‘বাঙ্গালা শিক্ষাগ্রন্থ’ বইটিতে বর্ণমালা, ব্যাকরণ, ইতিহাস, ভূগোল, গণিত ইত্যাদি সব মিলিয়ে বইটির পৃষ্ঠাসংখ্যা ২৮৮৷ একটা শিশুর হাতে শিক্ষাজীবনের শুরুতেই এত মোটা বই ধরানো কোনও ভাবেই বাঞ্ছিত নয়৷

দ্বিতীয়ত, ওই সমস্ত বইগুলিতেই বর্ণের সংখ্যা অহেতুক বেশি ছিল৷ এটি সংস্কৃত ভাষার নেতিবাচক প্রভাব বলেই মনে করা হয়৷ কিন্তু ‘বর্ণপরিচয়’–এর আগে কেউই সে প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারেননি৷ লেখাই বাহুল্য, এটা তাঁদের যোগ্যতা–যোগ্যতার ব্যাপার ছিল না৷ ব্যাপারটা ছিল নতুন দৃষ্টিভঙ্গির৷ শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সাথে সমাজ কীভাবে যুক্ত, তার ক্ষুরধার উপলব্ধির প্রশ্ণ এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে৷ তাই, বর্ণশিক্ষাকে সঠিক খাতে তরান্বিত করতে বিদ্যাসাগরই প্রথম অপ্রয়োজনীয় বর্ণগুলিকে বাদ দেন৷ স্বরবর্ণ এবং ব্যঞ্জনবর্ণের সারণি সংস্কার করেন৷ তাঁর নিজের ভাষায়, ‘‘বহুকাল অবধি বর্ণমালা ষোলো স্বর ও চৌত্রিশ ব্যঞ্জন এই পঞ্চাশ অক্ষরে পরিগণিত ছিল৷ কিন্তু বাংলা ভাষায় দীর্ঘ ঋ–কার এবং দীর্ঘ লি–কারের প্রয়োগ নেই৷ এই নিমিত্ত এই দুই বর্ণ পরিত্যক্ত হইয়াছে৷ আর সবিশেষ অনুধাবন করিয়া দেখিলে অনুস্বরও স্বরবর্ণের মধ্যে পরিগণিত হইতে পারে না৷ এজন্য ওই দুই বর্ণ ব্যঞ্জনবর্ণের মধ্যে পঠিত হইয়াছে৷ …ক ও ষ মিলিয়া ‘ক্ষ’ হয়, সুতরাং উহা সংযুক্ত বর্ণ এ জন্য অসংযুক্ত ব্যঞ্জনবর্ণের গণনাস্থলে পরিত্যক্ত হইয়াছে৷’’

তৃতীয়ত, শিশুদের বাংলা বর্ণের সাথে পরিচয় ঘটানোর ক্ষেত্রেও বিদ্যাসাগরের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অত্যন্ত বাস্তবসম্মত৷ যেমন, তিনি একই ধরনের বর্ণগুলিকে একসঙ্গে লিখতে শেখানোর উপর জোর দিয়েছেন৷ অর্থাৎ, ‘ব’–এর সঙ্গে আকারগত মিল আছে ‘র, ক, ধ, ঋ–এর৷ আবার ড় ঙ ভ ত বা ঢ  ট’– এগুলোর মধ্যেও আকারগত মিল আছে৷ বলেছেন, এগুলো একসঙ্গে শেখালে শিশুরা দ্রুত তা আয়ত্ত করবে৷ ‘বর্ণপরিচয়’–এর শব্দ তিনি বেছেছেন শিশুর পরিবেশ ও অভিজ্ঞতার গণ্ডি থেকে৷ সেখানে তৎসম শব্দের ব্যবহার যথাসম্ভব কম করেছেন৷ বিদ্যাসাগরের বেছে নেওয়া শব্দসমষ্টির মধ্যে একটা ছন্দও খুঁজে পাওয়া যাবে৷ যেমন ‘অচল, অধম’ বা ‘ঐক্য, বাক্য, মাণিক্য’৷ শব্দ থেকে যখন ছোট ছোট বাক্যের জগতে শিশু পা ফেলছে, সেখানেও এই ছন্দোবদ্ধতা দেখা যাবে৷ যেমন–

পথ ছাড়  জল খাও /হাত ধর বাড়ি যাও

জল পড়ে মেঘ ডাকে/ হাত নাড়ে খেলা করে

এই সূত্রে রবীন্দ্রনাথের একটি উক্তি স্মরণযোগ্য, যেখানে তিনি বলেছেন, ‘‘কেবল মনে পড়ে ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’৷ তখন ‘কর খল’ প্রভৃতি বানানের তুফান কাটাইয়া সবে কূল পাইয়াছি৷ সেদিন পড়িতেছি ‘জল পড়ে পাতা নড়ে৷’ আমার জীবনে এটাই আদি কবির প্রথম কবিতা৷’’

শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক, উভয়ের মনস্তত্ত্ব সম্পর্কেও যে তাঁর গভীর জ্ঞান ছিল সেটা বোঝা যায় ‘বর্ণপরিচয়’ দ্বিতীয় ভাগে, শিক্ষকদের উদ্দেশে তাঁর নির্দেশিকা থেকে৷ সেখানে তিনি বলছেন, ‘‘সংযুক্ত বর্ণের উদাহরণস্থলে যে সকল শব্দ আছে, শিক্ষক মহাশয়েরা উহার বর্ণ বিভাগ মাত্র শিখাইবেন, অর্থ শিখাইবার নিমিত্ত প্রয়াস পাইবেন না৷’’

বস্তুত, বর্ণপরিচয়ে শিশু মনের উপযোগী করে শব্দচয়ন, বাক্যগঠন, বিষয়বস্তু উপস্থাপনা, ভাষার ব্যঞ্জনা– সর্বক্ষেত্রেই তিনি গভীর বিজ্ঞানমনস্ক্তার ছাপ রেখেছেন৷ বিবেকানন্দের একসময় আক্ষেপ ছিল, বাংলা ভাষায় শিশুমনের উপযোগী পাঠ্যপুস্তক নেই৷ সেই বিবেকানন্দই পরে বর্ণপরিচয় সম্পর্কে বলেছেন, ‘‘শিশুমনের সঙ্গে নিবিড় একাত্মতা অনুভব করে তাকে ধাপে ধাপে ভাষা শেখাবার চমৎকার ব্যবস্থা৷ বিদ্যেসাগর মশায়ের মতো পাকা শিক্ষকেরই উপযুক্ত কাজ৷ ভাষা শিক্ষানবীশদের জ্ঞানের স্তরভেদ, বর্ণ ও বাক্যবিন্যাস– যথাযথ এর মধ্যে করা হয়েছে৷’’ কার্যত, ‘বর্ণপরিচয়’–এ বিদ্যাসাগর বিশেষত ছেদ–যতি চিহ্ণের সুন্দর প্রয়োগ ঘটিয়েছেন, যা ভাব ও ভাষাকে অত্যন্ত সুষমামণ্ডিত করেছে৷

‘বর্ণপরিচয়’–এর আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, ছোট ছোট গল্পের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মনে ভাল–মন্দ, ঠিক–বেঠিক সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি করে দেওয়া৷ তাদের মধ্যে দায়িত্ববোধ, কর্তব্যবোধ, দয়ামায়া, মানুষের প্রতি ভালবাসা, জাগিয়ে তোলা৷ ‘বর্ণপরিচয়’ দ্বিতীয় ভাগের রাখাল, গোপাল, ভুবনদের কথা আজও আমাদের মনে দাগ কেটে আছে৷ ভুবনের বেদনাদায়ক পরিণতি আজও আমাদের মনে ব্যথা জাগায়৷ এর মধ্যে রয়েছে সেই মূল্যবোধ যা শিক্ষার্থীকে যথার্থ মানুষ হিসাবে গড়ে উঠতে শেখায়৷ এর পিছনে রয়েছে তাঁর সেই পার্থিব মানবতাবাদী চিন্তা যার মূল কথা হল– ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’৷ বোধোদয়, জীবনচরিতের মতো তাঁর অন্যান্য পাঠ্যপুস্তকেও এটা তিনি করেছেন বড় মানুষদের জীবনীর সাহায্যে৷ দেখাতে চেয়েছেন– মানুষ ভবিষ্যতে কী হবে, সেটা তার কপালে লেখা থাকে না৷ তা নির্ভর করে তার জীবন সংগ্রামের উপর৷

এই সব কিছুর সাথে ‘বর্ণপরিচয়’–এর মধ্যে সবচেয়ে যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হল, এই বইতে বিদ্যাসাগর কোথাও কোনও ধর্মীয় অনুষঙ্গ টানেননি৷ কাহিনীর সঙ্গে ধর্ম বা ধর্মীয় সংস্কারের কোনও সংস্রব নেই৷ ‘বর্ণপরিচয়’ সহ অন্যান্য পাঠ্যপুস্তকে বিদ্যাসাগর অত্যন্ত সচেতনভাবে অপার্থিব চিন্তা বাদ দিয়েছেন৷ কোথাও লেখেননি– মিথ্যা বলা পাপ৷ ‘পাপ–পুণ্যের’ ধর্মীয় ধারণা তিনি নতুন যুগের নতুন প্রয়োজনের নিরিখেই আনেননি৷ তিনি লিখেছেন– মিথ্যা বলা বড় দোষ৷ যে মিথ্যা কথা বলে কেহ তাহাকে ভালবাসে না৷

প্রায় সমস্ত আধুনিক ভাষাতাত্ত্বিকরা স্বীকার করেন, বর্ণপরিচয়ের প্রভাব ভারতের অন্যান্য ভাষাগুলিকেও তাদের ভাষাগত বনিয়াদ গড়ে তুলতে সহায়তা করছে৷ এটা ছিল ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে এক নতুন দিশারি৷ আধুনিক শিক্ষাচিন্তার আধারের উপর দাঁড়িয়ে ভাষাশিক্ষার প্রাথমিক ধাপটি কেমন হবে বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’ তারই হদিশ দিয়েছে৷ তার সাথে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে বিশেষত বাংলা গদ্যের তিনি নবনির্মাণ করে গেছেন৷ অধ্যাপক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘‘বাঙ্গালা গদ্যের অন্তর্নিহিত ঝংকার সম্বন্ধে সচেতন হওয়া এখনকার দিনে অসম্ভব নয়৷ কিন্তু যখন ভালো গদ্যের নমুনা কদাচিৎ দেখা যাইত, সেইকালে বিদ্যাসাগর যে কী অনন্যসাধারণ প্রতিভাবলে বাঙ্গালা গদ্যের সেই অন্তর্নিহিত ঝংকারের সম্ভাবনা বা অস্তিত্ব আবিষ্কার করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন, তাহা ভাবিলে বিস্ময়াবিষ্ট হইতে হয়৷ অর্থাৎ গদ্য রচনার ছন্দবিষয়ে তিনিই ছিলেন প্রথম দ্রষ্টা ও স্রষ্টা৷ গদ্যপাঠের ধ্বনি–সামঞ্জস্যে যে পাঠক ও শ্রোতা আনন্দ পাইতে পারে, এই সূক্ষ্ণ অনুভূতি তাঁহার ছিল৷’’ (চলবে)

(গণদাবী : ৭২ বর্ষ ২৭ সংখ্যা)

 

Check Also

সব রাজ্যের সব শাসকের ভরসা ‘খয়রাতি’তেই

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভোট নাগরিকদের অধিকার। প্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকার। বিধানসভা, লোকসভার মতো আইনসভাগুলিতে কে জনগণের প্রতিনিধিত্ব …