নবজাগরণের পথিকৃৎ বিদ্যাসাগর
ভারতীয় নবজাগরণের পথিকৃৎ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দ্বিশত জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে এই মহান মানবতাবাদীর জীবন ও সংগ্রাম পাঠকদের কাছে ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হচ্ছে৷
(২৩)
শরৎচন্দ্র ও বিদ্যাসাগর
উনিশ শতকের ভারতীয় সমাজে, নবজাগরণের পার্থিব মানবতাবাদী চিন্তাকে হাতিয়ার করে, বিদ্যাসাগর এক সুমহান এবং ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছেন৷ সমাজ–সভ্যতার যথার্থ অগ্রগতির স্বার্থে তিনি চেয়েছিলেন নারী–পুরুষ নির্বিশেষে প্রত্যেক ব্যক্তি আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হোক, জ্ঞানে–চরিত্রে–মূল্যবোধে বড় হোক, অন্যের দুঃখ–বেদনায় পরমাত্মীয় হোক৷ বিদ্যাসাগর নিজের জীবন ও কর্ম দিয়ে স্বয়ং সেই অপার মনুষ্যত্বের বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গিয়েছেন৷
বিদ্যাসাগরের সামাজিক এই চিন্তা–চেতনাকে, মনুষ্যত্বের সাধনাকে বিশেষত নারীমুক্তির ক্ষেত্রে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিকে রসোত্তীর্ণ ভাবে বহন করেছেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর অনন্যসাধারণ কথাসাহিত্যের মধ্য দিয়ে৷ বিদ্যাসাগরের কাঙিক্ষত চরিত্রকে সাহিত্যে রূপ দিয়ে সমাজ–ভ্যন্তরে উন্নততর হৃদয়বৃত্তির এক উজ্জ্বল দীপশিখা জ্বালিয়েছিলেন শরৎচন্দ্র৷ এই কারণেই এ–যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মার্কসবাদী চিন্তাবিদ কমরেড শিবদাস ঘোষ শরৎসাহিত্য সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে তাঁর সৃষ্ট কয়েকটি চরিত্রের উদাহরণ দিয়ে বলেছেন, ‘‘গোকুল, যাদব, গিরীশের দলই বিকাশের পথে কমিউনিস্ট হয়৷ নারীদের মধ্যে বিন্দু, নারায়ণী, হেমাঙ্গিনী, ‘নিষ্কৃতি’র ছোট–বৌ, বড়–বৌ– এই জাতের নারীরাই সুযোগ পেলে বিকাশের পথে সত্যিকারের কমিউনিস্ট হতে পারে৷’’
শরৎচন্দ্রের প্রবল আক্ষেপ ছিল যে, বিদ্যাসাগরের মহান কর্মকাণ্ডের পক্ষে দৃঢ়ভাবে এগিয়ে আসেননি তাঁর সমকালীন তেমন কোনও সাহিত্যিক৷ খুব দুঃখ করে তিনি বলেছেন, ‘‘স্বর্গীয় বিদ্যাসাগর মহাশয় যখন গভর্নমেন্টের সাহায্যে বিধবা–বিবাহ বিধিবদ্ধ করেছিলেন, তখন তিনি কেবল শাস্ত্রীয় বিচারই করেছিলেন, হিন্দুর মনের বিচার করেননি৷ তাই আইন পাশ হল বটে, কিন্তু হিন্দুসমাজ তাকে গ্রহণ করতে পারলে না৷ তাঁর অতবড় চেষ্টা নিষ্ফল হয়ে গেল৷ নিন্দা, গ্লানি, নির্যাতন তাঁকে অনেক সইতে হয়েছিল, কিন্তু তখনকার দিনের কোন সাহিত্যসেবীই তাঁর পক্ষ অবলম্বন করলেন না৷ হয়ত, এই অভিনব ভাবের সঙ্গে তাঁদের সত্যই সহানুভূতি ছিল না, হয়ত, তাঁদের সামাজিক অপ্রিয়তার অত্যন্ত ভয় ছিল, যে জন্যই হউক,সেদিনের সে ভাবধারা সেইখানেই রুদ্ধ হয়ে রইল– সমাজদেহের স্তরে স্তরে, গৃহস্থের অন্তঃপুরে সঞ্চারিত হতে পেলে না৷ কিন্তু এমন যদি না হত, এমন উদাসীন হয়ে যদি তাঁরা না থাকতেন, নিন্দা, গ্লানি, নির্যাতন– সকলই তাঁহাদিগকে সইতে হত সত্য, কিন্তু আজ হয়ত আমরা হিন্দুর সামাজিক ব্যবস্থার আর একটা চেহারা দেখতে পেতাম৷ সে দিনের হিন্দুর চক্ষে যে সৌন্দর্য–সৃষ্টি কদর্য, নিষ্ঠুর ও মিথ্যাপ্রতিভাত হত, আজ অর্ধশতাব্দী পরে তারই রূপে হয়ত আমাদের নয়ন ও মন মুগ্ধ হয়ে যেত৷’’ (সূত্র , সাহিত্যে আর্ট ও দুর্নীতি)৷
শরৎচন্দ্রের এই বুকভাঙা আক্ষেপ থেকে বোঝা যায়, বিদ্যাসাগরের হৃদয়ের বেদনাকে, সেই বেদনাবোধ থেকে সৃষ্ট তাঁর অবিচল কর্তব্যনিষ্ঠাকে তিনি কী গভীর ভাবে উপলব্ধি করেছিলেন৷ সত্যিকারের বড় মানুষ বলতে তিনি বিদ্যাসাগরের মতো মানুষদেরই বুঝতেন৷ আবার, শরৎচন্দ্রের এই উপলব্ধি উপর–উপর ছিল না৷ ছিল না বলেই তাঁর ‘পণ্ডিতমশাই’ উপন্যাসে আমরা পাই, গ্রামের মধ্যে একটি ছোট্ট পাঠশালা সম্পর্কে বৃন্দাবন ও কেশবের মধ্যে আলোচনায় কেশব বলছে : ‘‘কিন্তু তোমার আমার সামর্থ্য কতটুকু? এই ছোট্ট একটুখানি পাঠশালায় জনকতক ছাত্রকে পড়িয়ে কতটুকু প্রায়শ্চিত্ত হবে?’’ বৃন্দাবন বিস্মিতভাবে একমুহূর্ত চাহিয়া থাকিয়া কহিল, ‘‘কথাটা ঠিক হল না ভাই৷ আমার পাঠশালার একটি ছাত্রও যদি মানুষের মত মানুষ হয়, তো এই ত্রিশ কোটি লোক উদ্ধার হয়ে যেতে পারে৷ নিউটন, ফ্যারাডে, রামমোহন, বিদ্যাসাগর ঝাঁকে ঝাঁকে তৈরি হয় না কেশব৷ বরং আশীর্বাদ কর যেন এই ছোট পাঠশালার একটি ছাত্রকেও মরণের পূর্বে মানুষ দেখে মরতে পারি৷’’
মান্ধাতা আমলের কুসংস্কারকে আঁকড়ে ধরে তথাকথিত শাস্ত্রবাদীরা মানুষকে নিপীড়ন করছে দেখে ‘বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিৎ কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’ (দ্বিতীয় পুস্তক)–এ বিদ্যাসাগর লিখেছেন, ‘‘ধন্যরে দেশাচার তোর কী অনির্বচনীয় মহিমা …তুই, ক্রমে ক্রমে আপন আধিপত্য বিস্তার করিয়া …হিতাহিতবোধের গতিরোধ করিয়াছিস, ন্যায়–ন্যায় বিচারের পথ রুদ্ধ করিয়াছিস৷’’ বিদ্যাসাগরের এই পথ ধরেই, তাকে আরও স্পষ্ট করে শরৎচন্দ্র লিখেছেন, ‘‘কোন একটা বিশেষ নিয়ম যখন দেশের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন তাহা যে একদিনেই হইয়া যায় তাহা নহে, ধীরে ধীরে সম্পন্ন হইতে থাকে৷ যাঁহারা সম্পন্ন করেন, তাঁহারা পুরুষের অধিকার লইয়া করেন৷ তখন তাঁহারা পুরুষ– পিতা নন, ভ্রাতা নন, স্বামী নন৷ যাঁহাদের সম্বন্ধে নিয়ম করা হয়, তাঁহারাও আত্মীয়া নহে, নারীমাত্র৷ পুরুষ তখন পিতা হইয়া কন্যার দুঃখের কথা ভাবে না৷ সে তখন পুরুষ হইয়া পুরুষের কল্যাণ চিন্তা করে– নারীর নিকট হইতে কতখানি কিভাবে আদায় করিয়া লইবে, সেই উপায় উদ্ভাবন করিতে থাকে৷ তারপর মনু আসেন, পরাশর আসেন, মোজেস আসেন, পল আসেন, শ্লোক বাঁধেন, শাস্ত্র তৈয়ার করেন– স্বার্থ তখন ধর্ম হইয়া সুদৃঢ় হস্তে সমাজ–শাসন করিবার অধিকার লাভ করে৷’’ (সূত্র : নারীর মূল্য)৷
ওই পুস্তকে বিদ্যাসাগর বাল্যবিধবাদের সীমাহীন দুর্দশার কথা লিখেছেন৷ বুকের রক্ত নিংড়ানো সেই লেখা পড়লে আজও তাঁর হৃদয়ের যন্ত্রণা শোনা যায়৷ সেখানে আছে নিষ্ঠুর সমাজের প্রতি বিদ্যাসাগরের করুণাঘন আর্তি– ‘‘হা ভারতবর্ষীয় মানবগণ …হতভাগ্য বিধবাদিগের দুরবস্থা দর্শনে, তোমাদের চিরশুষ্ক নীরস হৃদয়ে কারুণ্যরসের সঞ্চার হওয়া কঠিন, এবং ব্যাভিচার দোষের ও ভ্রূণহত্যা পাপের প্রবল স্রোতে দেশ উচ্ছলিত হইতে দেখিয়াও, মনে ঘৃণার উদয় হওয়া অসম্ভাবিত৷ …কী আশ্চর্য শাস্ত্রের বিধি অবলম্বনপূর্বক, পুনরায় বিবাহ দিয়া, তাহাদিগকে দুঃসহ বৈধব্যযন্ত্রণা হইতে পরিত্রাণ করিতে এবং আপনাদিগকেও সকল বিপদ হইতে মুক্ত করিতে সম্মত নহে৷ …হায়, কী পরিতাপের বিষয় যে দেশের পুরুষজাতির দয়া নাই, ধর্ম নাই, ন্যায়–ন্যায় বিচার নাই, হিতাহিত বোধ নাই, সদ্বিবেচনা নাই, কেবল লৌকিক রক্ষাই প্রধান কর্ম ও পরম ধর্ম, আর যেন সে দেশে হতভাগা অবলাজাতি জন্মগ্রহণ না করে৷’’ –বিদ্যাসাগরের এই যন্ত্রণা যথার্থ ভাবে বহন করেছেন সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র৷ সমাজের মধ্যে বিধবা নারীর উপর সংঘটিত চরম অবমাননা দেখে কাতরভাবে তিনি লিখেছেন, ‘‘সে নিরাভরণা, সে একবেলা খায়, সে হাড়ভাঙা খাটুনী খাটে, থান–কাপড় পরে, কেন না সে দেবী চীৎকার করিয়া পুরুষ প্রচার করিতে লাগিল আমাদের বিধবার মত কাহার সমাজে এমন দেবী আছে অথচ দেবীটিকে বিবাহের ছাঁদনা তলায় ঢুকিতে দেওয়া হয় না– পাছে দেবীর মুখ দেখিলেও আর কেহ দেবী হইয়া পড়ে৷ মঙ্গল–উৎসবে দেবীর ডাক পড়ে না, দেবীর ডাক পড়ে শ্রাদ্ধের পিণ্ড রাঁধিতে’’ (সূত্র : নারীর মূল্য)৷
অনতিকাল পরেই বিধবা হবে– এ কথা নিশ্চিতভাবে জেনেও রক্ষণশীল সমাজের রক্তচক্ষুর চাপে নিতান্ত বৃদ্ধের সঙ্গে হলেও শিশুকন্যাদের বিবাহ দিয়ে বাকি সারাটা জীবন সেই বিধবাদের উপর যারা নিপীড়ন চালায় তাদের কখনও ক্ষমা করেননি বিদ্যাসাগর, করেননি শরৎচন্দ্র৷ শরৎচন্দ্রের লেখার ছত্রে–ছত্রে তাই দেখা দিয়েছে নারীর উপর অবদমনের চিত্র, তার বিরুদ্ধে ক্ষোভ ও ধিক্কার৷ ‘পথনির্দেশ’ গল্পে হেম–এর মা’র সংলাপে শরৎচন্দ্র লিখেছেন, ‘‘কি জানি কোন পাষাণ বিধবার সাজ তৈরি করে গিয়েছিল৷’’ নিপীড়িত নারীর অভিমানকে শরৎচন্দ্র ব্যক্ত করেছেন ব্যঞ্জনাময় ধিক্কারে৷ শরৎচন্দ্র এরকম অসংখ্য নারী চরিত্র সৃষ্টি করেছেন, কিন্তু কোথাও এতটুকু উগ্রতা প্রকাশ করেননি৷ এইটিই তাঁর শৈলী, শৈলীর অনন্যতা এবং অবশ্যই স্মরণীয়, বিদ্যাসাগরের ধারাবাহিকতাতেই এই অনুপম শৈলীর অভ্যুদয়৷
নৈতিক দিক থেকেও শরৎচন্দ্রকে বিদ্যাসাগরের অনুসারী বলতে হয়৷ রক্ষণশীল সমাজ এবং তার ভয়ে কুণ্ঠিত লোকজনকে বিদ্যাসাগর বলতেন, ‘‘আমি দেশাচারের নিতান্ত দাস নহি৷ নিজের বা সমাজের মঙ্গলের নিমিত্ত যাহা উচিত বা আবশ্যক বোধ হইবে তাহা করিব৷ লোকের বা কুটুম্বের ভয়ে কদাচ সঙ্কুচিত হইব না৷’’ (সূত্র , ভাই শম্ভু চন্দ্রকে লেখা চিঠি)৷ আর, শরৎচন্দ্র তাঁর বিখ্যাত ‘নারীর মূল্য’ প্রবন্ধের উপসংহারে বলেছেন, ‘‘নারীর উপর পুরুষের কাল্পনিক অধিকারের মাত্রা বাড়াইয়া তুলিলে কি অনিষ্ট ঘটে, তাহা নিজের কথায় ও পরের কথায় বলিবার চেষ্টা করিয়াছি– এই মাত্র৷ তাহাতে শাস্ত্রের অসম্মান করা হইয়াছে, কি হয় নাই, দেশাচারের উপর কটাক্ষ করা হইয়াছে, কি হয় নাই– একথা মনে করিয়া কোথাও থামিয়া যাইতে পারি নাই৷ যাহা সত্য তাহাই বলিব এবং বলিয়াছিও৷’’
কেউ কেউ শরৎচন্দ্রকে প্রশ্ন করেছেন, ‘বিদ্যাসাগর বাস্তবে বিধবার বিবাহ দিতে পেরেছেন৷ কিন্তু আপনি সাহিত্যে বিধবার বিয়ে দিতে পারলেন না কেন?’ শরৎচন্দ্র বলেছেন, ‘‘ ‘পল্লীসমাজ’ বলে আমার একখানা ছোট বই আছে৷ তার বিধবা রমা বাল্যবন্ধু রমেশকে ভালবেসেছিল বলে আমাকে অনেক তিরস্কার সহ্য করতে হয়েছে৷ একজন বিশিষ্ট সমালোচক এমন অভিযোগও করেছিলেন যে, এতবড় দুর্নীতির প্রশ্রয় দিলে গ্রামে বিধবা আর কেউ থাকবে না৷ মরণ–বাঁচনের কথা বলা যায় না, প্রত্যেক স্বামীর পক্ষেই ইহা গভীর দুশ্চিন্তার বিষয়৷ কিন্তু আর একটা দিকও ত আছে৷ ইহার প্রশ্রয় দিলে ভাল হয় কি মন্দ হয়, হিন্দু–সমাজ স্বর্গে যায় কি রসাতলে যায়, এ মীমাংসার দায়িত্ব আমার উপরে নাই৷ রমার মত নারী ও রমেশের মত পুরুষ কোন কালে, কোন সমাজেই দলে দলে ঝাঁকে ঝাঁকে জন্মগ্রহণ করে না৷ উভয়ের সম্মিলিত পবিত্র জীবনের মহিমা কল্পনা করা কঠিন নয়৷ কিন্তু হিন্দু–সমাজে এ সমাধানের স্থান ছিল না৷ তার পরিণাম হল এই যে, এতবড় দু’টি মহাপ্রাণ নর–নারী এ জীবনে বিফল, ব্যর্থ, পঙ্গু হয়ে গেল৷ মানবের রুদ্ধ হূদয়দ্বারে বেদনার এই বার্তাটুকুই যদি পঁৌছে দিতে পেরে থাকি, ত তার বেশী আর কিছু করবার আমার নেই৷ এর লাভালাভ খতিয়ে দেখবার ভার সমাজের, সাহিত্যিকের নয়৷ রমার ব্যর্থ জীবনের মত এ রচনা বর্তমানে ব্যর্থ হতে পারে, কিন্তু ভবিষ্যতের বিচারশালায় নির্দোষীর এত বড় শাস্তি ভোগ একদিন কিছুতেই মঞ্জুর হবে না, এ কথা আমি নিশ্চয় জানি৷ এ বিশ্বাস না থাকলে সাহিত্যসেবীর কলম সেইখানেই সে দিন বন্ধ হয়ে যেত৷’’ (সাহিত্যে আর্ট ও দুর্নীতি)৷
বিদ্যাসাগর নারীকে কারও অনুকম্পার পাত্রী করতে চাননি৷ তিনি সর্বদাই চেয়েছিলেন, ছেলেদের মতো মেয়েরাও আধুনিক শিক্ষার আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে মানুষের মতো মানুষ হোক৷ বিদ্যাসাগর চেয়েছিলেন, কোনও সামাজিক অধিকার থেকে, এমনকি পৈতৃক সম্পত্তি থেকেও, নারীকে যেন বঞ্চিত করা না হয়৷ নারীকে এই যথার্থ মনুষ্যত্বের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হতে গেলে সমাজ–মানসিকতায় বদল চাই, সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়ে এটি কোনও ভাবেই সম্ভবপর নয়৷ এই কঠোর–কঠিন কাজই আজীবন করে গিয়েছেন বিদ্যাসাগর৷ তাঁর ধারাবাহিকতাতে শরৎচন্দ্রও, বিশেষত নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে সমাজ–মানসিকতা পরিবর্তনের জন্য নিজের অমিত শক্তিশালী লেখনীকে প্রয়োগ করেছিলেন৷ সে–কারণেই তাঁর অভূতপূর্ব সৃষ্টি, বিখ্যাত ‘চরিত্রহীন’ উপন্যাসে সাবিত্রী’র সংলাপে শরৎচন্দ্র এক অসাধারণ দার্শনিক কথা লিখেছেন৷ তিনি লিখেছেন, ‘‘তুমি বলবে সত্য হোক মিথ্যা হোক আমি সমাজ চাইনে, তোমাকে চাই৷ কিন্তু আমি তো তা বলতে পারিনে৷ সমাজ আমাকে চায় না, আমাকে মানে না জানি৷ কিন্তু আমি তো সমাজ চাই, আমি তো তাকে মানি৷ আমি তো জানি, শ্রদ্ধা ছাড়া ভালবাসা দাঁড়াতে পারে না৷’’ বিদ্যাসাগরের চিন্তাকে প্রসারিত করে শরৎচন্দ্র তাঁর ‘স্বরাজ সাধনায় নারী’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘‘মেয়েকে যে মানুষ বলে নেয়, কেবল মেয়ে বলে, দায় বলে, ভার বলে নেয় না, সেই কেবল এর দুঃখ বইতে পারে, অপরে পারে না৷’’ (চলবে)