নবজাগরণের পথিকৃৎ বিদ্যাসাগর(৩২) — বর্তমান প্রেক্ষিতে বিদ্যাসাগর

ভারতীয় নবজাগরণের পথিকৃৎ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দ্বিশত জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে এই মহান মানবতাবাদীর জীবন ও সংগ্রাম পাঠকদের কাছে ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হচ্ছে।

(৩২)

বর্তমান প্রেক্ষিতে বিদ্যাসাগর

আজ থেকে প্রায় একশো সত্তর বছর আগে, দেশের সাধারণ মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে বিদ্যাসাগর যে সামাজিক আন্দোলন শুরু করেছিলেন, ১৯৪৭-এর পর থেকে বর্তমান ভারতের রাষ্ট্রব্যবস্থা ধীরে ধীরে কার্যত সে আন্দোলনকে পরিত্যাগ করেছে। বিদ্যাসাগরের মতো নবজাগরণের মনীষীদের অক্লান্ত পরিশ্রম এবং কঠিন সংগ্রামের ফলে যেটুকু যথার্থ শিক্ষাব্যবস্থার পরিকাঠামো এদেশে গড়ে উঠেছিল, নানা সময়ে নানা দলের সরকারি উদ্যোগে সেই পরিকাঠামোকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করা হচ্ছে। যে কোনও জবরদখলমূলক অত্যাচারী শাসন ব্যবস্থার মতো ‘স্বাধীন’ ভারতেও বরাবরই শিক্ষাকে দেখা হচ্ছে নিছক পয়সা রোজগারের উপায় হিসাবে। ফলে, সমস্ত দিক থেকে সরকারগুলির এই জনবিরোধী কার্যকলাপের অনিবার্য পরিণতিও ভোগ করছে দেশ তথা দেশের সাধারণ শ্রমজীবী জনগণ।

ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড বুরোর সংগৃহীত তথ্যের (২০১৯) বিশ্লেষণে এক ভয়ঙ্কর চিত্র সামনে এসেছে। সেই বিশ্লেষণ অনুযায়ী, বর্তমান ভারতবর্ষে বিশেষ করে শিক্ষিত এবং উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা ব্যাপকভাবে বাড়ছে। স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী থেকে শুরু করে, শিক্ষক অধ্যাপক ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার সরকারি অফিসার উকিল পুলিশ প্রমুখের একটা বড় অংশ, নিজেদের নানা ধরনের চাহিদা মেটাবার জন্য, প্রায় নির্বিচারে যে কোনও অপরাধমূলক কার্যকলাপে লিপ্ত হচ্ছে। প্রতিদিনকার সংবাদপত্রেও এমন বহু ঘটনার উল্লেখ থাকে।

এ হেন প্রবণতার অন্যতম প্রধান কারণ হিসাবে সমাজতাত্ত্বিকরা বলছেন, শিক্ষিতদের একটা বড় অংশের মধ্যে নীতি-নৈতিকতা-মূল্যবোধ ও বিবেকবুদ্ধির অভাব এবং ভোগবাদ মারাত্মক হারে বাড়ছে। এই নীতিহীন অস্তিত্ব রক্ষার যুদ্ধের ফলে একদিকে আর্থিক অপরাধ, কর্পোরেট জালিয়াতি, সাইবার ক্রাইম (যেমন, অন্যের এটিএম কার্ডের পাসওয়ার্ড চুরি করা) ইত্যাদি হু-হু করে বাড়ছে। তথাকথিত শিক্ষিত লোকেরাই এগুলি করছে। অন্যদিকে দৈনন্দিন জীবনে, কর্মক্ষেত্রে পারস্পরিক রেষারেষি, সম্পর্কের মধ্যে কুৎসিত প্রতিযোগিতা ইত্যাদিও বাড়ছে। এই অসুস্থ পরিবেশ-পরিস্থিতিতে লাগাতার ব্যর্থতা হতাশা বিশ্বাসঘাতকতার কবল থেকে কোনও মতে পালিয়ে বাঁচার জন্য শিক্ষিত সমাজের বড় অংশের মধ্যে পৈশাচিক উল্লাসের প্রতিও আকর্ষণ বাড়ছে। আনন্দ উপভোগ বা অবসর বিনোদনের নামে তারা যেসব পন্থা অবলম্বন করছে তাতে মনে হয় যেন প্রকারান্তরে নিজেদের মানব অস্তিত্বকেই ধিক্কার জানাতে চায় তারা। মারাত্মক নেশাসক্তি, বিকৃত যৌনতার দাসত্ব ইত্যাদি তাদের অক্টোপাসের মতো আঁকড়ে ধরেছে।

শুধু কি তাই? ধর্ম-বর্ণ-জাতি-উপজাতিতে আজও শতছিন্ন ভারতবর্ষের সমাজ। এখনও শাসকশ্রেণির অতি অল্প উস্কানিতেই সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত সাপ ছোবল মেরে শেষ করে দেয় সাধারণ জনজীবনকে। এই অপরাধপ্রবণ সমাজকে সুস্থ করার, এক মানবদেহের মতো দাঁড় করাবার আকাঙক্ষায়, শাস্ত্রীয় অন্ধতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে, সকল সাধারণ মানুষের জন্য আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা চেয়েছিলেন বিদ্যাসাগর। সেই শিক্ষাব্যবস্থার দ্বারা কুসংস্কারমুক্ত মানবতাবাদী মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন তিনি। বিদ্যাসাগর বলেছিলেন, ‘‘ভারতবর্ষীয় সর্বসাধারণ লোক বিদ্যানুশীলনের ফলভোগী না হইলে তাহাদিগের চিত্তক্ষেত্র হইতে চিরপ্ররূঢ় কুসংস্কারের সমূলে উন্মূলন হইবে না।” বিদ্যাসাগর এও চেয়েছিলেন যে, শিক্ষাব্যবস্থাকে অবশ্যই হতে হবে ধর্মনিরপেক্ষ। তিনি লিখেছিলেন, ‘‘শিক্ষার্থীদের ধর্মের ব্যাপারে প্রত্যক্ষ বা অপ্রত্যক্ষ ভাবে কোনও অনধিকার চর্চা করা শিক্ষকদের পক্ষে বিশেষভাবে নিষিদ্ধ।” দেশের মানুষের মধ্যে বিজ্ঞানমনস্কতা প্রসারের জন্য ‘কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স’ প্রতিষ্ঠান গড়ার জন্য বিদ্যাসাগর অর্থ সহ আরও নানাভাবে সাহায্য করেছিলেন।

এই ইতিহাস, এই অভিজ্ঞতা আমাদের সামনে আছে। কিন্তু তাকে গুরুত্ব না দিয়ে, বরং ইচ্ছাকৃতভাবে এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। বর্তমান ভারতের স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মীয় অনুষ্ঠান ইত্যাদি নিয়মিত হয় শুধু না, এমনকি সিলেবাসের মাধ্যমেও নানা ভাবে ধর্মীয় ধ্যান-ধারণা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছড়ানো হয়। এর ফলে, আধুনিক মন, যুক্তিনিষ্ঠ মন গড়ে ওঠার প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে। মানুষ কেবল পোশাকে আধুনিক সাজছে, কিন্তু মন-মানসিকতার দিকে থেকে সে পড়ে আছে মান্ধাতা আমলের অন্ধতা, কুসংস্কারে। এ কারণেই তাদের অনেককে শাসকশ্রেণি মানবতার বিরুদ্ধে সশস্ত্র পাশবিক শক্তি হিসাবে ব্যবহার করতে পারছে।

বিদ্যাসাগর চেয়েছিলেন ধর্মতন্ত্র সহ সমস্ত সামাজিক অবদমনকে উচ্ছেদ করে ভারতের নারীশক্তির উত্থান। উনিশ শতকে মহিলাদের জন্য শিক্ষাবিস্তারের ক্ষেত্রে গোটা দেশকে পথ দেখিয়েছিলেন তিনি। তাঁর পরিচর্যায় প্রাণ-পাওয়া বেথুন স্কুল এবং কলেজ লালন করেছে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, কল্পনা দত্ত, বীণা দাস প্রমুখের মতো শেকলছেঁড়া ব্যক্তিত্বের। অথচ, সেই ভারতের সাধারণ নারীসমাজ আজ চরম বিপন্ন, নিরাপত্তাহীন। প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে সর্বত্র তাঁদের উপর চলছে অকথ্য অত্যাচার। আবার, তাঁদের মধ্যে একাংশ তথাকথিত শিক্ষিত নারী ‘ব্যক্তি স্বাধীনতা’র নামে মারাত্মক বিভ্রান্তির শিকার। মুনাফাখোর ব্যবসায়ীরা নির্লজ্জভাবে তাঁদের বাজারের পণ্যে পরিণত করছে। এই ভারতকে দেখলে বিদ্যাসাগর কতটা যন্ত্রণা পেতেন, আমরা ক’জন তা উপলব্ধি করতে পারি?

ফলে, শুধু মহাপুরুষ হিসাবে অনুষ্ঠান নয়। বিদ্যাসাগর যে অর্থে ভারতে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার রূপকার ছিলেন, তা উপলব্ধি করা দরকার। যে অর্থে তিনি পার্থিব মানবতাবাদী মূল্যবোধের ধারক ছিলেন, তা আয়ত্ত করার চেষ্টা করা দরকার। জীবনে সামাজিক প্রয়োজনীয়তাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছিলেন তিনি। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সুখস্বাচ্ছন্দ্য ভোগ করতে চাইলে, সহজেই তা পারতেন। কিন্তু আত্মমর্যাদাহীন সেই পথে তিনি কখনও যাননি। শতবার আহত হয়েও সমাজের উদ্দেশে কাজ করে যাওয়ার কথা ভুলতে পারেননি। এই চরিত্র থেকে শিক্ষা নেওয়া দরকার। না হলে, অনেক অনুষ্ঠান হলেও দেশের জনজীবনের সার্বিক দুরবস্থা দূর হবে না। বিদ্যাসাগরের কাঙিক্ষত সমাজ, যথার্থ শিক্ষিত সুস্থ সুন্দর সমাজ আমরা কোনও দিন পাব না। (চলবে)

(গণদাবী : ৭২ বর্ষ ৩১ সংখ্যা)