৯ আগস্ট ‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস’ পালিত হল অল ইন্ডিয়া জন অধিকার সুরক্ষা কমিটির উদ্যোগে। পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ওড়িশা, ছত্তিশগড়, কর্ণাটক, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাট, অন্ধ্রপ্রদেশ, ত্রিপুরা প্রভৃতি রাজ্যে এই উপলক্ষে নানা অনুষ্ঠান হয়। আদিবাসী ও গরিব মানুষের কাছে দিনটি জমিদার, মহাজন, ঠিকাদার ও পুলিশ প্রশাসন এবং তাদের রক্ষক ঔপনিবেশিক শাসকদের বিরুদ্ধে বা দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবিদ্বেষী শাসকদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ লড়াইয়ের বিশ্বজোড়া স্বীকৃতির দিন। আমাদের দেশে চূয়াড় বিদ্রোহ (১৭৬৯-৭০), সিধো-কানহুর নেতৃত্বে ‘হুল'(১৮৫৫-৫৬), বিরসা মুণ্ডার নেতৃত্বে ‘উলগুলান'(১৮৯৫-১৯০০) প্রভৃতি জমিদার, মহাজন, পুলিশ প্রশাসন এবং তাদের রক্ষক ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই হয়েছিল। অল ইন্ডিয়া জন অধিকার সুরক্ষা কমিটি এই দিনটিকে শোষণমুক্তির আন্দোলন গড়ে তোলার শপথ গ্রহণের দিন হিসাবে পালন করে আসছে।
রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ সভার স্বীকৃতির ভিত্তিতে ১৯৯৫ সাল থেকে ৯ আগস্ট দিনটি আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস হিসাবে পালিত হয়। দেশে দেশে আদিবাসী সহ ধর্মীয়, ভাষাভিত্তিক ও নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষার বিষয় মানবাধিকার সনদে উঠে আসে। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৫৭-র আইএলও’র অধিবেশনে সুনিদিষ্টভাবে আদিবাসীদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক সমস্ত দিক থেকে রাষ্টে্রর মূল স্রোতের সাথে সামঞ্জস্য রেখে চলার ক্ষমতা অর্জনে সহায়তা করার জন্য কিছু প্রস্তাব গৃহীত হয়। তারা অর্থনৈতিক, সামাজিক দিক থেকে সক্ষমতা অর্জনের আগে পর্যন্ত ওই ব্যক্তি বা জনগোষ্ঠীর কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ভাষা, সহ অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও অধিকার রাষ্ট্রকে সুনিশ্চিত করতে হবে। এরই ধারাবাহিকতাতে বিভিন্ন দেশের আদিবাসী ও গরিব মানুষদের অধিকার রক্ষার আন্দোলনের বিশ্বজোড়া সমর্থনে রাষ্ট্রসংঘে আদিবাসীদের অধিকার রক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক ঘোষণাপত্র সংকলিত ও গৃহীত হয়। বিশ্বের সকল দেশ এই ঘোষণাপত্রে এখনও স্বাক্ষর করেনি। এখনও দেশে দেশে আদিবাসী ও গরিব মানুষের অধিকার পদদলিত হচ্ছে।
ভারতেও আদিবাসীদের জন্য রাষ্ট্রসংঘ দ্বারা ঘোষিত অধিকারগুলি প্রায়শই লঙ্ঘিত হচ্ছে তার মধ্যে অন্যতম জঙ্গলে প্রবেশের অধিকার। দীর্ঘ আন্দোলনের ফলে ২০০৬ সালে জঙ্গলের অধিকার আইন-২০০৬ তৈরি ও চালু হলেও তা সঠিকভাবে কার্যকর না করেই জঙ্গল সংলগ্ন বা জঙ্গলে বসবাসকারী আদিবাসী ও গরিব বনবাসীদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে। তাদের রুটি-রুজির একমাত্র সম্বল জঙ্গল বলে স্বীকৃত জমিতে চাষবাস করা ও জঙ্গল থেকে ফল, মূল, শাক, পাতা, মধু প্রভৃতি সংগ্রহ করা। সেই অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। এর ফলে লক্ষ লক্ষ আদিবাসী ও গরিব বনবাসী পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত বা উচ্ছেদ হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে বনদপ্তর ইতিমধ্যে এই সব জমি থেকে আদিবাসী ও গরিব মানুষগুলিকে উচ্ছেদদ করা শুরু করেছে। তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে উঠছে। অল ইন্ডিয়া জন অধিকার সুরক্ষা কমিটি এই আন্দোলনে সামিল হয়েছে। যদিও জঙ্গলের অধিকার আইন-২০০৬-কে সঠিকভাবে কার্যকর করার মধ্য দিয়ে সমস্ত আদিবাসী ও বনবাসীকে পুনর্বাসিত করার জন্য জমির পাট্টা সহ আইনানুগ সমস্ত অধিকার দিতে হবে এই দাবিতে দীর্ঘদিন ধরেই কমিটির আহ্বানে আন্দোলন চলছে। এ বছর ৩০ মার্চ দিল্লি অভিযান ও রাষ্ট্রপতির কাছে ডেপুটেশন ও স্মারকলিপি দেওয়ার কর্মসূচি নেওয়া হয়েছিল যা করোনা লকডাউনের জন্য স্থগিত করতে হয়। তবে দাবিগুলি নিয়ে পঞ্চায়েত স্তর থেকে রাজ্য স্তর পর্যন্ত ডেপুটেশন ও স্মারকলিপি দেওয়ার কর্মসূচি নেওয়া হয়। এই আন্দোলনের মধ্যেই কমিটির আহ্বানে ৯ জুন বিরসা মুন্ডার শহিদ দিবস এবং ৩০ জুন থেকে ৭ জুলাই হুল বার্ষিকী পালিত হয়। আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উপলক্ষে এই অধিকার রক্ষার আন্দোলনের অঙ্গ হিসাবে রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি দেওয়ার কর্মসূচি ঘোষণা করা হয় এবং এখনও বিভিন্ন জায়গাতে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসের অনুষ্ঠান হচ্ছে। সাথে সাথে স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযানও চলছে। নিম্নলিখিত দাবি সংবলিত স্মারকলিপি রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হবে।
১) সমস্ত গরিব ও পরিযায়ী শ্রমিক ও গরিব আদিবাসী, জঙ্গলের আদিবাসী ও গরিব মানুষদের সারা মাসের কাজ নিশ্চিত করতে হবে, ২) সকল গরিব মানুষকে আউশ ধান, ভুট্টা, সহ অল্প সময়ের ফসলের বীজ, সার সহ সকল প্রকার কৃষিসামগ্রী বিনামূল্যে সরবরাহ করতে হবে। এ ছাড়াও প্রধান ফসলের চাষ যাতে সকল গরিব মানুষ করতে পারে তার জন্য সমস্ত ব্যবস্থা সরকারকে করতে হবে, ৩) জঙ্গল সংলগ্ন আদিবাসী ও চিরাচরিত বনবাসী মানুষ যাতে জঙ্গলে তাদের জীবিকার উপযোগী মাইনর ফরেস্ট প্রোডাক্ট (এমএফপি) সংগ্রহ করতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে। ৪) আদিবাসী ও চিরাচরিত বনবাসীদের দ্বারা অধিকৃত জঙ্গলের জমির পাট্টা, সামুদায়িক জঙ্গলের অধিকার এবং জঙ্গলে প্রবেশের অধিকারের জন্য সমস্ত আবেদনকারী এবং আবেদনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত আদিবাসী ও চিরাচরিত বনবাসীদের জীবন-জীবিকা সুনিশ্চিত করতে অধিকৃত জঙ্গলের জমির পাট্টা, সামুদায়িক জঙ্গলের অধিকার এবং জঙ্গলে প্রবেশের অধিকার সংক্রান্ত আবেদন গ্রহণ ও স্বীকৃতি প্রদান ধারাবাহিকভাবে করতে হবে, ৫) আদিবাসী ও বনাঞ্চলে বসবাসকারী মানুষদের কোনও ভাবেই বসবাসের এলাকা থেকে উচ্ছেদ করা যাবে না, ৬) রাজ্যের জমি রক্ষা সংক্রান্ত আইনগুলি এবং ছোটনাগপুর টেন্যান্সি অ্যাক্ট ও সাঁওতাল পরগণা টেন্যান্সি অ্যাক্ট সংশোধন করে আদিবাসী ও গরিব মানুষদের জমির অধিকার কেড়ে নেওয়া চলবে না, ৭) আদিবাসীদের কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও ভাষার বিকাশ ঘটাতে হবে এবং আদিবাসীদের এবং গরিব পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীগুলির আর্থিক ও বৌদ্ধিক বিকাশের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় স্তর পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষা ও ভরণপোষণের ব্যয়ভার সরকারকে গ্রহণ করতে হবে, ৮) তফসিলী জাতি ও উপজাতি নাগরিকদের সামাজিক মর্যাদাকে সুরক্ষিত করতে হবে, ৯) আদিবাসী ও গরিব মানুষের জন্য প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত স্বাস্থ্য পরিষেবার উপযুক্ত ব্যবস্থা সরকারকে করতে হবে, ১০) পশ্চিমবঙ্গে তফসিলী জাতি ও উপজাতি আইডেন্টিফিকেশন অ্যাক্ট বাতিল করে আদিবাসী ও তফসিলী জাতির পরিচয়পত্র প্রদানের প্রক্রিয়া সহজ করতে হবে।