কেন্দ্রীয় সরকারের শ্রমিক স্বার্থ বিরোধী আইন ও নীতি প্রত্যাহার, বিলগ্নিকরণ বন্ধ করা, মূল্যবৃদ্ধি রোধ, বেকারদের কাজ, ৮ ঘন্টা শ্রম দিবস, ন্যূনতম মজুরি ১৮ হাজার টাকা, সমকাজে সমমজুরি, সকল শ্রমিকের পেনশন ও সামাজিক সুরক্ষা সহ ১২ দফা দাবিতে এ আই ইউ টি ইউ সি সহ ১০টি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন ও স্বতন্ত্র জাতীয় ফেডারেশন সমূহের যৌথ মঞ্চ এই ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে৷
কেন্দ্রের ধূর্ত বিজেপি সরকার ‘শ্রমেব জয়তে’ বা শ্রমের বিজয় ধ্বনি তুলে শ্রমিকদের দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত অধিকার হরণ করার পরিকল্পনা নিয়েছে৷ শ্রম আইনকে সংশোধন করে ৪টি কোডে (মজুরি, শিল্প সম্পর্ক, সামাজিক সুরক্ষা এবং স্বাস্থ্য–নিরাপত্তা ও কাজের পরিবেশ) যুক্ত করা হবে৷ আইনগুলিকে এমন ভাবে পাল্টানো হচ্ছে– যাতে নতুন করে শ্রমিক ইউনিয়ন রেজিস্ট্রেশন অসম্ভব হয়ে পড়ে৷ শ্রমিক আন্দোলনের একটি শক্তিশালী হাতিয়ার ধর্মঘট৷ তাকেও বেআইনি ঘোষণা করার পরিকল্পনা করা হয়েছে৷ পি এফ, পেনশন, ই এস আই স্কিম পরিবর্তন করা হচ্ছে৷ রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রগুলোতে বেসরকারিকরণ ও বিলগ্নিকরণ ব্যাপকভাবে করা হচ্ছে৷ বিদ্যুৎ, কয়লা খনি, বিমা, বন্দর সহ বহু ক্ষেত্রেই তা কার্যকর করা হচ্ছে৷ কেন্দ্রীয় সরকার ফিক্সড টার্ম এমপ্লয়মেন্ট আইন এনে স্থায়ী কাজে স্থায়ী চাকরির রীতিকে বিসর্জন দিচ্ছে৷ যে কোনও কাজের জন্যই অল্প সময়ের চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক নিয়োগ করছে সরকার ও মালিকরা৷ বর্তমানে তারা হায়ার অ্যান্ড ফায়ার নীতিতে চলছে৷ প্রয়োজনে কাজে নাও, প্রয়োজন ফুরালে বিদায় দাও৷ এরূপ শ্রমিকদের প্রায় কোনওরূপ সামাজিক সুরক্ষাও থাকছে না৷ বাস্তব অবস্থা এমন করা হচ্ছে যাতে তাঁরা প্রতিবাদ করতে, কোনও ইউনিয়ন করতে না পারেন৷ তাঁদের আধুনিক যুগের দাস শ্রমিকে পরিণত করা হচ্ছে৷ অঙ্গনওয়াড়ি, আশা, মিড–ডে মিল কর্মী সহ স্কিম কর্মীদের জন্য বাজেটে টাকা কমানো হচ্ছে৷ জিএসটি চালু করে শ্রমিকদের কল্যাণমূলক প্রকল্পের জন্য সেস তোলা বন্ধ করা হয়েছে৷ ফলে বিড়ি শ্রমিক সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে শ্রমিক কল্যাণমূলক প্রকল্প সঙ্কটের মধ্যে পড়েছে৷ নোট বাতিলের জন্য ২ লক্ষ ৩৪ হাজার ক্ষুদ্র শিল্প বন্ধ হয়েছে৷ সংগঠিত ক্ষেত্রে প্রায় ১৭ লক্ষ এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রে প্রায় ৭০ লক্ষ শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন৷ হকারদের জীবন–জীবিকা রক্ষার কোনও ব্যবস্থা করছে না সরকার৷ সকল শ্রমজীবী মানুষের উপরই ভয়াবহ আক্রমণ নেমে আসছে৷
শুধু শ্রমিকদের ক্ষেত্রেই নয়, বিজেপি সরকার কৃষক–বর্গাদার–খেতমজুরদের স্বার্থ দু’পায়ে মাড়িয়ে কৃষিজমি অধিগ্রহণ অর্ডিন্যান্স এনেছে, যা বৃহৎ পুঁজিপতি, জমি মাফিয়া ও প্রোমোটারদের স্বার্থ রক্ষা করছে৷ অন্যদিকে সুকৌশলে শ্রমিকদের মধ্যে বিভেদ আনার জন্য পিছিয়ে পড়া নানা চিন্তা খুঁচিয়ে তুলছে এবং সাম্প্রদায়িক বিভেদ আনছে যা ঐক্যবদ্ধ শ্রমিক আন্দোলনের সামনে বাধা হিসাবে কাজ করছে৷
আমাদের দেশের শতকরা ৯৫ জন মানুষ শ্রমিক ও কৃষক৷ এই শ্রমিকদের ৯৪ শতাংশ অসংগঠিত শিল্পের শ্রমিক– যার বেশির ভাগই নূ্যনতম মজুরি থেকেও বঞ্চিত৷ শুধু বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য কিনতেই এঁদের পকেট ফাঁকা৷ অন্য পণ্য কেনার ক্ষমতাই এঁদের নেই৷ ৬ শতাংশ সংগঠিত শিল্পের শ্রমিকদেরও উৎপাদিত পণ্যের মজুরির অংশ দিনের পর দিন কমছে৷ এভাবে মজুরদের শ্রম লুঠ করার ফলে বাড়ছে মালিকের লাভের পরিমাণ৷ সর্বত্র শ্রমিকের প্রকৃত মজুরি কমছে৷ এর ফলে শ্রমিকদের ক্রয় ক্ষমতা কমে যাচ্ছে৷ গ্রামীণ কৃষক ও খেতমজুরদের অবস্থা আরও ভয়াবহ৷ উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে ফসল বিক্রি করতে কৃষক বাধ্য হচ্ছে৷ ফলে বেশিরভাগ কৃষকের শিল্পপণ্য কেনার ক্ষমতা নেই৷ এই অবস্থায় বাজারসংকট নিরসনের কোনও রাস্তা নেই৷ বর্তমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থা যতদিন থাকবে ততদিন শিল্পের অবাধ বিকাশের কোনও সম্ভাবনা নেই৷
১৯৯১সালে কংগ্রেসের অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের আমলে নয়া আর্থিক নীতি গ্রহণের মধ্য দিয়ে বেসরকারিকরণ ও উদারিকরণের সিংহদুয়ার খুলে দেওয়া হয়৷ এই নীতি অনুসরণ করে একের পর এক শ্রমিকস্বার্থ বিরোধী নতুন আইন ও কর্মসূচি নিয়ে আসে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন পরের পর সব সরকারগুলি৷ স্বাধীনতার ৭০ বছরে ভোটের দ্বারা বহুবার সরকার পরিবর্তন হলেও মালিক শ্রেণির এই শোষণ অত্যাচার বন্ধ হয়নি৷ এভাবে হয় না৷ শোষণ–বঞ্চনা বন্ধ করতে হলে এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে শ্রমিক আন্দোলন তীব্রতর করা জরুরি৷
এই শ্রমিক আন্দোলন তীব্র করতে হলে শুধু কনভেনশন, মিছিল–সমাবেশ নয়– প্রয়োজন অবরোধ, আইন অমান্য, ধর্মঘট সহ বিভিন্ন প্রতিরোধমূলক কর্মসূচি এবং এর মধ্য দিয়ে শ্রমিকদের চেনানো– কারা এদের শোষণ করছে, কীভাবে করছে, কোন কোন রাজনৈতিক দল এই শোষণের পক্ষের শক্তি৷ উপলব্ধি করানো দরকার মালিকী ব্যবস্থা উচ্ছেদ করলে শ্রমিক শৃঙ্খল ছাড়া অন্য কিছু হারাবে না৷ কিন্তু জয় করবে গোটা দুনিয়া৷ এক কথায়, লেনিন যাকে বলেছেন, শ্রমিক আন্দোলন হল কমিউনিজমের বিদ্যাপীঠ– সেই লক্ষ্যেই শ্রমিক আন্দোলন পরিচালনা করতে হবে৷ এই চেতনারই আজ ভীষণ অভাব৷ এজন্য কারখানায় কারখানায় শ্রমিক কমিটি গড়ে তুলে মতবাদিক সংগ্রাম চালাতে হবে৷ ধর্মঘটের কথা শুনলেই মালিক শ্রেণি ও তাদের তল্পিবাহকরা চিৎকার করে ওঠে৷ বলে– ‘ধর্মঘট কর্মনাশা’৷ ধর্মঘটের জন্যই দেশের শিল্প–কারখানা বন্ধ হচ্ছে ও উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে বলে তারা মিথ্যা প্রচার করে৷ অথচ শ্রমদপ্তরের তথ্যানুযায়ী ২০১৩ সালে শ্রমিকদের ধর্মঘটের ফলে কোনও শ্রম দিবস নষ্ট হয়নি৷ কিন্তু মালিকদের করা লক আউটের ফলে শ্রম দিবস নষ্ট হয়েছে ১ কোটি ৫০ লক্ষ ৩০ হাজার৷ বাস্তবে শ্রমিকরা কখনওই উৎপাদন ব্যাহত করতে চায় না৷ কারণ কারখানা চালু থাকলে শ্রমিকরা কাজ ও মজুরি পাবে৷ বাধ্য না হলে শ্রমিক কখনও ধর্মঘটে যায় না৷ বাস্তবে মালিকরা তীব্র শোষণ ও বঞ্চনার মধ্য দিয়ে শ্রমিকদের ধর্মঘটের পথে ঠেলে দেয়৷
এ আই ইউ টি ইউ সি দল মত নির্বিশেষে সমস্ত শ্রমজীবী জনগণের কাছে আগামী ৮–৯ জানুয়ারি সারা ভারত সাধারণ ধর্মঘট সফল করার আহ্বান জানিয়েছে৷