রাজ্যের ৮২০৭টি স্কুলে ছাত্রছাত্রী কমে যাওয়ার ভয়াবহ চিত্র শিক্ষা দপ্তর থেকে প্রকাশিত হয়েছে। তাকে কেন্দ্র করে সরকার স্কুলগুলি বন্ধ করে দেওয়ার যে ফরমান জারি করতে চলেছে তাতে পশ্চিমবঙ্গের ছাত্র শিক্ষক অভিভাবক সহ সমস্ত শিক্ষাপ্রেমী মানুষ খুবই উদ্বিগ্ন। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৩০ জনের কম ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে চলছে এমন স্কুল রাজ্যের গ্রাম-শহর সর্বত্র রয়েছে। প্রতিটি জেলায় ২-৩ জন ছাত্রছাত্রী নিয়ে চলছে এমন স্কুলের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। এই রিপোর্টের দায়িত্ব রাজ্য সরকারের শিক্ষা দপ্তর সরাসরি স্বীকার না করলেও এটা যে সরকারি উদ্যোগেই তৈরি এবং হঠাৎ এই তথ্য প্রচারের আলোতে নিয়ে আসার পেছনেও যে সরকারি উদ্দেশ্যই আছে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। এই চিত্র যতই বাস্তব হোক, যে সময়ে ও যে কায়দায় তা তুলে ধরার চেষ্টা হয়েছে তা দুরভিসন্ধিমূলক। এই তথ্য তুলে ধরার মধ্য দিয়ে সুকৌশলে এই বিপুল সংখ্যক স্কুল বন্ধ করে দেওয়া, পরবর্তী সময়ে এর পরিকাঠামো বেসরকারি মালিকের হাতে তুলে দেওয়ার পক্ষে জনসাধারণের অনুমোদন আদায় করা ও শিক্ষক নিয়োগের দাবিকে অপ্রাসঙ্গিক করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র লক্ষ করা যাচ্ছে।
তা যদি না হত, সরকারি স্কুলগুলোর এ হেন পরিস্থিতির দায় সরকার কোনও ভাবেই এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করত না। জনসাধারণের অনুদান ও করের টাকায় গড়ে ওঠা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি বন্ধ করার চক্রান্ত না করে, এর যথাযথ কারণ বিশ্লেষণ করে পরিকাঠামোগত উন্নয়ন ঘটানোর কথা ভাবত। ছাত্রছাত্রী সংখ্যা কমে যাওয়ার ঘটনাকে শিক্ষার বেসরকারিকরণের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করত না। ধরি মাছ না ছুঁই পানি কায়দায় শিক্ষামন্ত্রী পরস্পরবিরোধী কথা বলতেন না। তিনি এক দিকে বলেছেন এই তালিকা নিয়ে তাঁর কোনও ধারণাই নেই, আবার বলেছেন, ‘কী করা হবে সে বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। আমরা সমীক্ষার ফলাফল মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে তুলে দেব। তারপর এই ধরনের স্কুল নিয়ে পরবর্তী ধাপের সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
সরকারি স্কুলে ছাত্রসংখ্যা কমে যাওয়ার ঘটনা কি আকস্মিক? মোটেও নয়। এই ক্ষয় শুরু হয়েছে কয়েক দশক আগে থেকেই। পূর্বতন সিপিএম সরকারের সময়েও সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রী সংখ্যা কমে যাওয়ার হার ছিল উদ্বেগজনক। বর্তমান তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের আমলে তা ভয়ঙ্কর পরিণতিতে পৌঁছেছে। এই ঘটনা রুখতে কোনও সরকারেরই কি কোনও সদর্থক ভূমিকা ছিল, নাকি একের পর এক সরকারগুলিই এই জমি প্রস্তুত হতে দিয়েছে?
১৯৭৯ সালে যে-দিন সিপিএম সরকার ছাত্রছাত্রীদের স্কুলছুট কমানোর অজুহাতে প্রাথমিকে ইংরেজি ভাষা ও পাশফেল পদ্ধতি তুলে দিয়েছিল সেদিনই স্কুল শিক্ষার সর্বনাশের শুরু হয়ে গিয়েছিল। এই সময় থেকেই সরকারি শিক্ষা কাঠামো এক ধাক্কায় এতটাই দুর্বল হয়ে পড়ে যে, সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থার উপর চূড়ান্ত অনাস্থা তৈরি হয়ে যায়। দ্রুত গজিয়ে উঠতে থাকে বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুল। প্রথমে মধ্যবিত্ত অংশ পরে এমনকি নিম্নবিত্তরাও তাঁদের সাধ্যের বাইরে গিয়ে বেসরকারি স্কুল শিক্ষার দিকে ঝুঁকেছে। ফলেযত সময় এগিয়েছে ততই বেসরকারি শিক্ষা বিশাল বাণিজ্যের রূপ নিয়েছে।
সরকারি স্কুল শিক্ষা ব্যবস্থার যে এমন পরিণতি ঘটবে, এ কথা কি সরকারের নেতা-মন্ত্রীদের অজানা ছিল? নাকি এর ভয়ঙ্কর পরিণামের কথা কেউ তাঁদের বলেনি? অন্তত দল হিসাবে এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট), ছাত্র সংগঠন এআইডিএসও, পরবর্তী সময়ে শিক্ষা সংকোচন বিরোধী স্বাধিকার রক্ষা কমিটি, সেভ এডুকেশন কমিটির মাধ্যমে বাংলার প্রথিতযশা বরেণ্য শিক্ষাবিদরা লাগাতার এই বিষয়ে সরকারগুলিকে সাবধান করে এসেছে। শিক্ষানীতির সর্বনাশা দিকগুলি নিয়ে তাঁরা সরব হয়েছেন, আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। শিক্ষা প্রসারের তথাকথিত পদক্ষেপের সর্ষের মধ্যে সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দেওয়ার ভূতকে সেদিন তাঁরা পশ্চিমবঙ্গবাসীকে চেনাতে নানা ভাবে চেষ্টা করেছিলেন। তৎকালীন সিপিএম সরকার সে-সব কথায় কান দেয়নি। সরকারি শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে একের পর এক সর্বনাশা পদক্ষেপ নিয়েছে। দেশের শিক্ষাবিদ, শিক্ষানুরাগী বিদ্বজ্জন কিংবা জনসাধারণ, কারও মতামতের তোয়াক্কা করেনি। উপরন্তু সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনে বারবার নির্মম আক্রমণ চালিয়েছে।
তৃণমূল সরকার সেই সর্বনাশের গতি অব্যাহত রেখেছে, কংগ্রেস সরকারের তৈরি ‘শিক্ষার অধিকার আইন-২০০৯’এর মাধ্যমে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাশফেল তুলে দিয়ে সরকারি স্কুল শিক্ষাকে দ্রুতগতিতে ধবংসের দিকে নিয়ে গেছে। সম্প্রতি কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের জাতীয় শিক্ষানীতি-২০২০-র সুপারিশ অনুযায়ী কার্যত মাধ্যমিক পরীক্ষাকেও তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। স্বভাবতই একদিকে পাশফেলহীন সরকারি স্কুলের শিক্ষা ব্যবস্থার মান তলানিতে ঠেকেছে, অন্য দিকে গড়ে উঠেছে অসংখ্য বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
এই পরিস্থিতিতে সরকারের স্কুলছুট কমানোর পরিকল্পনা হয়ে দাঁড়িয়েছে সরকারি স্কুলই তুলে দেওয়া। ঠিকই তো, স্কুল না থাকলে আর স্কুলছুট থাকে কী করে!
কিন্তু ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাঙ্গনে আসার হারের এই করুণ চিত্র কেন? পরপর দুটি শিক্ষাবর্ষে মাধ্যমিক পরীক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষায় পরীক্ষার্থীর সংখ্যা এমন বিপুল সংখ্যায় কমে গেল কেন? গত বছরের তুলনায় এ বছর মাধ্যমিকে ৪ লক্ষ পরীক্ষার্থী কম হল কেন? এর প্রধান কারণ, কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের একের পর এক শুধু ভ্রান্ত নয়, ষড়যন্ত্রমূলক শিক্ষানীতির পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক সরকারি স্কুলের আর্থিক দায়ভার ক্রমাগত অস্বীকার করা। স্কুল কর্তৃপক্ষকেই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে অর্থ সংস্থানের। খাতায় কলমে সরকারি ফি যা-ই নির্ধারিত থাকুক, প্রত্যেক বছর তা বেড়েছে ব্যাপক হারে। সাধারণ দরিদ্র পরিবারের ছাত্রছাত্রীদের পক্ষে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া সাধ্যের অতীত হয়ে পড়েছে। কোভিড পরিস্থিতিতে এই চিত্র আরও ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। সাধারণ পরিবারগুলোর রোজগারের পথ যখন কার্যত বন্ধ, তখনও সরকারগুলি শিক্ষার ফি মকুব করার কথা ভাবতে পারেনি।
একদিকে ছাত্রছাত্রীদের অর্থনৈতিক সঙ্কট, শিক্ষার মানের পরিকল্পিত অবনমন, তার সাথে যুক্ত হয়েছে অভূতপূর্ব শিক্ষক সঙ্কট। রাজ্যের একটি জেলা পুরুলিয়ায় স্থায়ী শিক্ষকের বাস্তব চিত্রের নমুনা দেখলে বোঝা যাবে রাজ্যের অবস্থা কতটা করুণ। জেলার বুড়দা হাইস্কুলে ছাত্রছাত্রী সংখ্যা ১৬৭০, শিক্ষক ৭ জন। বাগমুন্ডি গার্লস হাইস্কুলে ছাত্রী সংখ্যা ১১০০, শিক্ষক ২ জন। বীরগ্রাম হাইস্কুলে ছাত্রছাত্রী সংখ্যা ১৯০০, শিক্ষক ২ জন। সুইসা হাইস্কুলে ছাত্রছাত্রী সংখ্যা ২০০০, শিক্ষক ১০ জন। বাগমুন্ডি হাইস্কুলে ছাত্রছাত্রী ২৮০০, শিক্ষক ৫ জন। কুচিয়া হাইস্কুলে ছাত্রছাত্রী সংখ্যা ১৩০০, বিজ্ঞানের শিক্ষক নেই। কুটনি জুনিয়র হাইস্কুলে কোনও শিক্ষক নেই। ঝাপড়া হাইস্কুলে ছাত্রছাত্রী সংখ্যা ১৭৮৫, উচ্চ মাধ্যমিক পড়ানোর শিক্ষক নেই। শুধু গ্রামাঞ্চল নয়, জেলা শহর, মহকুমা শহরের স্কুলগুলিরও অবস্থা তথৈবচ। পুরুলিয়া চিত্তরঞ্জন গার্লস হাইস্কুলে বিজ্ঞান বিভাগে পড়ানোর শিক্ষক নেই। রঘুনাথপুর গার্লস হাইস্কুলে এবং জিডি ল্যাঙ হাইস্কুলে উচ্চ মাধ্যমিক পড়ানোর প্রয়োজনীয় শিক্ষক নেই।
শিক্ষক সঙ্কটের এই চিত্র ও শিক্ষক নিয়োগে চূড়ান্ত দুর্নীতিকে আড়াল করতে, সমস্ত শূন্য পদে শিক্ষক নিয়োগের দাবিকে অপ্রাসঙ্গিক করে তুলতে রুগ্ন স্কুলগুলিতে অতিরিক্ত শিক্ষকের গল্প বারবার আওড়াচ্ছে সরকার। কিন্তু শিক্ষক নিয়োগের বাস্তব অবস্থা কী? সরকারের ভাবখানা এমন যেন রুগ্ন স্কুলগুলির তথাকথিত অতিরিক্ত শিক্ষক সংখ্যা রাজ্যের সমস্ত শূন্য পদেরও অতিরিক্ত! বাস্তবে সমস্ত শূন্য পদের তুলনায় এই সংখ্যা অতি নগণ্য। অথচ তা কৌশলে এমন ভাবে প্রচারে আনা হচ্ছে যাতে নিয়োগের দাবিকে জনমানসে দুর্বল করে দেওয়া যায়, নিয়োগ দুর্নীতির প্রতি জনগণের ঘৃণা থেকে খানিকটা পরিত্রাণ মেলে। চূড়ান্ত শিক্ষক সঙ্কট স্কুলগুলিকে ছাত্রছাত্রীশূন্য করেছে, আর তা হতে দিয়ে আজ ছাত্রশূন্য স্কুলগুলিতে শিক্ষক অতিরিক্ত দেখিয়ে সেই স্কুলগুলিকে বন্ধ করে দেওয়ার কথা বলা অপরাধের সামিল নয় কি?
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি, যার বেশির ভাগই গড়ে উঠেছে শিক্ষাব্রতী জনগণের জমি দান, অনুদান, জনগণের স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে, আশঙ্কা– ছাত্রসংখ্যা কম থাকার অজুহাতে এই সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকেই পিপিপি মডেলের আওতায় এনে দেশি-বিদেশি মালিকদের হাতে তুলে দেবে সরকার। রমরমিয়ে চলবে শিক্ষা ব্যবসা। যার সাথে দেশের গরিব-নিম্নবিত্ত পরিবারের ছাত্রছাত্রীদের কোনও সম্পর্ক থাকবে না। এই প্রক্রিয়ায় একটু একটু করে চলে যাবে সাধারণ পরিবারের ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষার সুযোগ, তার শিক্ষার অধিকার। আরও প্রশস্ত হবে শিক্ষার বেসরকারিকরণের পথ। অন্য দিকে বঞ্চিত হবে শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখা লক্ষ লক্ষ মেধাবী যুবক। মানুষ প্রশ্ন তুলছে, এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠাগুলি, যেগুলি আসলে জনগণের সম্পত্তি, সেগুলিকে এ ভাবে বেসরকারি মালিকদের ব্যবসার জন্য তুলে দেওয়ার অধিকার সরকারকে কে দিয়েছে? জনগণ তো মন্ত্রীদের এই জন্য ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেননি যে ক্ষমতায় গিয়ে তাঁদেরই সম্পত্তি সরকার এ ভাবে পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দেবে, তাঁদের সন্তানদের থেকে শিক্ষার সুযোগ কেড়ে নেবে! জনগণের সঙ্গে প্রতারণা, বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া এ আর কী?
কৌশলে সরকার একটা কথা জনগণের মধ্যে গ্রহণযোগ্য করার খুব চেষ্টা করছে– কম ছাত্রছাত্রী আছে এমন স্কুলে অতিরিক্ত শিক্ষকদের বসিয়ে বসিয়ে বেতন দেওয়ার দরকার কী? জনগণের টাকার অপচয় করে লাভ কী? এই স্কুলগুলি বন্ধ করে দেওয়া, অথবা কয়েকটিকে একসাথে মিলিয়ে দেওয়াই শ্রেয়। অর্থাৎ জাতীয় শিক্ষানীতি-২০-র ‘ক্লোজার অ্যান্ড মার্জার’ নীতির পক্ষে মনন তৈরি করারই চেষ্টা চালাচ্ছে সরকার। অথচ এই প্রসঙ্গে একটি গণতান্ত্রিক সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি কী হওয়া উচিত? তাদের উচিত ছিল, শিক্ষাবিদ, বিশেষজ্ঞ, শিক্ষক-ছাত্র-অভিভাবকদের সংগঠনগুলির মতামতের ভিত্তিতে স্কুলছুট হওয়ার কারণগুলিকে যথাযথ ভাবে নির্ণয় করে সেগুলিকে দূর করা এবং সরকারি নানা প্রকল্পের মধ্যে দিয়ে স্কুলছুটদের পুনরায় স্কুলে ফিরিয়ে আনা। স্কুলছুটের বিপুল সংখ্যা দেখিয়ে স্কুল তুলে দেওয়া কোনও দায়িত্বশীল সরকারের কাজ নয়, বরং তা সরকারের অপদার্থতার পরিচয়। অবশ্য যদি তা কোনও গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ না হয়।
কেন্দ্র ও রাজ্য নির্বিশেষে সরকারগুলি যে শিক্ষার পিছনে খরচ কমিয়েই চলেছে তার জনস্বার্থ বিরোধী চরিত্র উন্মোচন করে বহু দিন আগেই এ দেশের মনীষীরা সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘হতভাগা আমরা পুলিশ ও ফৌজ বিভাগের ভুরিভোজের ভুক্তশেষ রাজস্বের উচ্ছিষ্টের নামে বিদ্যার ঠাট বজায় রাখছি ফাঁকা মাল মসলায়। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু বলেছিলেন, ‘শিক্ষার ব্যবস্থা করতে বললেই সরকার বলে, টাকার অভাব অথচ তাদের অন্য কোনও কাজে টাকার কখনও অভাব ঘটে না। পুলিশের জন্য অজস্র টাকার ব্যয় তাদের কাছে কিছুই না। কেন না পুলিশ না হলে বর্তমান শাসন পদ্ধতি চলবে না। কাজেই এ বিষয়ে খরচ করতে সরকার মুক্তহস্ত।’ ভোটসর্বস্ব ক্ষমতালিপ্সার রাজনীতির স্বার্থে লাদাখে একটি ভোট সংগ্রহের জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ করে একটি ভোটকেন্দ্র চালু রাখা যায়, সেখানে হেলিকপ্টারে ভোটকর্মী পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা হতে পারে, তা নিয়ে গণতন্তে্রর স্তুতিগান হতে পারে কিন্তু এই দেশে ৩০ জন ছাত্রছাত্রীর জন্য শিক্ষক বহাল রাখা অতিরিক্ত এবং লোকসানের বিষয় মনে হয়। ভোটের স্বার্থে দান খয়রাতের জনমোহিনী প্রকল্পে খরচ এবং কাটমানির আমদানি অব্যাহত থাকলেও স্কুল পরিচালনায় সরকারের বড়ই লোকসান হয়!
কেন্দ্রীয় সরকারের জাতীয় শিক্ষানীতি ও তার অনুসারী রাজ্য সরকারের শিক্ষানীতি শিক্ষা-বাণিজ্যে যে জোয়ার এনেছে তার সুফল ভোগ করছে পুঁজিপতিরা। ২০১৬ সাল থেকে বার্ষিক ৩০ শতাংশ হারে বাড়তে থাকা স্কুলের ব্যবসা নয়া নীতির দৌলতে এক লাফে পঞ্চাশ শতাংশ বৃদ্ধির মুখ দেখবে বলেও মনে করেছে বণিক মহল। অন্য দিকে সরকারি শিক্ষার প্রতি চূড়ান্ত অনাস্থা মুনাফা এনে দিচ্ছে কোচিং ব্যবসায়ীদের ঘরে। বাইজুস, টিউটোপিয়ার মতো সংস্থাগুলি বিরাট পরিমাণ লাভ ঘরে তুলছে।
শিক্ষার এই সার্বিক সর্বনাশের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক ভাবে রাস্তায় আছে এআইডিএসও। ‘সরকারি শিক্ষা বাঁচাও, জাতীয় শিক্ষানীতি-২০ প্রতিরোধ কর’ ে¦¡াগান তুলে দেশব্যাপী এক কোটি স্বাক্ষর সংগ্রহ, এক লক্ষ ছাত্রছাত্রী কমিটি গঠন, পঁচিশ লক্ষ স্বেচ্ছাসেবক সংগ্রহের কর্মসূচির মাধ্যমে ছাত্রসমাজ ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে সামিল হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় রাজ্যে ৮২০৭টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ নয়, অবিলম্বে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির পরিকাঠামো উন্নত করে, স্বচ্ছভাবে শিক্ষক নিয়োগ করে, ছাত্রছাত্রীদের স্কুলমুখী করা ও জাতীয় শিক্ষানীতি-২০২০ বাতিলের দাবিতে এআইডিএসও-র পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি ১০ মার্চ সারা বাংলা ছাত্র ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে। সংগঠনের রাজ্য সম্পাদক বিশ্বজিৎ রায় সংগ্রামী ছাত্রসমাজের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন– ‘চিরতরে স্কুল বন্ধ রুখতে একদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বয়কট করো’। শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী সমাজ, শিক্ষাপ্রেমী অভিভাবকদের কাছে সাধারণ মানুষের শিক্ষা বাঁচানোর এই সংগ্রামে পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান রেখেছেন তিনি।