গত ২৬ নভেম্বর সংবিধান দিবসের ভাষণে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, ভারতের বেশিরভাগ মানুষ অধিকারের কথা বলে, অধিকার দাবি করে সময় নষ্ট করে থাকে। তাঁর আরও আক্ষেপ, অধিকার চাইতে গিয়ে তারা দায়িত্ব ভুলে যাচ্ছে, ফলে দেশ দুর্বল হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী অবশ্য বলতে ভুলে গেছেন, কোন অধিকারটি পেয়ে কোটি কোটি ভারতবাসী সুখে-শান্তিতে জীবন নির্বাহ করছেন? খেয়ে-পরে ঠিকভাবে বেঁচে থাকার অধিকার, বেকারদের কাজ পাওয়ার অধিকার, চাষিদের ফসলের ন্যায্য দামের অধিকার, শ্রমিকের ন্যায্যমজুরির অধিকার, সকলের জন্য স্বাস্থ্য এবং শিক্ষার অধিকার, শিশুদের পুষ্টি ও অবাধ বিকাশের অধিকার, অবাধে মত প্রকাশের অধিকার, সরকারকে সমালোচনার অধিকার, প্রতিবাদের অধিকার, শোষিত-বঞ্চিত না হওয়ার অধিকার, বৈষম্যের শিকার না হওয়ার অধিকার, ধর্মবিশ্বাস-জাতপাতের জন্য নির্যাতিত না হওয়ার অধিকার–এর কোনগুলি সাধারণ ভারতবাসী পেয়েছে? আজও সব ভারতবাসী নাগালের মধ্যে পানীয় জলের অধিকারটাও কি পেয়েছে? প্রধানমন্ত্রী বলে দিলে ভাল করতেন, এর মধ্যে কোন অধিকারটি চাইলে সময় নষ্ট করা হয়!
অন্যদিকে, দায়িত্ব পালনের প্রশ্নই যদি ওঠে, তাহলে বলতে হবে, দায়িত্ব পালন করেনি কে? সরকার না জনগণ? দেশের খেটে খাওয়া মানুষ যাঁরা উদয়াস্ত হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে উৎপাদন ব্যবস্থাকে চালু রেখেছেন, তাঁরা কোন দায়িত্বটি পালন না করে হাত-পা গুটিয়ে বসে আছেন? আর দেশের সরকার জনগণকে সুখে রাখার জন্য কোন দায়িত্বটি পালন করেছে?
প্রধানমন্ত্রীর হঠাৎ জনগণকে দায়িত্ব স্মরণ করানোর দরকার পড়ছে কেন? ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে যাঁরা প্রাণ দিয়েছেন, রক্ত ঝরিয়েছেন, তাঁদের সকলের আকাঙ্খা ছিল স্বাধীন ভারতের মানুষ পাবেন সমস্ত দিক থেকে পূর্ণাঙ্গ মানুষ হওয়ার অধিকার। আশা ছিল ক্ষুধা, বেকারির হাত থেকে ভারতবাসী চিরতরে মুক্তি পাবে। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, ভগৎ সিংয়ের মতো বিপ্লবী যোদ্ধাদের স্বপ্ন ছিল, স্বাধীন ভারতের মানুষ পাবেন একটা শোষণমুক্ত সমাজ। স্বাধীনতার পর এই আকাঙ্খাকে একেবারে ঝেড়ে ফেলতে পারেননি। এই চেতনা এতটাই জাগ্রত ছিল যে ভারতীয় পুঁজিপতি শ্রেণির যে প্রতিনিধিরা ব্রিটিশের হাত থেকে শাসন ক্ষমতা দখল করেছিলেন তাঁরাও। জনগণের মৌলিক অধিকারের কথাকে সংবিধানে স্থান দিতে বাধ্য হয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু আদৌ কোনও অধিকারই জনগণের জোটেনি। যে সংসদীয় গণতন্ত্রের মহিমা কীর্তন শাসকরা করে থাকেন–তার দশা কী দাঁড়িয়েছে? ভোট দিয়ে নিজের প্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকারটাও কি খেটে খাওয়া মানুষের আছে?
কিন্তু স্বাধীনতার ৩০ বছর পেরনোর আগেই কংগ্রেস নেত্রী ইন্দিরা গান্ধী সংবিধান সংশোধন করে তাতে ঢোকালেন জনগণের অধিকারের কথার বদলে জনগণকেই শাসকদের জন্য দায়িত্ব পালন করে যেতে হবে মুখ বুজে। তিনি ১৯৭৬ সালে ৪২তম সংবিধান সংশোধনীর সাহায্যে সংবিধানে ঢুকিয়েছিলেন ১০টি ‘মৌলিক দায়িত্ব’। তাতে সরকারি সম্পত্তি রক্ষা থেকে শুরু করে, পরিবেশ রক্ষা, দেশের মুখ রক্ষা ইত্যাদির সব দায় চাপিয়ে দেওয়া হয় জনগণের ঘাড়ে। জনগণকে দিয়ে এই সব দায়িত্ব পালন করানোর অজুহাতে সরকার যে কোনও গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নেওয়ার রাস্তা করে নেয়। ২০০২ সালে বিজেপি প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীর সরকার ইন্দিরাজির উত্তরাধিকার বহন করে সংবিধানে একাদশতম কর্তব্য যোগ করে। যাতে রাষ্ট্রের বদলে পিতা-মাতার উপরই চাপানো হয়েছিল সন্তানদের শিক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব। এর ফল হল শিক্ষার দায়িত্ব আর সরকারের নয়।
শাসকরা কোন দায়িত্ব পালন করলেন?
স্বাধীনতার পর থেকে ভারতের বুর্জোয়া শাসকরা নিজেরা কোন দায়িত্ব পালন করেছে? তাদের ‘দায়িত্ব’ পালনে জনগণ দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হয়েছে, আর মুষ্টিমেয় ধনকুবেরদের সিন্দুকে ক্রমাগত জমা হয়েছে জনগণের ঘর থেকে লুন্ঠিত বিপুল সম্পদ। নরেন্দ্র মোদি বেশি ‘দায়িত্বশীল’, অতএব, তাঁর জমানায় এই লুঠের প্রক্রিয়া বেশি গতি নিয়েছে। সম্প্রতি করোনা মহামারীর মধ্যেই ৪১ জন নতুন ভারতীয় ধনকুবেরের সৃষ্টি হয়ে সংখ্যাটা দাঁড়িয়েছে ১৪৩। প্রথম ১০০ জন ধনকুবেরের মোট সম্পদ দ্বিগুণের বেশি বেড়ে হয়েছে ৫৭.৩ লক্ষ কোটি টাকা। মাত্র ৯৮ জন ধনকুবেরের হাতে যত সম্পদ আছে (৬৫ হাজার ৯০০ কোটি ডলার, এক ডলারের মূল্য প্রায় ৭৫ ভারতীয় টাকা) তা ৫৫ কোটি ৫০ লক্ষ ভারতবাসীর মোট সম্পদের সমান। প্রথম ১০ জন ধনকুবের যদি প্রতিদিন ৫ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা হিসাবে খরচ করতে থাকে তা হলে তাদের সম্পদ ফুরোতে সময় লাগবে ৮৪ বছর।
অন্য দিকে দেশের কোটি কোটি সাধারণ মানুষের প্রতি কেমন দায়িত্ব পালন করেছে সরকার? করোনা পরিস্থিতির মধ্যে ৪ কোটি ৬০ লক্ষ ভারতবাসী নতুন করে নেমে গেছে চরম দারিদ্রের অতলে (বিশ্বে নতুন দরিদ্র মানুষের অর্ধেক)। সরকারি হিসাবেই ২৩ কোটি ভারতীয় দারিদ্রসীমার নীচে বাস করে। করোনার আগেই বিশ্বের দারিদ্র বৃদ্ধিতে ৬০ শতাংশ অবদান রেখেছে নরেন্দ্র মোদি শাসিত ভারত। বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ১১৬টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১০১। প্রায় দেড় কোটি নারী শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন। মহিলারা আয় হারিয়েছেন ৫৯ লক্ষ কোটি টাকার বেশি। ২০২১ সালে ৮৪ শতাংশ ভারতীয় পরিবারের আয় মারাত্মকভাবে কমে গেছে। করোনার আগেই দেশের বেকারত্বের হার ৪৫ বছরের মধ্যে সর্বাধিক জায়গায় পৌঁছে গিয়েছিল। গত জানুয়ারি (২০২২) তে সেন্টার ফর মনিটারিং ইন্ডিয়া (সিএমআইই) সমীক্ষা জানাচ্ছে, কর্মক্ষম মানুষের মাত্র ৩৭.৬ শতাংশ কাজ পায়। নির্দিষ্ট বেতনের চাকরি থেকে ২.৫ কোটি কর্মী এক বছরে ছাঁটাই হয়েছেন। অসংগঠিত ঠিকা শ্রমিকদের দশা আরও শোচনীয়। ৬ কোটির বেশি কর্মহীন মানুষ কাজ খোঁজার চেষ্টাই ছেড়ে দিয়েছেন। মালিকদের ছাঁটাইয়ের অধিকার বেড়েছে, জনগণের বেড়েছে ক্ষুধার্ত থাকার অধিকার। পাঁচ বছরের নীচে শিশুদের ৩৬ শতাংশই চরম অপুষ্টির শিকার। সরকারি হিসাবেই কমপক্ষে ২০ কোটি ভারতীয় একবেলার বেশি খাবার জোগাড়ে অক্ষম। সরকার এদের জন্য কোনও দায়িত্ব অনুভব করেছে কি? অবশ্যই না। একইভাবে, করোনা মহামারিতে কত লোকের জীবন বিনা চিকিৎসায় শেষ হয়ে গেছে, কত পরিযায়ী শ্রমিক আচমকা লকডাউনে প্রাণ হারালেন, কত জনের কাজ করোনার অজুহাতে চলে গেল, কত লাশ গঙ্গায় ভাসল, এগুলির হিসাব রাখার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সরকার সময় নষ্ট করেনি। ধন্য প্রধানমন্ত্রী! এই না হলে দায়িত্ব পালন! যে পুঁজিপতি শ্রেণির সেবা করার দাসখত লিখে তখতে বসেছেন আপনারা, তাদের প্রতি দায়িত্ব পালনে এতটুকু ফাঁক নেই!
দেশটা আসলে কার
স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে ব্রিটিশের হাত থেকে ক্ষমতা এসেছে ভারতীয় জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণির হাতে। তাদের প্রতিনিধি হিসাবে তা গ্রহণ করেছিলেন কংগ্রেস নেতারা। দেশ বলতে, দেশের কল্যাণ বলতে তাঁরা যে বুর্জোয়া শ্রেণির কল্যাণই বোঝেন তা স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়েই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। যে কারণে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, ভগৎ সিং সহ আপসহীন ধারার বিপ্লবীরা ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়বার সময়ে বারবার এই সাবধান বাণী উচ্চারণ করেছেন যে, ব্রিটিশের বদলে দেশীয় বুর্জোয়া শ্রেণির শোষণ কায়েম তাঁদের লক্ষ্য নয়। তাঁরা স্বাধীন ভারতে শোষণমুক্ত সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার জন্য নতুন লড়াইয়ের কথাও বলেছেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়েও আপসহীন বিপ্লবী ধারা এবং কংগ্রেসের আপসমুখী বুর্জোয়া নেতৃত্বের মধ্যে লড়াই হয়েছে–ভগৎ সিং, নেতাজিরা স্পষ্টভাবে বলেছেন, এর মধ্যে আছে শ্রেণিসংগ্রাম। জনগণের স্বাধীনতার অকাঙ্খা আর বুর্জোয়াদের ব্রিটিশের বদলে নিজেদের শাসক হওয়ার আকাঙ্খা যে এক নয়, তা স্বাধীনতার পর আরও স্পষ্ট হয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে বুর্জোয়া শ্রেণির সেবাদাস হিসাবে যে দলই ক্ষমতায় বসেছে তারাই জনগণের অধিকার খর্ব করার জন্য একের পর এক পদক্ষেপ নিয়েছে। প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর আমলেই পাশ হয়েছে বিনা বিচারে আটক আইন। স্বাধীনতার পরেই ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সরকারের প্রবর্তিত রাজদ্রোহ বিরোধী আইনকে আরও শক্তপোক্ত করেছে স্বাধীন ভারতের সরকার। জনগণকে ভুলিয়ে রাখতে নেহরুজি কালোবাজারিদের ল্যাম্পপোস্টে ঝোলানোর স্লোগান দিয়েছিলেন। ইন্দিরা গান্ধী এসে স্লোগান দিয়েছিলেন, ‘গরিবি হটাও’। বলেছিলেন, ব্যাঙ্ক-খনি জাতীয়করণ করে ‘গণতান্ত্রিক সমাজবাদ’ প্রতিষ্ঠা করবেন। সেদিন বিশ্বের একটা বড় অংশে সমাজতান্ত্রিক শিবিরভুক্ত দেশগুলির জনগণের জীবনযাত্রার উচ্চমান, নাগরিক স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক অধিকার ভারতের জনগণকে আকর্ষণ করত। তাই বুর্জোয়া শাসকরা মানুষকে ধোঁকা দিতে সমাজতন্ত্রের নাম ব্যবহার করতে চেয়েছিল। যে কারণে এই সময় তাদেরও রাষ্টে্রর কিছুটা কল্যাণমূলক মুখ বা মুখোশ বজায় রাখতে হয়েছিল। যদিও যত দিন গেছে পুঁজিবাদের নিয়মেই সম্পদ ক্রমাগত মুষ্টিমেয় একচেটিয়া মালিকের হাতে বেশি বেশি করে কেন্দ্রীভূত হয়েছে, আর অধিকাংশ জনগণ সম্পদ হারিয়ে নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হয়েছে। পরিণামে পুঁজিবাদও পড়েছে চরম বাজার সংকটের আবর্তে। সংকট থেকে বাঁচতে তাদের বাড়াতে হয়েছে শোষণের তীব্রতা। একই সাথে রাষ্টে্রর কল্যাণমূলক মুখোশটা ক্রমাগত খসে যেতে থেকেছে। নাগরিকদের ন্যূনতম বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্বও ক্রমাগত বুর্জোয়া রাষ্ট্রের কর্ণধাররা ঝেড়ে ফেলতে চেয়েছেন। নাগরিকদের মধ্য থেকে এর বিরুদ্ধে যাতে কোনও প্রতিবাদ উঠে আসতে না পারে তার জন্য ১৯৭০ দশক থেকেই গণতন্ত্রের মুখোশটা ঝেড়ে ফেলে ভারতের বুর্জোয়া শাসকরা ক্রমাগত দমনের নখ-দাঁতকেই নাগরিকের প্রতি রাষ্টে্রর কর্তব্য পালনের পথ ঠাউরেছেন। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অনিরসনীয় সংকট তখনই যে জায়গায় পৌঁছে গিয়েছিল, তাতে একচেটিয়া মালিকদের মুনাফার সর্বোচ্চ হার ধরে রাখতে জনগণের উপর নির্মম শোষণ চালানো ছাড়া বিকল্প ছিল না। এ ক্ষেত্রে কোনও নিয়ম-নীতির বালাই আর শাসকরা রাখতে পারেনি।
১৯৯১-এর পর সমাজতান্ত্রিক শিবিরে ভাঙন ধরলে এই মুখোশের যতটুকু টিকে ছিল, তাও খসিয়ে ফেলতে শাসকদের আর কোনও দ্বিধা হয়নি। বিশ্বায়ন-উদারিকরণের ফর্মুলায় আর্থিক সংস্কারের নামে জনগণের টাকায় গড়ে তোলা সমস্ত রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও পরিকাঠামোকে সরাসরি দেশি-বিদেশি পুঁজিপতিদের হাতে বেচে দেওয়ার কাজ শুরু করেছিল তৎকালীন কংগ্রেস সরকার। জনগণকে শাসকরা শুনিয়েছে সমৃদ্ধির গালভরা গল্প, অন্যদিকে ক্রমাগত কেড়ে নিয়েছে অবাধে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পানীয় জল পাওয়ার অধিকার। সড়ক থেকে বিদ্যুৎ, পরিবহণ ইত্যাদি সমস্ত কিছু চলে গেছে বৃহৎ পুঁজি পরিচালিত কর্পোরেট কোম্পানির মালিকানায়। যত উন্নয়ন আর বিকাশের গল্প শুনিয়েছে শাসকরা, তত দূরে চলে গেছে জনগণের অধিকার। বিজেপি তথা নরেন্দ্র মোদি ২০১৪ সাল থেকে জনগণের বুকের উপর দিয়ে এই সংস্কারের ইঞ্জিন আরও বেশি জোরে চালিয়েছেন। অন্যদিকে জনগণকে শুনিয়ে চলেছেন, ‘বিকাশ’, উন্নয়নের কথা। কবে তা ধরা দেবে হতভাগ্য সাধারণ মানুষের কাছে? এ কথা তুললেই মোদিজি তাঁর গোল-পোস্টটাই ক্রমাগত সরিয়ে নিয়ে চলেন। প্রথমে শোনা গিয়েছিল তিনি সব কালো টাকা উদ্ধার করে ১৫ লক্ষ করে টাকা সব ভারতবাসীর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ঢেলে দেবেন। তারপর বলে চলেছেন, আসবে ‘আচ্ছে দিন’, হবে ‘স্বচ্ছ ভারত’, তারপর এল ‘সব কা সাথ সব কা বিকাশ’, এখন শোনা যাচ্ছে ‘আত্মনির্ভর ভারত’, ‘ডিজিটাল ভারত’, ‘ভোকাল ফর লোকাল’। অবশেষে ২০২২-২৩ অর্থবর্ষের বাজেটে নরেন্দ্র মোদিজির সরকার নাগরিকদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ‘অমৃতকাল’ অর্থাৎ স্বাধীনতার ৭৫ বছর থেকে শুরু করে তার শতবর্ষ– চাকরি না পেয়ে, একবেলা আধপেটা খেয়ে কিংবা মাঝে মাঝে না খেয়ে, এই ২৫টা বছর বাঁচতে পারলে জনগণ দেখবে সমৃদ্ধির জোয়ার! মুষ্টিমেয় পুঁজিমালিকের সমৃদ্ধির জোয়ারের জন্য কিন্তু অপেক্ষা করতে হয়নি! এ দেশের গণতান্ত্রিক সংসদীয় ব্যবস্থা তবে কার স্বার্থে রচিত? বুঝে নিতে অসুবিধা হয় কি?
নাগরিক অধিকার ছাড়াই গণতন্ত্র!
গণতান্ত্রিক বিপ্লবের যুগে বুর্জোয়ারাই নাগরিক অধিকার, রাষ্টে্রর গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলির আপাত স্বাধীনতা, স্বাধীন বিচারবিভাগের কথা তুলেছিল। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার চরম সংকটের যুগে একচেটিয়া সাম্রাজ্যবাদী পুঁজি নিয়ন্ত্রিত বুর্জোয়া রাষ্ট্রব্যবস্থার কর্ণধাররা বিচারবিভাগ সহ সমস্ত ক্ষেত্রকেই সরাসরি বুর্জোয়াদের আজ্ঞাবহ আমলাতন্তে্রর দাস করে তুলতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছে। এ যুগের বিশিষ্ট মার্কসবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষ দেখিয়েছেন, আজকের যুগে সমস্ত বুর্জোয়া রাষ্টে্রর মধ্যেই ফ্যাসিবাদী ঝোঁক দেখা যাচ্ছে। তিনি ফ্যাসিবাদের মূল তিনটি সাধারণ বৈশিষ্ট্যকে এ যুগের পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোর ক্ষেত্রে চিহ্নিত করেছিলেন– ১) বেশিরভাগ প্রতিযোগীকে প্রতিযোগিতার বাইরে ঠেলে দিয়ে মুষ্টিমেয় পুঁজিপতির হাতে অধিকাংশ সম্পদ জমা হওয়া। ২) একচেটিয়া মালিকগোষ্ঠীর সেবাদাস মুষ্টিমেয় রাজনীতিকের হাতে অধিকাংশ ক্ষমতা কুক্ষিগত হওয়া। সংসদীয় ব্যবস্থা, প্রশাসন, বিচারবিভাগকে একচেটিয়া পুঁজির আজ্ঞাবহে পরিণত করা। ৩) চিন্তায় আধ্যাত্মিকতা, অন্ধবিশ্বাস, কূপমণ্ডুকতার সাথে বিজ্ঞানের প্রযুক্তিগত জ্ঞানের মিশেল দেওয়ার মধ্য দিয়ে ছাঁচেঢালা সংস্কৃতির জন্ম দেওয়া।
ভারতের দিকে তাকালে দেখা যাবে ফ্যাসিবাদের প্রতিটি বৈশিষ্ট্যই এ দেশের গায়ে প্রকট। কংগ্রেস নেত্রী ইন্দিরা গান্ধী যেমন জরুরি অবস্থা জারি করেছিলেন, ‘কমিটেড জুডিশিয়ারি’ (সরকারের আজ্ঞাবহ বিচারবিভাগ) চেয়ে সরাসরি সওয়াল করেছিলেন। কংগ্রেসের আমলেই গায়ের জোরে ভোট লুঠ, আমলাতন্ত্রকে কাজে লাগিয়ে ভোটের ফলে নিখুঁত কারচুপি ইত্যাদি অধিকার হরণের প্রক্রিয়া শুরুই হয়েছিল। নরেন্দ্র মোদির আমলকে এর সাথে তুলনায় বলা যেতে পারে অঘোষিত জরুরি অবস্থার কাল। ২০১৪ থেকেই বিজেপি লোকসভায় একচ্ছত্র সংখ্যাগরিষ্ঠতা ভোগ করে আসছে। এমনিতেই সংসদে উভয় কক্ষেই সরকারি কিংবা বিরোধী আসন আলো করে যাঁরা ভারতীয় জনগণের প্রতিনিধি সেজে বসে আছেন, তাঁদের অধিকাংশই বহু-কোটিপতি। জনগণের দুঃখ দুর্দশার সাথে তাঁদের যোগ অতি ক্ষীণ। এর মধ্যেও যতটুকু হতে পারত, দেখা যায় জনজীবনের কোনও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে সংসদে আলোচনা হওয়াটাই এখন ব্যতিক্রমী ঘটনায় দাঁড়িয়েছে। সরকারের বিরুদ্ধে রায় দিলে তৎক্ষণাৎ বিচারপতিকে বদলি অথবা নানা অসুবিধার সম্মুখীন হতে হবে, আর সরকারের মর্জি অনুযায়ী চললে অবসর নিয়েই উচ্চপদ এমনকি মনোনীত সাংসদ পর্যন্ত হওয়া যাবে। এটাই আজ বিচারবিভাগের ‘স্বাভাবিক’ ঘটনা। বিশেষ কিছু শিল্পপতি গোষ্ঠীর সুবিধার্থে কাজ করার জন্য বিচারবিভাগকে চাপ দিয়েছে সরকার এ অভিযোগ খোদ সুপ্রিম কোর্টেই শোনা গেছে। এমনকি গুজরাট গণহত্যার জন্য বিজেপির শীর্ষ নেতাদের আদালতে অভিযুক্ত করেছিলেন যে বিচারক, তাঁর রহস্য মৃত্যু ঘটলেও কোনও তদন্ত হয়নি। উত্তরপ্রদেশের বিজেপি সরকার আন্দোলনকারীদের উপর কোটি কোটি টাকা জরিমানা চাপিয়েছে, সম্পত্তি বজয়াপ্ত করেছে। দিল্লি দাঙ্গায় যারা উস্কানি দিয়েছে, জেএনইউ কিংবা জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা করেছে তাদের একজনকেও শাস্তি না দিয়ে সরকার মিথ্যা মামলা দিয়েছে প্রতিবাদী ছাত্রদের উপর। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, দলিত কিংবা জনজাতিভুক্ত মানুষের উপর হিন্দুত্ববাদের চ্যাম্পিয়ান সংঘপরিবার নানা আক্রমণ চালিয়েছে। বিজেপির শীর্ষ নেতারা উত্তরপ্রদেশের ভোটে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে নানা বিষোদগার করছেন। সংঘ পরিবারের ঘনিষ্ঠ তথাকথিত ধর্মগুরুরা উত্তরাখণ্ডে দাঁড়িয়ে প্রকাশ্যে সংখ্যালঘুদের উপর হামলা করে গণহত্যার ডাক দিল, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় থেকে আসা ছাত্রীদের হিজাবের অজুহাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঢোকায় বাধা দেওয়া হচ্ছে– সরকারের মদতেই তো! কোন অধিকার জনগণকে দেওয়ার কথা বলছেন আপনি প্রধানমন্ত্রী?
কৃষি ব্যবস্থাকে একচেটিয়া মালিকদের হাতে পুরোপুরি তুলে দেওয়ার বিরুদ্ধে দেশের হাজার হাজার কৃষক একবছরের বেশি সময় ধরে ধর্না দিলেন দিল্লির উপকণ্ঠে। ৭০০ জনের বেশি কৃষক এই আন্দোলনে প্রাণ হারালেন, প্রধানমন্ত্রী এক বছরে একবার তাঁদের দাবি শোনার সময় করতে পারেন নি? বাঁচার দাবি তুলে খুব বেশি অধিকার চেয়েছিলেন কৃষকরা? কেন্দ্রীয় সরকার শ্রম আইন সংশোধন করে যে শ্রম কোড এনেছে তাতে শ্রমিকের চাকরির স্থায়ীত্বের অধিকার, ন্যায্য মজুরির অধিকার, কর্মক্ষেত্রে সুরক্ষার অধিকার, সামাজিক সুরক্ষার অধিকার সব কিছু কেড়ে নেওয়া হল। শ্রমিকরা এর প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছেন, ধর্মঘটও করেছেন। প্রধানমন্ত্রী– আপনি দেশকে বলুন, কোন বাড়তি অধিকার শ্রমিকরা চাইছেন?
প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব পালনের উপদেশ দিচ্ছেন! তিনি এবং তাঁর সরকার সহ স্বাধীনতার পর থেকে এদেশের রাষ্ট্রের সব কর্ণধাররাই জনগণের জন্য দায়িত্বপালনের যে বহর দেখিয়েছেন, তাতে জনগণের সামনে একটি কর্তব্যই বাকি থাকে। তা হল, সংঘবদ্ধ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে অধিকার আদায় করা। আর সবচেয়ে বড় যে কর্তব্যটি খেটে খাওয়া জনগণের সামনে আজ উপস্থিত– এই শোষণযন্ত্র-স্বরূপ বুর্জোয়া রাষ্ট্রব্যবস্থাটিকেই ভেঙে ফেলে নতুন শোষণহীন সমাজের পথে এগিয়ে যাওয়া।