খাদ্য–বস্ত্র–বাসস্থান হল মানুষের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক অধিকার৷ একটি শিশু জন্মানোর পরেই যেমন তার মুখে খাবার তুলে দিতে হয় তেমনই দিতে হয় বস্ত্র৷ একই সাথে প্রয়োজন হয় একটা নিশ্চিত আশ্রয়ের৷ ১৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী যখন বলেছিলেন ‘হর ঘর তিরঙ্গা’ তখন এ দেশের অসংখ্য মানুষ চারিদিকে তাকিয়ে দেখতে পাননি– তাঁর ঘরটা কোথায়।
যখন বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের বিজ্ঞাপনে সংবাদমাধ্যমের প্রথম পাতা ঢেকে যায়, ঠিক তখনই সারা বিশ্বে ১৬০ কোটি মানুষের দিনের শেষে মাথা গুঁজবার বাসস্থানটুকু পর্যন্ত নেই৷ আর আমাদের দেশ ভারতে? ঠিক কতজন গৃহহীন তার নির্দিষ্ট তথ্য সরকারের কাছে নেই৷ ২০১১ সালের জনগণনা অনুসারে কেন্দ্র বলছে, ভারতে ১৮ লক্ষ মানুষের ঘর নেই৷ আর পশ্চিমবঙ্গ সরকার দাবি করছে, গত দশ বছরে তারা রাজ্যের গৃহহীনদের জন্য ৪৫ লক্ষ ৮৭ হাজার ৭১৭ টি বাডি তৈরি করেছে এবং আগামী দু’বছরের মধ্যে আরো ৫০ লক্ষ বাডি তৈরি করা হবে (আবাপ১৭/০২/২২)৷ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের দেওয়া এই তথ্য সঠিক, বলাই যায়, এই রাজ্যে এখন ন্যূনতম গৃহহীন মানুষের সংখ্যা আধ কোটি৷ রাস্তায় পড়ে থাকা মানুষের সংখ্যার বিচারে দেশে এই রাজ্য দ্বিতীয়৷ তা হলে জনগণনা অনুসারে দেশে গৃহহীন মানুষের যে সংখ্যাটা সরকার দেখায় তার সঙ্গে বাস্তবের বিস্তর অমিল৷
এছাড়া সতেরো কোটি মানুষ ঘর বলতে যা বোঝান তা হল প্লাস্টিক, ছেঁডা ত্রিপল, কাঠকুটো, ভাঙা অ্যাসবেসটাস দিয়ে তৈরি ঝুপড়ি৷ এটাও সরকারি তথ্য, বাস্তবে সংখ্যাটা যে আরও অনেক বেশি তা বলার অপেক্ষা রাখে না৷ এ–ওয়ান শহর কলকাতায় ৩৩ শতাংশ মানুষ বস্তিবাসী৷ বস্তির সংখ্যায় মহারাষ্ট্র আর গুজরাটের পরেই পশ্চিমবঙ্গের স্থান৷ রাতে একদিন কেউ কলকাতা ভ্রমণ করলে ফুটপাতে পা রাখার জায়গা পাবেন না, সেখানে শুধু মানুষের সারি৷ পুঁজিবাদী ব্যবস্থার কল্যাণে দেশে বৈষম্য যত বাড়ছে ততই একদিকে বাড়ছে আধুনিক ইমারত শৈলী অপরদিকে বাড়ছে বস্তিবাসী ফুটপাতবাসীর সংখ্যা৷ রাস্তা কিংবা রেললাইনের ধারে, বড় বড় ইমারতের পাশে, খোলা আকাশের নিচে, রাজপথের আন্ডার পাস, ফ্লাইওভার, ব্রিজ, বাসস্ট্যান্ড, রেলস্টেশন, পার্ক, হাট–বাজার, শপিং মল, শহরের ফুটপাতে কোনওরকম থাকা৷ বৃষ্টি পড়লে কোনও বাডির কার্ণিসের তলায় মাথা গুঁজে রাত কাটানো, শীত পডলে কোনওরকমে গা গরম করে বেঁচে থাকা, না হয় ঠাণ্ডায় জমে মরে পডে থাকা, গরমের দুপুরে গাছের তলা না হলে কোথাও কোনও একটা খাঁজে একটু ছায়া খুঁজে নেওয়া৷ ছিন্নমূল, গৃহহীন এসব মানুষের করুণ দৃশ্য৷ দেশের নাগরিক হলেও এরা সংবিধান প্রদত্ত বাঁচার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত৷ এদের আশ্রয় নির্মাণ এবং সুযোগ–সুবিধার ব্যবস্থা করার জন্য সুপ্রিম কোর্ট, বিভিন্ন হাইকোর্ট পাতার পর পাতা খরচ করে নানা সময় নানা নির্দেশ দিয়েছে৷ সেই নির্দেশ পালনের দায় কারও নেই৷ তাই গৃহহীনদের অবস্থা যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই রয়ে গেছে৷ পুলিশ ও অপরাধীরা এদের তাড়িয়ে বেডায়৷ এদের ৫১ শতাংশকে গড়ে পাঁচবার পুলিশ উচ্ছেদ করে৷ এই মানুষদের আশি ভাগ রেশন পর্যন্ত পায় না৷ এরা সমাজের মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন৷ নানাভাবে শোষণের শিকার৷ গৃহহীনদের ৪৬ শতাংশের বয়স ৩৫ বছরের নিচে৷ তাদের যথাযথ জীবিকা নেই৷ শিক্ষালাভ বা পেশাগত যোগ্যতা বাড়ানোর কোনও সুযোগ তারা পায় না৷ বস্তিবাসীদের অনেকের কাছে বিশুদ্ধ পানীয় জল, শৌচাগার এখনও পৌঁছায়নি৷ আর নোটিফায়েড নয় এমন বস্তিবাসীদের জীবনযন্ত্রণা অবর্ণনীয়৷
এতদিন ধারণা ছিল শহরে গৃহহারাদের অধিকাংশই পরিযায়ী৷ একটি বেসরকারি সংস্থার সমীক্ষা বলছে এই ধারণা ভুল৷ শহরে প্রতি পাঁচ জন গৃহহীনের তিনজন জন্মেছেন সেখানেই৷ অর্থাৎ নিজের জন্মের শহরে সারা জীবন কাটিয়েও দরিদ্র প্রান্তবাসী এই মানুষদের মাথার উপর আচ্ছাদন জোটেনি৷ এরপর ঝুপড়ি বা তার চেয়ে ভালো বস্তিতে থাকা মানুষকে তাড়া করে সর্বদাই উচ্ছেদের আতঙ্ক৷ কেবল ২০১৮ সালে সরকারি হিসাব বলছে, সারা বছরে ২৯ লক্ষ মানুষকে উচ্ছেদ করা হয়েছে৷ কখনও রাস্তা, কখনও এয়ারপোর্টের নামে বা অন্য কিছু উন্নয়নের কথা বলে৷ ২০১৭–র সরকারি হিসাবে ৫৩ হাজার ৭০০ বাডি– ঝুপডি ভেঙে দেওয়া হয়েছে৷ মাথার উপর ছাদের যোগান দিতে পারুক বা না পারুক বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র বিকাশ আর উন্নয়নের স্লোগান তুলে মাটিতে গুঁড়িয়ে দেয় মানুষের মাথার উপর সামান্য ভাঙা ছাদও৷
‘রোটি কাপডা আউর মকান’ এই স্লোগান সেই ’৪৭ সাল থেকে দিচ্ছে দলগুলি৷ প্রতিটি নির্বাচনের আগে সব রাজত্বে, সব জমানায় গৃহহীনদের আবাসন এক জনমোহিনী স্লোগান৷ কিন্তু মাথার উপর ছাদের স্বপ্ন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ২০১৫–তে বলেছিলেন ২০২২ এর মধ্যে সবার মাথার উপর ছাদ হবে৷ সেই বাডিতে জল থাকবে, থাকবে বিদ্যুৎ ও শৌচালয়৷ বলেছিলেন, এইভাবে আমরা স্বাধীনতার ৭৫তম বর্ষপূর্তি উৎসব উদযাপন করব৷ এখন বলছেন ২০৪৫ সালে হবে৷ এরপর ২০৪৫ এ অন্য কেউ বলবেন ২০৬৫ তে হবে৷ এ ভাবেই পুঁজিবাদী ভারতে মানুষের মাথার উপর ছাদ, একটু ছোট্ট ঘরের স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়৷
কিন্তু এটাই কি সম্পূর্ণ ভারতের চিত্র, মোটেই তা নয়৷ আরও এক ভারত আছে যে প্রতিদিন ফুলে ফেঁপে উঠছে৷ এমনকি করোনা পরিস্থিতিতেও৷ বিশ্বব্যাঙ্কের সমীক্ষা বলছে কোভিড কালে ভারতে ধনীরা আরও ধনী হয়েছে, গরিবরা আরও গরিব৷ সেই ধনী ভারতের ছবিটা এক্ষেত্রে ঠিক কেমন একটু দেখে নেওয়া যাক৷ ভারতের মতো একটা দেশে যেখানে কোটি কোটি মানুষের বাডি হল একটা তামাশা, সেই দেশেই মুম্বাইয়ের পেডার রোডের একটা বাডি যার নাম অ্যান্টিলা, তৈরির খরচ ১৫ হাজার কোটি টাকা৷ সেই বাডিতে একটা হেলিপ্যাড আছে৷ ৫০ জন বসে দেখার মতো সিনেমা হল আছে৷ ১৬৮টি গাডি রাখার গ্যারেজ আছে, আর আছে অসংখ্য ঘর৷ এ ছাড়াও বড় বড় শিল্পপতি, ফিল্ম স্টার, নামী ক্রিকেটারদের কারও বাড়ি ৭৫০ কোটি টাকার কেউ বা সাড়ে চারশো কোটি থেকে দুশো কোটি টাকার বাড়িতে বাস করেন৷ কোনও কোনও নামকরা রাজনৈতিক নেতার বিশাল তথাকথিত ‘কুটির’ দেখেও মাথা ঘুরে যাওয়ার কথা এদেশের মানুষের জানা আছে৷ এ রকম অনেক আছে শত শত কোটি টাকার বাডি এবং তা হল দেশের এক শতাংশ মানুষের৷ এদের গৃহপালিতদেরও আলাদা ঘর আছে৷ সেই ঘরের সঙ্গে অন্য ভারতের মানুষের ঘরের তুলনাও করা যাবে না৷ ছেঁডাফাটা জামাকাপড় সহ অল্প যা কিছু সম্বল আঁকড়ে নিয়ে নিরুদ্দেশের পথে অন্তহীন পথ চলা সেই অসহায় মানুষগুলি পথের বাঁকে হঠাৎ কোনও জনসভায় শোনে কোনও নেতা বা নেত্রী বলছেন তার ঘরের কথা, স্বপ্ন দেখাচ্ছেন মাথার উপর ছাদের৷ পেটে ভাত নাই থাক, চাকরি নাই জুটুক সেই মিথ্যা স্বপ্নকে সফল করার ভাবনায় সে আবার ছুটবে ভোটকেন্দ্রের দিকে৷
এইভাবেই দিন আসবে দিন যাবে স্বপ্ন স্বপ্নই থাকবে৷ এইসব অপূরিত স্বপ্ন নিয়ে আলোচনা না করে আসুন আমরা বরং প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর ছাড়া চিতাদের নিয়ে আলোচনা করি৷ রিমঝিম বৃষ্টিকে মাথায় নিয়ে শারদ উৎসবের কত ভিড় হল এর হিসাবে যখন উচ্ছ্বসিত টিভির অ্যাঙ্কররা ঠিক সেই সময় সেলিম আর তার বউ নুরজাহান মেয়েকে কোলে নিয়ে একটা বাড়ির কার্নিশের নিচে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি থেকে বাঁচার চেষ্টা করছিল, ক্যামেরা ওদের দেখে না৷ সন্ধ্যায় পূজার মণ্ডপে দাঁড়িয়ে লেজার শো নিয়ে তরজা চলছে, বাজছে ‘সারে জাঁহা সে আচ্ছা হিন্দুস্তান হামারা’, শো দেখাচ্ছে এ দেশ এখন অমৃত কালের পথে৷ তখন তার থেকে কিছুটা দূরে কোলে মার্কেটের কাছে কল্যাণ আর তার স্ত্রী মিনতি একটা বড় প্লাস্টিকের নিচে তাদের দুই সন্তানকে নিয়ে ভাবছে ফুটফুটে দুই অমৃতের পুত্রকে তারা বৃষ্টি থেকে বাঁচাবে কী করে?