আর্থিক সংকট, ঋণ, ছাঁটাই, কর্মহীনতায় জর্জরিত দেশের মানুষকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় বসে প্রতিশ্রুতি বিলিয়েছিলেন, বছরে ২ কোটি বেকারের চাকরি হবে৷ চাকরি হওয়া দূরের কথা, বেকারি পৌঁছেছে সর্বোচ্চ হারে৷
একটি সমীক্ষায় জানা গেছে, ২০১১–১২ থেকে ২০১৭–১৮, এই ৬ বছরে ভারতে চাকরির সংখ্যা কমেছে অন্তত ৯০ লক্ষ৷ কর্মহীনতার এমন অধোগতি স্বাধীন ভারতে এই প্রথম৷ ২০১১–১২ সালে দেশে চাকরির সংখ্যা ছিল ৪৭ কোটি ৪০ লক্ষ৷ ২০১৭–১৮ সালে তা কমে হয়েছে ৪৬ কোটি ৫০ লক্ষ৷ কৃষি ক্ষেত্রে কাজ কমেছে সর্বাধিক হারে৷ অবস্থা আরও খারাপ অসংগঠিত ক্ষেত্রে৷ সেখানে নোট বাতিল ও জিএসটি চালুর পর বন্ধ হয়েছে বহু ব্যবসা৷ কাজ চলে গিয়েছে অসংখ্য মানুষের৷ অল্পসংখ্যক যাঁরা কাজ পাচ্ছেন, তাঁদেরও অনেককে যোগ্যতার তুলনায় কম বেতনের কাজে ঢুকতে হচ্ছে৷ বহু ক্ষেত্রে শ্রম ক্ষমতার পুরোপুরি ব্যবহারও হচ্ছে না৷ অন্যদিকে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বেকারত্বের হার৷ এ বছরের অক্টোবরে ভারতে বেকারত্বের হার বেড়ে সাড়ে ৮.৫ শতাংশে পৌঁছেছে৷ সেপ্টেম্বরের (৭.২ শতাংশ) থেকে ১.৩ শতাংশ বেশি৷ মার্কিন সংস্থা ‘সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমি’ (সিএমআইই) ১ নভেম্বর তাদের প্রকাশিত রিপোর্টে এই উদ্বেগজনক তথ্য প্রকাশ করেছে৷
দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক সন্তোষ মেহরোত্রা ও পাঞ্জাবের সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির অধ্যাপক যযাতি কে পরিদা–র ওই গবেষণাপত্রটি ৩১ অক্টোবর প্রকাশিত হয়েছে৷ তাঁরা ন্যাশনাল স্যাম্পেল সার্ভে অর্গানাইজেশনের এমপ্লয়মেন্ট–আনএম সার্ভে এবং পিরিয়ডিক লেবার ফোর্স সার্ভের ভিত্তিতে এই রিপোর্টটি তৈরি করেন৷ জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের আর এক অধ্যাপক হিমাংশু আগেই বলেছিলেন, ২০১১–১২ থেকে ২০১৭–১৮ পর্যন্ত ভারতে প্রতি বছরে গড়ে ২৬ লক্ষ মানুষ চাকরি খুইয়েছেন৷
যদিও তা স্বীকার করতে চাইছে না কেন্দ্রের বিজেপি সরকার৷ এই তথ্য চাপা দিতে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পরিষদের তত্ত্বাবধানে আর একটি গবেষণার আয়োজন করা হয়েছিল কিছু দিন আগে৷ দু’ই অধ্যাপক লভীশ ভাণ্ডারি ও অমরেশ দুবে তাঁদের গবেষণাপত্রে দাবি করেছেন, গত ৬ বছরে ভারতে চাকরির সংখ্যা ৪৩ কোটি ৩০ লক্ষ থেকে বেড়ে ৪৫ কোটি ৭০ লক্ষে পৌঁছেছে৷
পরিসংখ্যান মন্ত্রকের বক্তব্য, নতুন পদ্ধতিতে কর্মসংস্থানের হার নির্ধারণ করা হয়েছে৷ তাই আগের হিসেবের সঙ্গে বেকারত্বের বর্তমান হারের তুলনা করা ঠিক নয়৷ নতুন পদ্ধতি সম্পর্কে অবশ্য খোলসা করে তারা কিছু বলেননি৷ যদিও কিছুদিন আগে তামিলনাড়ুতে কয়েকশো ক্লার্ক পদে চাকরির জন্য জমা পড়া লক্ষাধিক আবেদনপত্র সরকারের কর্মসংস্থান বাড়ার দাবিকে নস্যাৎ করে দিয়েছে৷ এর মধ্যে রয়েছেন ইঞ্জিনিয়ার, স্নাতকোত্তর, এমবিএ, পিএইচডি–ও৷
একদিকে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার তীব্র বাজার সংকট মেটা দূরে থাক গভীর হচ্ছে৷ অন্যদিকে নোট বাতিলের পর নগদের অভাবে ভারতে ছোট শিল্প ও পরিকাঠামো ক্ষেত্রে যে অচল অবস্থা শুরু হয়েছিল তা কেটে যাওয়ার বদলে সংকট উত্তরোত্তর বাড়ছে৷ তাতে বেকারত্বের হার বৃদ্ধি অনিবার্য৷ অর্থনীতির বিশেষজ্ঞরাই বলছেন এ কথা৷ তাহলে প্রধানমন্ত্রীর অঢেল চাকরির প্রতিশ্রুতি কেন? কারণ, তিনি ও তাঁর দল বিজেপি আর পাঁচটা বুর্জোয়া দলের মতো মনে করে, ক্ষমতার কুর্সি দখল করতে সাধারণ মানুষকে (অধিকাংশ ভোটদাতা) বোকা বানাতে হবে৷ তার জন্য মিথ্যা প্রতিশ্রুতির বন্যায় ভাসিয়ে দাও গোটা দেশকে৷ তারপর জিতে এসে একের পর এক শ্রমিক স্বার্থবিরোধী পদক্ষেপ নাও, মালিকদের সেবায় সরকারি কোষাগার উজাড় করে দাও ষোলো আনা, সাধারণ মানুষের দিকে কখনও–সখনও এক আনা ছুঁড়ে দাও– এভাবে পাঁচ বছর নিশ্চিন্তে কাটিয়ে দাও৷ আবার নির্বাচন এলে মুখে সাধারণ মানুষের প্রতি দরদ দেখিয়ে জনসভায় তাদের দুঃখে দু’ফোঁটা চোখের জল ফেলে, তাদের ভালো করার প্রতিশ্রুতি দাও আবার৷ এভাবে মানুষের অসহায় অবস্থাকে পুঁজি করে ভোটের বৈতরণী পার হয়ে যাও বছরের পর বছর৷ তাতে বেকার যুবকরা চাকরি পেল কি পেল না, কতজনের চাকরি চলে গেল, ছাঁটাই হল কত শ্রমিক– তা নিয়ে চিন্তা করার দরকার নেই৷