পাট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কৃষিজ দ্রব্য৷ দেশের প্রায় ৪০ লক্ষ কৃষক পরিবার তাদের রুটি–রুজির জন্য পাটের উপর নির্ভরশীল৷ পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ওড়িশা, আসাম, উত্তরপ্রদেশ ও ত্রিপুরায় প্রায় ৮ লক্ষ হেক্টর ( ১ হেক্টর = ২.৪৭ একর) কৃষিজমিতে পাট চাষ হয়৷ বিশ্বে মোট পাট উৎপাদনের ৬০ শতাংশই হয় ভারতে৷ আবার ভারতে যত পাট উৎপাদন হয় তার ৮০ শতাংশই হয় পশ্চিমবঙ্গে৷ এই হিসাবে বিশ্বের মোট পাট উৎপাদনের প্রায় ৫০ শতাংশই উৎপন্ন হয় পশ্চিমবঙ্গে৷ ফলে পশ্চিমবঙ্গের কৃষি অর্থনীতিতে পাটের গুরুত্ব বুঝতে অসুবিধা হয় না৷ ধানের পরে পাটই হল এ রাজ্যের প্রধান অর্থকরী ফসল৷ এই রাজ্যে পাটের উৎপাদনশীলতা সবচেয়ে বেশি, প্রতি হেক্টরে প্রায় ২৬১৯ কিগ্রা৷
পাট কৃত্রিম বা সিন্থেটিক তন্তুর মতো নয়৷ এ সহজেই মাটির সাথে মিশে যায়৷ মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করে৷ তাই পাট পরিবেশবান্ধব কৃষিজ দ্রব্য৷
রাজ্যের পাটচাষিদের ৬৫ শতাংশই প্রান্তিক চাষি আর ২৫ শতাংশ গরিব চাষি৷ বাকি ১০ শতাংশের অধিকাংশই মধ্য চাষি৷ ধনী চাষিদের সামান্য একটা অংশও পাট চাষ করেন৷ তবে এঁরা পাট ওঠার সময় গরিব চাষির পাট কিনে রেখে বাজারে দাম বৃদ্ধির পর বিক্রি করতেই বেশি উৎসাহী৷
গুণমান অনুযায়ী পাটকে ৮ ভাগে ভাগ করা হয় (টি ডি ১ থেকে টি ডি ৮)৷ পরিমাণের দিক থেকে টি ডি ৫–ই দেশের মোট পাট উৎপাদনের ৪০ শতাংশ৷ এই জন্য টি ডি ৫–কে ভিত্তি ধরেই সরকারি সহায়ক মূল্য নির্ধারিত হয়৷ ১৯৯০ দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে পশ্চিমবঙ্গে পাটচাষের এলাকা ক্রমাগত কমে যাচ্ছে৷ ২০০৬–’০৭ সাল থেকে ২০১৬–’১৭ সালের মধ্যে পাট চাষের জমি কমে গিয়েছে প্রায় ১৪.৫ শতাংশ৷ এই রকম একটা গুরুত্বপূর্ণ কৃষিজ পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে জমির পরিমাণ ক্রমাগত কমে যাচ্ছে কেন, কেন পাট চাষিরা পাট উৎপাদনে উৎসাহ হারিয়ে ফেলছে, তা বোঝার জন্য পাটচাষিদের সমস্যা খতিয়ে বোঝা দরকার৷
স্বাধীনতার ৭১ বছরে পাটের উপযুক্ত
বীজও দিতে পারেনি সরকার
পাটচাষিদের সমস্যা প্রধানত দুই ধরনের৷ এক, উৎপাদন সংক্রান্ত সমস্যা, দুই, বাজারে পাট বিক্রি করে লাভজনক দাম পাওয়ার সমস্যা৷ পাট চাষে কৃষকের প্রথম সমস্যা হল বীজের সমস্যা৷ সরকারি হিসাবে দেশে মোট উৎপন্ন পাট বীজের মাত্র ৩৫ শতাংশ সার্টিফায়েড বীজ৷ অর্থাৎ এই বীজের গুণমান পরীক্ষিত৷ কিন্তু এই বীজের বেশিরভাগটাই বিদেশে রপ্তানি হয়৷ সামান্য একটা অংশ পড়ে থাকে দেশের কৃষকদের জন্য৷ বোঝা যায়, দেশের পাটচাষিরা যে বীজ দিয়ে চাষ করে তার বেশিরভাগের গুণমানই পরীক্ষিত নয়৷ বীজ ছড়ানোর পর বহু ক্ষেত্রেই ঠিকমতো অঙ্কুরোদগম হয় না, গাছ জন্মায় না, ফলে উৎপাদন মার খায়৷
আর একটা সমস্যা প্রাথমিক মূলধনের সমস্যা৷ পশ্চিমবঙ্গের ৯০ শতাংশ কৃষকই গরিব–প্রান্তিক কৃষক৷ ব্যাঙ্ক এই সব কৃষকদের ঋণ দেয় না৷ বাধ্য হয়ে এরা ছুটে যায় মহাজনদের কাছে এবং উচ্চ সুদে টাকা ধার করতে বাধ্য হয় ( এই সুদের হার কখনও কখনও মাসে শতকরা ছয় থেকে দশ টাকা)৷
এছাড়াও রয়েছে বীজ, সার, কীটনাশক ইত্যাদির ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধির সমস্যা৷ আর রয়েছে পাট পচানোর জন্য উপযুক্ত জলাশয়ের অভাব৷ বদ্ধ জলায় পাট পচানোর ফলে পাটের গুণমান কমে যায় এবং কৃষকরা পাটের কম দাম পায়৷
লাভজনক দাম পাওয়ার ব্যবস্থা করতেও সরকার ব্যর্থ
পাটচাষিরা লাভজনক দাম কেন পায় না এ কথা বোঝার জন্য জানা দরকার এ রাজ্যে পাট বিক্রি হয় কী প্রক্রিয়ায়৷ পাট খাদ্যদ্রব্য নয়, তা সরাসরি সাধারণ মানুষ কেনে না৷ চটকলগুলো কাঁচা পাট কেনে এবং নানা ধরনের পাটজাত দ্রব্য তৈরি করে এদেশে ও বিদেশে বিক্রি করে৷ তারাই উৎপাদিত পাটের ৯৫ শতাংশ কেনে৷ চটকল মালিকেরা সামান্য কিছু পাট এজেন্ট নিয়োগ করে কেনে, কিন্তু বেশিরভাগ পাট তারা কেনে জুট বেলারস অ্যাসোসিয়েশনের কাছ থেকে৷
এই জুট বেলারস অ্যাসোসিয়েশন হল বিভিন্ন গঞ্জের আড়তদারদের সংগঠন৷ বাস্তবে এই সংগঠনে যাদের পুঁজির জোর অনেক বেশি তারাই হল মাথা৷ এরাই চটকল মালিকদের সংগঠন ইন্ডিয়ান জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সাথে দর কষাকষি করে৷ এই আড়তদারেরা আবার পাট কেনে গ্রামাঞ্চলের ফড়েদের কাছ থেকে৷ কিন্তু দাম ঠিক করে দেয় কে? দাম ঠিক করে মিল মালিকরা৷ ধরে নিন, কোনও এক বছরে মিল মালিক পাটের দর ধার্য করল কুইন্টাল প্রতি চার হাজার টাকা৷ তাহলে বড় আড়তদার কিছুটা লাভ রেখে দাম দেবে কুইন্টাল প্রতি ৩৫০০ টাকা৷ ছোট আড়তদার দেবে ৩০০০ টাকা, আর ফড়েরা দেবে আরও কম, ধরুন ২৭০০ টাকা৷ তা হলে দেখা যাচ্ছে, মিল মালিকরাই দাম নির্ধারণ করে এবং চাষিরা সেই নির্ধারিত দামও পায় না৷ ফলে সহজেই বোঝা যায় কেনাবেচার এই প্রক্রিয়া যদি চলতে থাকে তবে পাটচাষির লাভজনক দাম পাওয়ার কোনও সম্ভাবনাই নেই৷ এই অবস্থার অবসান হবে কীভাবে? এক্ষেত্রে যুক্তিসঙ্গত একটাই মাত্র উপায় অর্থাৎ সরকার সরাসরি চাষিদের কাছ থেকে পাট কিনবে এবং সেই পাট মিলমালিকদের কাছে বিক্রি করবে৷ এক্ষেত্রে ফড়ে–দালাল–আড়তদারর প্রবেশ একেবারে নিষিদ্ধ করতে হবে৷
কেন্দ্রীয় সরকার (কংগ্রেস বা বিজেপি যে দলেরই হোক না কেন) এই দায়িত্ব কখনও পালন করেনি৷ তারা জুট কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়া (জেসিআই) গঠন করেছিল৷ কিন্তু জেসিআই পাট কেনা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে৷ তথ্য বলছে, ২০০২–’০৩ সালে জেসিআই চাষিদের কাছ থেকে পাট কিনেছিল মোট উৎপাদনের ১৩.০৯ শতাংশ৷ কমতে কমতে ২০১৩–’১৪ সালে তা দাঁড়িয়েছে মাত্র ১.৬৯ শতাংশ৷
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ভূমিকা আরও খারাপ৷ এরা নিজেদের উদ্যোগে কোনও দিনই পাট কেনেনি৷ চাষিরা যাতে পাটের লাভজনক দাম পায় তার জন্য কোনও চেষ্টাও করেনি৷ তা সে সিপিএম সরকারই হোক বা বর্তমানের তৃণমূল সরকারই হোক৷ একসময় রাজ্য সরকার পরিচালিত বেনফেড সংস্থা জেসিআই–এর হয়ে কিছু কাঁচাপাট কিনত৷ বর্তমানে তাও বন্ধ৷ ফলে এই অবস্থায় অসহায় চাষিরা ফড়ে–দালাল–আড়তদা কাছে জলের দরে পাট বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়৷ ঋণগ্রস্ত চাষিরা জমি হারিয়ে খেতমজুরে পরিণত হয়৷ এই কারণেই রাজ্যের চাষিরা পাটচাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে৷ পাটচাষে জমির পরিমাণ ক্রমাগত কমে যাচ্ছে৷ এই অবস্থা থেকে পাটচাষিকে মুক্তি দেবার কাজটা কিন্তু কঠিন নয়, অসম্ভব তো নয়ই৷ দরকার কৃষকদরদি জনমুখী দৃষ্টিভঙ্গি৷
সরকারের পক্ষে কি সমস্ত কাঁচা পাট কিনে নেওয়া সম্ভব?
এই রাজ্যে প্রতি বছর ৮০ লক্ষ বেলের (১বেল = ১৮০ কেজি) কাছাকাছি পাট উৎপন্ন হয়৷ এর মধ্যে যদি সরকার (কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার মিলে) ৭০ লক্ষ বেল পাট কেনে তাহলে কত প্রাথমিক মূলধন দরকার হয়? ভারত সরকারের কমিশন অব এগ্রিকালচারাল কস্টস অ্যান্ড প্রাইস–এর হিসাব অনুযায়ী ২০১৪–’১৫ সালে এক কুইন্টাল কাঁচাপাটের উৎপাদন খরচ ছিল ১৮৯৫ টাকা৷ চার–পাঁচ বছর পর এই উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩৭০০ টাকার কাছাকাছি৷ চাষিকে যদি ৫০ শতাংশ লাভ দেওয়া হয় তবে সরকারকে এক কুইন্টাল পাট কিনতে হবে ৫৫৫০ টাকায়৷ তাহলে এক বেল পাটের দাম দাঁড়াবে দশ হাজার টাকার মত৷ সরকার যদি ৭০ লক্ষ বেল পাট চাষির কাছ থেকে কেনে তাহলে তার প্রাথমিক মূলধনের প্রয়োজন হবে সাত হাজার কোটি টাকা৷ সরকার এই পাট মিল মালিকদের বিক্রি করে সহজেই তার বিনিয়োগকৃত মূলধন তুলে নিতে পারে৷ অর্থাৎ বিষয়টা হল এইরকম, এই আয়োজনে সরকারের তহবিল থেকে খরচ নেই এক পয়সাও, অথচ পাট চাষের সাথে যুক্ত প্রায় এক কোটি মানুষ এতে ধনেপ্রাণে বেঁচে যাবে৷
সরকার না হয় চাষির কাছ থেকে পাট কিনল, কিন্তু মিল মালিকরা যে সেই পাট সরকারের কাছ থেকে কিনবে তার গ্যারান্টি কী? গ্যারান্টি আছে৷ প্রথমত, রাজ্যে যত পাট উৎপাদন হয় তা চটকলগুলো চালাবার জন্য যথেষ্ট নয় এবং এই কারণে ভারত সরকারকে বিদেশ থেকে (বিশেষ করে বাংলাদেশ থেকে) পাট আমদানি করতে হয়৷ দ্বিতীয়ত, সরকার যদি ৭০ লক্ষ বেল পাট চাষিদের কাছ থেকে কেনে তবে বাজারে খুব একটা পাট পড়ে থাকবে না যা নিয়ে মালিকরা চটকলগুলো চালাতে পারে৷ ফলে, ফড়ে–দালাল–আড়তদারদের পাট বাজারে ঢোকা নিষিদ্ধ করে সরকার যদি সমস্ত কাঁচা পাটের বিপণনকে হাতে তুলে নেয়, তাহলে মিল মালিকদের সরকারি বিপণন ব্যবস্থার মাধ্যমে পাট কেনা ছাড়া কোনও উপায় থাকবে না৷ একমাত্র এই পথেই এই রাজ্যের পাটচাষিরা তাদের পাটের লাভজনক দাম পেতে পারে৷
পাটের লাভজনক দাম পাওয়ার জন্য
পাট চাষিদের কী করা দরকার
এই পরিকল্পনা যতই যুক্তিসঙ্গত হোক না কেন, কেন্দ্র ও রাজ্য কোনও সরকারই এই পরিকল্পনা সহজে কার্যকর করতে চাইবে না৷ কারণ এই পরিকল্পনা কার্যকর হলে ফড়ে–দালাল–আড়তদার মিল মালিকদের স্বার্থহানি হবে৷ আর এইসব সরকার হল মিল মালিকদের সরকার, আড়তদার–ব্যবসায়ী– সরকার৷
তাহলে কী কোনও উপায় নেই? আছে৷ তা হল, কৃষকদের ন্যায়সঙ্গত দাবি মেনে নিতে সরকারকে বাধ্য করার পথ৷ সংগ্রামী কৃষক–খেতমজুরদের্ সংগঠন এআইকেকেএমএস সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছে : ১) জুট কর্পোরেশন অব ওয়েস্ট বেঙ্গল গঠন করে প্রতিটি পাট উৎপাদক জেলায় অঞ্চল পিছু একাধিক পাট ক্রয়কেন্দ্র খোলা, ২) প্রতি কুইন্টাল পাটের দাম কম করে ৬ হাজার টাকা দেওয়া, ৩) সস্তা দরে পাটের সার্টিফায়েড বীজ সরবরাহ, ৪) পাট পচানোর জন্য খাল–বিল সংস্কার ও উপযুক্ত জলাধার নির্মাণ, ৫) কম বা বিনা সুদে পাটচাষিদের উপযুক্ত পরিমাণ ব্যাঙ্ক ঋণ সরবরাহ ইত্যাদি৷
এ আই কে কে এম এস–এর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি পাট চাষিদের সমস্যা সমাধানে এমন আন্দোলন গড়ে তুলতে চায়, যার চাপে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার তাদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হবে৷ শুধু তাই নয়, এই আন্দোলন এমন নজির সৃষ্টি করবে যার ফলে দেশের নানা অংশের নিপীড়িত মানুষ তাদের নিজের নিজের ক্ষেত্রে মরণপণ সংগ্রাম গড়ে তুলতে উৎসাহী হয়৷ এই সংগ্রামে হাজার হাজার পাট চাষিকে সংঘবদ্ধ হওয়ার জন্য এ আই কে কে এম এস–এর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি আবেদন জানিয়েছে৷
(৭১ বর্ষ ৬ সংখ্যা ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৮)