রেল কর্মচারীরা ঘোরতর বিপদের সামনে৷ মোদি সরকারের সিদ্ধান্ত, রেলে ৩ লক্ষ কর্মচারী ছাঁটাই করা হবে৷ শুধু রেল নয়, ব্যাঙ্ক সহ সমস্ত রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাকেই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ছাঁটাইয়ের জন্য কর্মীদের তালিকা তৈরি করতে৷ কর্মী সংগঠনগুলির আশঙ্কা, সমস্ত দপ্তর মিলে ৬ লক্ষাধিক কর্মী কাজ হারাবেন৷
গাড়ি শিল্পেও বিপুল সংখ্যক কর্মী ছাঁটাইয়ের মুখে৷ গাড়ির যন্ত্রাংশ নির্মাণকারী সংস্থাগুলির সংগঠন ‘অ্যাকমা’ পূর্বাভাস দিয়েছে, গাড়ি শিল্পে কর্মরত অন্তত ১০ লক্ষ কর্মী কাজ হারাবেন৷ কারণ দেশে গাড়ি বিক্রি ক্রমাগত কমছে৷
দেশে কর্মহীনতার হার যখন গত ৪৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ, চাকরি পাওয়ার আশায় যখন লাখ লাখ যুবকযুবতী প্রাণপাত করছে, সেই সময় ১৬ লক্ষাধিক কর্মী ছাঁটাইয়ের আশঙ্কা গভীর উদ্বেগের৷
প্রথম দফায় সরকারে বসার আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, বছরে দুই কোটি বেকারের কর্মসংস্থান করবেন৷ প্রমাণ হয়েছে, সেই প্রতিশ্রুতি ছিল ভুয়ো৷ শুধু তাই নয়, আচমকা নোট বাতিল করে বিজেপি সরকার ছোট ছোট শিল্পের সামনে মূলধন সংকটের সৃষ্টি করে বহু সংস্থাকে লালবাতি জ্বালার দিকে ঠেলে দিয়েছে, যার ফলে কাজ হারিয়েছেন কয়েক লক্ষ কর্মী৷ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাঁর সাড়ে পাঁচ বছরের শাসনকালে শিল্পপতি বা বিনিয়োগ আনার জন্য ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’–র আহ্বান নিয়ে কয়েক ডজন দেশ সফর করলেও বিনিয়োগ তেমন আসেনি, উল্লেখ করার মতো কোনও শিল্পও হয়নি৷
তা হলে দেশের যুবসমাজ কাজ পাবে কোথায়? কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন দপ্তরেও লক্ষ লক্ষ পদ বছরের পর বছর ধরে শূন্য পড়ে রয়েছে৷ এগুলোতেও সরকার নিয়োগ করছে না৷ সংস্কারের নামে পদ বিলোপের নীতি বা কর্মী ও কর্ম সংকোচনের নীতি নিয়ে চলছে সরকার৷ অথচ দেশের কর্মক্ষম সকলকে কাজ দেওয়ার দায়িত্ব তো সরকারেরই৷ সরকার সেই দায়িত্ব পালনে পুরোপুরি ব্যর্থ৷ ফলে গোটা পরিস্থিতিটাই বেকার যুবকদের সামনে গভীর অন্ধকারের৷
কী করে দেশের কোটি কোটি বেকারের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যায়, তা দেখাই একটি সরকারের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব হওয়া উচিত৷ অথচ এ সমস্যার সমাধান সম্পর্কে কোনও সুচিন্তিত পরিকল্পনাই সরকারের নেই৷ নির্বাচন এলেই কোটি কোটি বেকারের কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, কিন্তু কোথায় কীভাবে সেই কর্মসংস্থান হবে, কোনও সরকার তা বলে না৷ বর্তমানে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার থেকে শুরু করে পূর্বতন কংগ্রেস সরকার বা রাজ্যে পূর্বতন সিপিএম সরকার থেকে বর্তমান তৃণমূল সরকার– সকলেই ঢালাও চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন৷ কিন্তু বাস্তবে তারা কেউই চাকরি দিতে পারেনি৷
কেন পারেনি? তারা চাকরি দিতে চায়নি, বিষয়টা এমন নয়৷ বাস্তব পরিস্থিতি হল শিল্পে ভয়াবহ মন্দা৷ চাহিদার অভাবে নতুন শিল্প গড়ে উঠছে না৷ বহু চালু কারখানা বন্ধ হচ্ছে৷ চাহিদার সংকট তৈরির পিছনে রয়েছে দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়া৷ ক্রয়ক্ষমতা কমার জন্য দায়ী পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক নিয়ম৷ পুঁজিবাদ একটা বিশেষ ধরনের উৎপাদন সম্পর্ক, যেখানে উৎপাদন হয় সর্বোচ্চ মুনাফার জন্য৷ এই সর্বোচ্চ মুনাফাই যথাসম্ভব সর্বোচ্চ শোষণ কায়েম করে শ্রমিকের ক্রয়ক্ষমতা নামিয়ে নেয়৷ যার ফলে তৈরি হয় চাহিদার সংকট৷ এই সংকটের সমাধান পুঁজিবাদী সমাজ করতে পারে না৷ বিশ্বের কোনও পুঁজিবাদী দেশই পারেনি৷
অবক্ষয়িত পুঁজিবাদী ব্যবস্থার এই অনিরসনীয় সংকটের চরিত্রটি সংসদীয় কোনও দলই জনগণের সামনে পরিষ্কার করে তুলে ধরে না৷ তারা গলার জোরে প্রচার করে এই ব্যবস্থাতেই শিল্পায়ন সম্ভব৷ এক্ষেত্রে বিজেপি, কংগ্রেস, সিপিএম বা তৃণমূল কংগ্রেসের বক্তব্য একই৷ অর্থনীতিবিদরা পুঁজিবাদের বর্তমান স্তরটাকে বি–শিল্পায়নের স্তর বলছেন৷ বলছেন, এ হল ‘জবলেস ইকনমিক গ্রোথ’–এর স্তর অর্থাৎ কর্মসংস্থানহীন আর্থিক বৃদ্ধির স্তর৷ এই অবস্থাতেও এই রাজনৈতিক দলগুলি বলছে, তাদের সরকার প্রচুর চাকরি দেবে৷ সবটাই তাদের বহু–উচ্চারিত ভাঁওতা৷
বর্তমানে গাড়ি শিল্প যখন চাহিদার সংকটে ধুঁকছে, ঠিক সেই সময় হুগলি থেকে নির্বাচিত বিজেপি সাংসদ লকেট চট্টোপাধ্যায় রাজ্যের মানুষকে আবার একবার প্রতারিত করতে বলেছেন, সিঙ্গুরে টাটার ন্যানো গাড়ি কারখানা ফিরিয়ে আনবেন৷ বিজেপি এমপি–র ঘোষণায় উল্লসিত সিপিএমও৷ ন্যানো গুজরাটের সানন্দে গিয়ে যে বন্ধ হয়ে গেল, সে কথাটি এবং তার কারণটি কিন্তু তাঁরা একবারও জনগণের সামনে বলছেন না৷ সানন্দে ন্যানো বন্ধ হয়ে গেছে মন্দা অর্থাৎ চাহিদা না থাকার কারণেই৷ পুঁজিবাদী অর্থনীতির নিয়মকে অগ্রাহ্য করে ভোটের স্বার্থে তাঁরা শিল্পায়নের মিথ্যা স্বপ্ন দেখাতে পারেন৷ তাতে বেকারদের কাজ পাওয়ার কোনও সম্ভাবনাও নেই৷
এ প্রসঙ্গে আরেকটি আশঙ্কার কথাও সামনে আসছে৷ ৩ লক্ষ রেলকর্মী ছাঁটাই হলে রেলের পরিষেবা চলবে কী করে? ইতিমধ্যেই রেলে কর্মী সংখ্যা ভয়াবহভাবে কমানো হয়েছে৷ যাত্রী পরিষেবা সাংঘাতিক বিপন্ন৷ প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে৷ এই অবস্থায় কর্মী ছাঁটাই যাত্রী পরিষেবাকে আরও বিপন্ন করবে৷ সরকারের যা পরিকল্পনা তাতে গোটা রেলদপ্তরই বেসরকারি হাতে তুলে দেবে৷ বেসরকারি সংস্থা অধিক মুনাফা করতে গিয়ে পরিষেবাকে অবহেলার পাশাপাশি বাড়াবে পণ্যমাশুল এবং যাত্রী ভাড়া৷ ত্বরান্বিত হবে মূল্যবৃদ্ধি৷ এক কথায় জনজীবনে সাংঘাতিক বিপর্যয় নেমে আসবে৷ দেশের মানুষ কিছুতেই বিজেপি সরকারের এমন স্বৈরাচারী পদক্ষেপ নীরবে মেনে নেবে না, প্রতিবাদে সোচ্চার হবে৷