Breaking News

৩৭০ ধারা বাতিলের দু’বছর, জম্মু-কাশ্মীর স্বাভাবিক হল কই!

ফাইল চিত্র, দিল্লি- ২০১৯

৫ আগস্ট, পেরিয়ে গেল কাশ্মীরের মানুষের কাছ থেকে ৩৭০ ধারার অধিকার কেড়ে নেওয়ার দু’বছর। সেদিন সকাল থেকেই শ্রীনগরের রাস্তা শুনশান, দোকান বাজার বন্ধ, ঐতিহাসিক ডাল লেকে হাউসবোট বা শিকারা চলেনি। সাধারণ মানুষ নিজেরা স্বেচ্ছায় থাকলেন ঘরবন্দি। গোটা উপত্যকা জুড়েই অদ্ভুত নীরবতা। এ যেন এক নিঃশব্দ প্রতিবাদ।

২০১৯ সালের ৫ আগস্ট হঠাৎ একতরফা কাশ্মীরের বিশেষ অধিকার কেড়ে নেওয়ার ঘোষণা করেছিল কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যের মর্যাদা কেড়ে নিয়ে তাকে দু’ভাগ করে কাশ্মীর ও লাদাখ দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করেছিল তারা। ৩৫-এ ধারা বাতিল করে কাশ্মীরিদের জমির মালিকানা সংক্রান্ত এবং জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যে চাকরি ও অন্যান্য যে অধিকার তারা ভোগ করতেন তা কেড়ে নিয়েছিল। বলেছিল, এই পথেই নাকি কাশ্মীর সমস্যার সমাধান তারা করে ফেলবে। আর সেদিনই এস ইউ সি আই (সি) বলেছিল, ‘… যখন দরকার ছিল ৩৭০ ধারার সম্পূর্ণ রূপায়ণ করে কাশ্মীরি জনসাধারণের আস্থা অর্জন করা এবং পাকিস্তানের সমর্থনপুষ্ট বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিকে বিচ্ছিন্ন ও পরাস্ত করা, তখন একতরফা ৩৭০ ধারা বাতিলের দ্বারা কাশ্মীরের জনগণকে আরও বিচ্ছিন্ন করে, বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিগুলোকে বাড়তে সাহায্য করবে। সামরিক বাহিনী দিয়ে প্রতিবাদী কন্ঠকে কিছুকালের জন্য নীরব করে দেওয়া যেতে পারে, কিন্তু তা বৈরিতা বাড়তেই সাহায্য করবে।’

কী দেখা গেল দু’বছর পর? সারা দেশ দেখল কেন্দ্রীয় সরকারের এই পদক্ষেপকে স্বেচ্ছাচার এবং গায়ের জোর হিসাবেই মনে করে কাশ্মীরের জনগণ। তাই শ্রীনগর সহ অনন্তনাগ, বাদগাম, গাণ্ডেরবাল, কুপওয়ারা ও অন্যান্য জায়গায় সেদিন পালিত হল অঘোষিত স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল। অধিকাংশ দোকান বাজার বন্ধ রইল, স্তব্ধ হল বেশিরভাগ যানবাহন। যে কয়টি দোকান খোলা ছিল, যানবাহন চলেছিল, তা পুলিশের চাপে, নিতান্ত বাধ্য হয়েই। এই হরতাল কোনও সংগঠন এমনকি বিচ্ছিন্নতাবাদীরাও ডাকেনি, কিন্তু কাশ্মীরের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে কেন্দ্রীয় সরকারের চাপিয়ে দেওয়া ফরমানের বিরুদ্ধে তাদের বুকের মধ্যে ধিকি ধিকি জ্বলতে থাকা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটালেন এভাবেই।

অথচ কেন্দ্রের বিজেপি সরকার দাবি করেছিল, ৩৭০ ধারা বাতিল করলেই কাশ্মীর ভারতের মূল স্রোতে আসবে। আরও বলেছিল, এর ফলে জম্মু-কাশ্মীরে প্রচুর আর্থিক বিনিয়োগ হবে এবং দু’বছরের মধ্যেই অন্তত ৫০ হাজার যুবকের কাজ হবে, কাশ্মীরি নারীরা তাদের অধিকার ফিরে পাবে, জঙ্গি কার্যকলাপ বন্ধ হবে, পরিবেশ স্বাভাবিক হবে, উন্নয়নের বন্যা বইবে। কিন্তু বাস্তব বলছে ঠিক উল্টো কথা। বিপুল আর্থিক বিনিয়োগ দূরের কথা, ছিটেফোঁটা বিনিয়োগও কাশ্মীর, লাদাখ এমনকি জম্মুতেও আসেনি। অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে কোনও বিনিয়োগ আসতে পারে না। তাই কোনও কর্মসংস্থানের সুযোগও সৃষ্টি হয়নি।

করোনা অতিমারির কারণে দেশে লকডাউন ঘোষণার বহু আগে থেকেই লকডাউন চলছিল জম্মু-কাশ্মীরে। ৩৭০ ধারা বাতিলের পর থেকেই কাশ্মীর উপত্যকায় ইন্টারনেট যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি ও শিক্ষা কার্যত শিকেয় উঠেছে। পর্যটন ব্যবসার পরিস্থিতি অত্যন্ত শোচনীয়। ফলে কাজ পাওয়া দূরের কথা, অসংখ্য মানুষ কাজ হারিয়েছেন। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায় লাগাম পরানো হয়েছে। যে সব সাংবাদিক সত্য প্রচারের সাহস দেখাতেন, তাদের অধিকাংশকেই রাষ্ট্রবিরোধী আখ্যা দিয়ে কারারুদ্ধ করা হয়েছে। বেশ কিছু দৈনিক সংবাদপত্র ও সংবাদমাধ্যম সরকারি হস্তক্ষেপে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সাংবাদিক সুজাত বুখারি গুলিতে প্রাণ দিয়েছেন। নাগরিক অধিকার ব্যাপকভাবে খর্ব করা হয়েছে। বিরোধী দলগুলোর নেতারা দীর্ঘদিন গৃহবন্দি হয়ে থাকার পর প্রধানমন্ত্রী তাঁদের মুক্তি এবং বৈঠকের নাটক করলেন। সরকার বলল, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই রাজ্য বিধানসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তাদের স্বীকারোক্তিই প্রমাণ করে দিচ্ছে জম্মু-কাশ্মীর স্বাভাবিক হয়নি।

এক বছর আগেও, কিছু সংবাদমাধ্যম যখন সচল ছিল, তারা দেখিয়েছে কী ভাবে সরকারি জমিতে নির্বিচারে প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস করা হচ্ছে, যাতে আগামী দিনে ওই সমস্ত খালি জায়গা বাইরের রাজ্যের কর্পোরেট মুনাফাখোর ব্যবসায়ীরা কিনে নিতে পারে। রাজ্যের মানুষ এক অজানা আশঙ্কায় ভুগছেন, যে ভাবে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করে ফেলা হচ্ছে, হাজারে হাজারে বড় বড় গাছ কাটা হচ্ছে, পাথর কেটে সমতল ভূমি তৈরি করা হচ্ছে, তার ফলে আগামী দিনে উত্তরাখণ্ডের মতোই প্রাকৃতিক বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। স্থানীয় মানুষদের আরও আশঙ্কা, আগামী দিনে কাশ্মীরের জীবনরেখা পর্যটন শিল্পকেও কবজা করে ফেলবে বিভিন্ন কর্পোরেট সংস্থা। সাধারণ মানুষ তাদের ব্যবসা ও জীবন-জীবিকা হারিয়ে সাধারণ শ্রমিক মজুরে পরিণত হবেন। সাংবাদিক ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে ভয়ঙ্কর অনিশ্চয়তার মধ্যে দিনযাপন করছেন কাশ্মীরবাসী। তাদের কাশ্মীরি ভাবাবেগ বা কাশ্মীরিয়ৎকে আঘাত করেছে, ছিনিয়ে নিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার, নাগরিক অস্তিত্ব আজ বিপন্ন। স্থানীয় রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে প্রশাসনের উদ্ধত বেয়নেটের সামনে মানুষ চুপ করে থাকলেও ভেতরে ভেতরে কিন্তু ক্ষোভের বারুদ জমছে। এটা যদি কেন্দ্রীয় সরকার না বুঝতে পারে, তাহলে তার পরিণতি কী হবে ভবিষ্যৎই বলবে।

বিরোধী রাজনৈতিক দলের জোট ‘গুপকর’-এর নেতারা গত ৫ আগস্ট জোটের চেয়ারম্যান ডাঃ ফারুক আব্দুল্লাহর বাড়িতে এক সভায় বলেছেন, ‘কেন্দ্রীয় সরকার কাশ্মীরের মানুষের সাথে প্রতারণা করেছে। বিগত সরকার যে সব কাজ জম্মু-কাশ্মীর ও লাদাখের বিভিন্ন জায়গায় শুরু করেছিল গত দুই বছরে কেন্দ্রীয় সরকার তার কিছুই সম্পন্ন করতে পারেনি, উন্নয়ন দূরের কথা। তাঁদের দাবি, অবিলম্বে জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যের পূর্ণ মর্যাদা ফিরিয়ে দিতে হবে এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে বিধানসভা নির্বাচন করতে হবে।’

আজ কাশ্মীরে কান পাতলে শোনা যায়, ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট ৩৭০ ধারা তুলে দেওয়ার আগে জম্মু-কাশ্মীরে কাশ্মীর উপত্যকাই ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে একমাত্র সমস্যার জায়গা। বর্তমানে তা বেড়ে হয়েছে চার। কাশ্মীর উপত্যকার সাথে সমস্যা সঙ্কুল তালিকায় যোগ হয়েছে কারগিল, লাদাখ ও জম্মু। ৩৭০ ধারা বাতিলের পর রাজ্যের পরিস্থিতি দিন দিন জটিল থেকে জটিলতর হয়েছে। সর্বত্র অসন্তোষ বেড়েছে সাধারণ মানুষের। যার অভিব্যক্তি বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে দিয়ে দেখা যাচ্ছে। কাশ্মীরের এ কথা শোনার মতো সময় সরকারের আছে কি?

(তথ্য সূত্রঃ পিটিআই, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ আগস্ট)

গণদাবী ৭৪ বর্ষ ৫ সংখ্যা (২৭ আগস্ট ২০২১)