ছাত্র সমাজ বিজেপি সরকারের নয়া শিক্ষানীতি মানছে না। মানছে না শিক্ষাকে বাণিজ্যে পরিণত করার নীতি। মানছে না শিক্ষার সিলেবাসে অবৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর অনুপ্রবেশ। ‘টাকা যার শিক্ষা তার’– এই নীতি বাতিল করতে তারা সরকারকে বাধ্য করবেই। শিক্ষা বাঁচাও, সংস্কৃতি বাঁচাও, রক্ষা করো মনুষ্যত্ব–এই আহ্বান নিয়ে এ আই ডি এস ও-র ডাকে দেশের ২৯টি রাজ্য ও ৪টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল থেকে আসা হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রীর দৃপ্ত কণ্ঠস্বর দিল্লির বুকে এই দাবিগুলিই তুলে গেল ২৭-২৯ নভেম্বর সর্বভারতীয় ছাত্র সম্মেলনে।
শহিদ উধম সিং-এর ১২৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে দিল্লির তালকাটোরা স্টেডিয়ামের সম্মেলনস্থলকে অভিহিত করা হয়েছিল তাঁর নামে। বিজেপি সরকার় নয়া জাতীয় শিক্ষানীতির মাধ্যমে চাইছে সরকারি শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে, শিক্ষার চূড়ান্ত সাম্প্রদায়িকীকরণের মাধ্যমে ছাত্র-মস্তিষ্কে বিভেদের বীজ বপন করছে, ভারতীয় জ্ঞান প্রণালীর নামে সিলেবাসে অবৈজ্ঞানিক পাঠক্রম যুক্ত করছে, বিজ্ঞান শিক্ষার উপরে আঘাত হেনে বিজ্ঞানমনস্কতাকে বিনষ্ট করতে চেষ্টা করছে, মূল্যবোধ তৈরির শিক্ষার পরিবর্তে কারিগরি শিক্ষার উপর জোর দিয়ে ‘মানুষ গঠন, চরিত্র গঠনের’ প্রয়োজনকে অস্বীকার করা হচ্ছে। শিক্ষার ওপর এই ভয়ঙ্কর আক্রমণের বিরুদ্ধে দেশের ছাত্রসমাজকে সংগঠিত হওয়ার ডাক দিয়েছে এই সম্মেলন।
স্বাধীনতার পর থেকে সব দলের সরকারই শিক্ষাকে সংকুচিত করার চেষ্টা চালিয়ে গেছে। শিক্ষার উদ্দেশ্য তাদের কাছে কেবলমাত্র পুঁজি মালিকদের প্রয়োজনে প্রশিক্ষিত মজুর তৈরি করা, মোদি সরকারের শিক্ষানীতি সেই ছাঁচেই তৈরি। বিজেপি পরিচালিত রাজ্য সরকারগুলি তো বটেই, বিরোধী তৃণমূল কংগ্রেস পরিচালিত পশ্চিমবঙ্গ সরকার, কেরালার সিপিএম পরিচালিত সরকার, কিংবা কর্নাটকের কংগ্রেস বা তামিলনাডুর ডিএমকে সরকারও একই শিক্ষানীতি প্রয়োগ করছে।
প্রকাশ্য অধিবেশন
২৭ নভেম্বর প্রকাশ্য সমাবেশে দিল্লির আশেপাশের রাজ্য থেকে চার হাজারের বেশি ছাত্রছাত্রী অংশ নেন। মঞ্চটি শহিদ বিরসা মুণ্ডার নামাঙ্কিত করা হয়। ছাত্র আন্দোলন ও গণআন্দোলনের শহিদদের স্মরণে নির্মিত বেদিতে মাল্যদান করেন অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি এবং দিল্লি স্কুল অফ ইকনমিক্সের অধ্যাপক দিব্যেন্দু মাইতি।উদ্ধৃতি প্রদর্শনী উদ্বোধন করেন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক অরুণ কুমার, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি ও সর্বভারতীয় শিক্ষক সংগঠন ফেডকুটার প্রাক্তন সভাপতি অধ্যাপক নন্দিতা নারায়ণ। আলোকচিত্র প্রদর্শনী উদ্বোধন করেন জেএনইউ-এর অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়ান জিওগ্রাফারের সভাপতি অধ্যাপক সচ্চিদানন্দ সিনহা। এই সম্মেলনে ছাত্রছাত্রীদের যোগদান আটকানোর জন্য মধ্যপ্রদেশের বিজেপি সরকার সক্রিয় ভূমিকা নেয়। গুনা শহরে এআইডিএসও-র প্রচার চলার সময় কর্মীদের ওপর এবিভিপি-র গুণ্ডারা হামলা চালায়।ম্ভ্র আক্রান্ত কর্মীরা থানায় অভিযোগ জানাতে গেলে পুলিশ মিথ্যা অভিযোগে ৮ জন এআইডিএসও কর্মীকে গ্রেপ্তার করে। সম্মেলনের দিনগুলিতেও তাঁরা জেলেই ছিলেন। এর পরেও গুনা থেকেই ৬০০ জনের বেশি ছাত্র-ছাত্রী দিল্লির সম্মেলনে যোগ দেন।
উদ্বোধনী অধিবেশন শুরু হয় প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ইরফান হাবিবের ভিডিও বার্তার মধ্য দিয়ে। ভগৎ সিং আর্কাইভস অ্যান্ড রিসোর্স সেন্টারের উপদেষ্টা অধ্যাপক চমনলাল, এআইডিএসও-র প্রাক্তন সভাপতি কমরেড অরুণ কুমার সিং বক্তব্য রাখেন। বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ অধ্যাপক রোমিলা থাপারের একটি লিখিত বার্তা পাঠ করা হয়। অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন এআইডিএসও-র বিদায়ী সভাপতি কমরেড ভি এন রাজশেখর।
পরবর্তী অধিবেশনে বিভিন্ন বাম ও গণতান্ত্রিক ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দ বর্তমান পরিস্থিতিতে শিক্ষা আন্দোলন ও বামপন্থী ঐক্য প্রসঙ্গে বক্তব্য রাখেন। বক্তাদের মধ্যে ছিলেন এআইএসএ-র জাতীয় সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রসেনজিত কুমার, এআইএসএফ-এর জাতীয় সভাপতি কমরেড বিরাজ দেভাং, এআইএসবি-র সম্পাদক কমরেড জয়বর্ধনে, পিএসইউ-এর সাধারণ সম্পাদক কমরেড নওফেল মহম্মদ সফিউল্লাহ এবং এআইডিএসও-র সর্বভারতীয় নেতা কমরেড মণিশংকর পট্টনায়ক। ওই দিন সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অধিবেশনে বিভিন্ন রাজ্যের অনুষ্ঠান পরিবেশিত হয়। এই অধিবেশনের উদ্বোধন করেন বিশিষ্ট কবি ও সিএসআইআর-এর প্রাক্তন প্রধান বিজ্ঞানী ডঃ গওহর রাজা।
প্রতিনিধি অধিবেশন
প্রতিনিধি অধিবেশনের মঞ্চটি স্বাধীনতা আন্দোলনের দুই শহিদ আল্লুরী সীতারাম রাজু এবং কনকলতা বড়ুয়ার নামাঙ্কিত করা হয়। সারা দেশ থেকে নির্বাচিত দুই হাজার প্রতিনিধি অংশ নেন। উত্তর পূর্বাঞ্চলের সমস্ত রাজ্য থেকে প্রতিনিধিরা এসেছিলেন। ছিলেন জম্মু-কাশ্মীরের প্রতিনিধিরাও। প্যালেস্টাইনের জনগণের সংগ্রামকে স্মরণ করে আন্তর্জাতিক সেমিনারে অল নেপাল ন্যাশনাল ফ্রি স্টুডেন্টস ইউনিয়ন এবং অল নেপাল স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (সোসালিস্ট) প্রতিনিধিরা বক্তব্য রাখেন।
ভিডিও বার্তা পাঠানশ্রীলঙ্কার রেভোলিউশনারি ছাত্র ইউনিয়ন, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, যুগোস্লাভিয়ার সমাজতান্ত্রিক যুব লিগ। এ ছাড়াও লিখিত বার্তা পাঠায় পাকিস্তানের ন্যাশনাল স্টুডেন্টস ফ্রন্ট, বাংলাদেশের গ্রেটার চট্টগ্রাম হিল ট্রাক্টস স্টুডেন্টস কাউন্সিল, তুরস্কের ফেডারেশন অফ সোসালিস্ট ইয়ুথ অ্যাসোসিয়েশন এবং ভিয়েতনামের হো চি মিন কমিউনিস্ট ইয়ুথ ইউনিয়ন ও তুরস্ক এবং ভেনেজুয়েলার ছাত্র সংগঠন। এআইডিএসও-র পক্ষে বক্তব্য রাখেন কমরেড অশ্বিনী কে এস। পরিচালনা করেন কমরেড চন্দন সাঁতরা।
অ্যাকাডেমিক অধিবেশনে মুম্বই আইআইটি-র প্রখ্যাত অধ্যাপক রাম পুনিয়ানি, অধ্যাপক এল জওহর নেশান, প্রাক্তন সাংসদ এবং পিপলস হেলথ মুভমেন্টের নেতা ডাঃ তরুণ মণ্ডল, অধ্যাপক ওয়ান্ডেল পাসাহ (অবসরপ্রাপ্ত প্রধান, ইলেকট্রনিক্স বিভাগ, সেন্ট এডমন্ড কলেজ, শিলং), লেফটেন্যান্ট জেনারেল জামিরউদ্দিন শাহ (প্রাক্তন উপাচার্য, আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়), অধ্যাপক নবনীত শর্মা (হিমাচল প্রদেশ কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, ধর্মশালা) জাতীয় শিক্ষানীতির বিরূপ প্রভাব নিয়ে আলোচনা করেন।
ছাত্র, শিক্ষা ও সমাজের জন্য যাঁরা তাঁদের জীবন উৎসর্গ করেছেন, সেই সব যোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে শোক প্রস্তাবের মাধ্যমে সান্ধ্য অধিবেশন শুরু হয়। পরে শিক্ষাসংক্রান্ত বিষয় এবং ছাত্র আন্দোলন সম্পর্কিত মূল প্রস্তাবের পাশাপাশি প্যালেস্টাইনে যুদ্ধ ও গণহত্যা বন্ধ, মহিলাদের বিরুদ্ধে অত্যাচার রুখতে কার্যকরী ব্যবস্থার দাবি, মণিপুরে জাতিদাঙ্গা বন্ধ করা, পরিবেশ রক্ষা এবং সকলের জন্য চাকরি সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রস্তাব উত্থাপন করা হয় এবং সর্বসম্মত ভাবে গৃহীত হয়। মূল রাজনৈতিক প্রস্তাব ও সাংগঠনিক প্রস্তাবের উপর প্রতিনিধিরা আলোচনা করেন ও সর্বসম্মতিক্রমে তা গৃহীত হয়। প্রতিনিধিদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখেন এআইডিএসও-র প্রাক্তন সর্বভারতীয় কোষাধ্যক্ষ এবং এসইউসিআই(সি) পলিটবুরো সদস্য কমরেড চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য।
সম্মেলন শেষ হয় সংগঠনের প্রথম সাধারণ সম্পাদক এবং এসইউসিআই(সি)-র বর্তমান সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষের ভিডিও ভাষণের মধ্য দিয়ে। তিনি এআইডিএসও-র প্রতিষ্ঠা পর্বের সংগ্রাম, মহান মার্ক্সবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষায় সংগঠনের এগিয়ে চলার নানা দিক তুলে ধরেন। বর্তমান শিক্ষা-সংস্কৃতি ও মনুষ্যত্ব রক্ষার সংগ্রামে ছাত্র সমাজের করণীয় ও এআইডিএসও-র ভূমিকা তিনি সুনির্দিষ্টরূপে তুলে ধরেন। কমরেড সৌরভ ঘোষকে সভাপতি এবং কমরেড শিবাশিস প্রহরাজকে সাধারণ সম্পাদক করে ২০২ জন সদস্য বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কাউন্সিল ও সম্পাদকমণ্ডলী এবং কার্যকরী কমিটি নির্বাচিত হয়।