রাজ্যের প্রায় ২৬,০০০ শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীর চাকরি বাতিল নিয়ে সম্প্রতি ব্যাপক চর্চা চলছে। এ নিয়ে মামলা চলছে সুপ্রিম কোর্টে। পরপর শুনানি হচ্ছে। ভুক্তভোগী শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের ধর্মতলার ওয়াই চ্যানেলে দীর্ঘ ধরনা চলছে। কলকাতার বুকে মাঝে মাঝে মিছিল সংগঠিত হচ্ছে। গত বছর ২২ এপ্রিল কলকাতা হাইকোর্ট রাজ্যের স্কুল সার্ভিস কমিশন (এসএসসি)-কে নির্দেশ দেয় ২০১৬ সালের প্রথম স্টেট লেভেল সিলেকশন টেস্টের (এসএলএসটি-১) ভিত্তিতে নিযুক্ত শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের চাকরি বাতিল করতে হবে। কারণ এই প্যানেলে নিয়োগ নিয়ে ক্ষমতাসীন তৃণমূল সরকারের নেতা-মন্ত্রী ও আমলাদের ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি ধরা পড়েছে। এই দুর্নীতির অভিযোগে প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী থেকে শুরু করে মধ্যশিক্ষা পর্ষদের চেয়ারম্যান, এসএসসি-র চেয়ারম্যান সহ অনেকে গ্রেপ্তার হয়েছেন। কোটি কোটি টাকা উদ্ধারের ঘটনা সামনে এসেছে। কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে প্রথমে রঞ্জিত বাগ কমিটি গঠিত হয়। পরে সিবিআই এই দুর্নীতির তদন্তে নামে। তাদের রিপোর্টেও এই নিয়োগে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। ‘চালে কাঁকর বাছতে’ না পেরে নাকি হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ ‘ঢাকি সমেত বিসর্জনে’র নামে এই প্যানেল বাতিল করেছে। ১০ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্টে দেখা গেল, হাইকোর্টের রায়কেই কার্যত সমর্থন করেছে সিবিআই। তারা কাঁকর বাছার পরিশ্রমটুকু করতে নারাজ। অথচ এ জন্যই তাঁদের মাইনে দিয়ে রাখা হয়েছে।
এরপর ভুক্তভোগী শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের একটা বড় অংশ হাইকোর্টের এই রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করে। সংগঠনগত ভাবে মাধ্যমিক শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী সমিতি (এসটিইএ) আপিল করে। গত ৭ মে সুপ্রিম কোর্ট হাইকোর্টের এই রায়ের ওপর অন্তর্বর্তীকালীন স্থগিতাদেশ দেয়। সেই মামলা এখনও বিচারাধীন। জল্পনা চলছে, যোগ্যদের চাকরি থাকবে, নাকি পুরো প্যানেল বাতিল হয়ে যাবে।
২০১৬-র প্যানেলে চাকরি পাওয়া প্রায় ২৫ হাজার ৭৫৩ জন সকলেই চুরি-দুর্নীতি করে নিযুক্ত হয়েছেন, এমন দাবি সিবিআইও করেনি। কিন্তু দুর্নীতিতে অভিযুক্ত স্কুল সার্ভিস কমিশন, মধ্যশিক্ষা পর্ষদ যথাযথ তথ্য সরবরাহ করতে পারেনি। এই প্যানেলের গ্রুপ ডি, গ্রুপ সি, নবম-দশম শ্রেণি ও একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি শিক্ষক– এই চার বিভাগের নিযুক্তদের মধ্যে প্রায় পাঁচ হাজারের কাছাকাছি নিযুক্তরা দুর্নীতিতে যুক্ত, এমন রিপোর্ট প্রকাশ পেয়েছে। এসএসসি সুপ্রিম কোর্টে বলেছে, সাদা খাতা, ব়্যাঙ্ক জাম্প এবং প্যানেল বহির্ভূত নিয়োগের তথ্য তাঁদের হাতে আছে, কিন্তু ওএমআর সিট জালিয়াতির তথ্য নেই। সিবিআই-ও তা বের করতে নারাজ। অথচ মূল মামলাকারীদের এক আইনজীবী সুপ্রিম কোর্টে বলেছেন, প্রথম তিনটি কাউন্সেলিং নিয়ে তাঁর কোনও প্রশ্ন নেই।
২২ এপ্রিল ২০২৪ হাইকোর্টের এই রায়ের আগে থেকেই বিজেপি নেতা তথা রাজ্যের বিরোধী দলনেতা হুমকি দিয়ে রেখেছিলেন যে, শিক্ষাক্ষেত্রে বোম পড়তে চলেছে। এক সাংবাদিক এই রায়ের আগেই বলে দিয়েছিলেন কোন ক্ষেত্রে কতজনের চাকরি বাতিল হয়ে যাচ্ছে। লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে তাঁরা এই কথাগুলো কেন বলেছেন তা সহজেই অনুমান করা যায়। আবার সিপিএমের রাজ্যসভার সাংসদ আইনজীবী বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য সহ এক দল আইনজীবী এই প্যানেল সম্পূর্ণ বাতিলের জন্য প্রথম থেকেই সওয়াল করে এসেছেন।
অথচ বাদী-বিবাদী সকল পক্ষের আইনজীবীই স্বীকার করেছেন যে, এই প্যানেলে নিযুক্ত সকলেই দুর্নীতিগ্রস্ত নন। মেধা ও স্বচ্ছতার ভিত্তিতে বেশিরভাগই নিযুক্ত হয়েছেন। যারা চুরি করেছে, দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছে তাদের আইনি প্রক্রিয়ায় যথাযথ শাস্তি দেওয়া একান্তই প্রয়োজন। কিন্তু যারা দীর্ঘ দিন পড়াশোনা করে নিজের মেধার ভিত্তিতে নিযুক্ত হয়েছেন, তাদের চাকরি কেড়ে নিয়ে শাস্তি দেওয়া হবে কেন? এই নিয়ে ভুক্তভোগী শিক্ষকদের পাশাপাশি আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া সংগঠন এসটিইএ গত ২৪ এপ্রিল কলেজ স্ট্রিটে প্রথম রাজপথে বিক্ষোভ দেখায়। এই বছর ৫ জানুয়ারি কলকাতায় যোগ্যদের চাকরি বহাল রাখার দাবিতে মিছিল আটকালে পুলিশের সঙ্গে ব্যাপক ধস্তাধস্তি হয়। যতটুকু খবর পাওয়া যায় এই সমিতির জোরালো যুক্তিতেই সুপ্রিম কোর্ট হাইকোর্টের এই অর্ডারে স্থগিতাদেশ দিয়েছে। দুঃখের হলেও এ কথা সত্য, রাজ্যে রেজিস্ট্রিকৃত ৭০টির বেশি মাধ্যমিক শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের সংগঠন থাকা সত্ত্বেও এই একটি মাত্র সংগঠনই যোগ্যদের চাকরির বহাল রাখার দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে।
আশ্চর্যের বিষয়, সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টে বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য প্রধান বিচারপতির এজলাসে বঞ্চিত চাকরিপ্রার্থীদের হয়ে সওয়াল করতে গিয়ে পুরো প্যানেল বাতিল করতে হবে এই দাবি জোরালোভাবে উপস্থিত করেন। অথচ তার পরের দিনই তিনি যে দলের সাংসদ সেই সিপিআই(এম)দলের নেতা সুজন চক্রবর্তী যোগ্যদের চাকরি বহাল রাখার জন্য সাংবাদিক সম্মেলন করলেন। এদেরই ছাত্র সংগঠন এসএফআই এবং শিক্ষক সংগঠন এবিটিএ নাকি যোগ্যদের চাকরি দাবি করছে। তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াচ্ছে? এটা কি ‘সাপ হয়ে দংশে, ওঝা হয়ে ঝাড়ানো’র মতো নয়? এই দ্বিচারিতা মানা যায়!
শিক্ষার সর্বনাশ ঘটানোর ক্ষেত্রে বিগত সরকারের প্রধান দল হিসেবে এদের ভূমিকা সবাই তিক্ততার সঙ্গে স্মরণ করে। পাশ-ফেল প্রথা তুলে দেওয়া, ইংরেজি তুলে দেওয়া, শিক্ষার বেসরকারিকরণের পথে হাঁটা, নিয়োগ নিয়েও ব্যাপকভাবে দুর্নীতি করা, শিক্ষাক্ষেত্রে দলবাজি নামক ব্যাধির বিষময় ফল ভুলে যায়নি জনসাধারণ। তাদের এই আইনজীবী দলীয় নেতা প্যানেল বাতিল করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন, অথচ যারা চুরি করল, তাদের শাস্তিদানের দাবিতে বৃহত্তর লড়াই দরকার ছিল সে নিয়ে লড়াই আন্দোলন চোখে পড়ল না কিন্তু।
আবার যে বিজেপি লোকসভা ভোটের আগে এই প্যানেল বাতিলের জন্য ‘বোম পড়া’র হুমকি দিয়েছিল। তারাও নাকি যোগ্যদের চাকুরির দাবি নিয়ে লড়তে চাইছে। বিজেপি শাসিত মধ্যপ্রদেশের নিয়োগ সংক্রান্ত ব্যাপম কেলেঙ্কারি সবার নিশ্চয়ইমনেআছে? কী অদ্ভুত সব দ্বিচারিতা এদের! ভোটের স্বার্থে এরা সবাই এখন সাধু সাজতে চাইছে।
প্রসঙ্গত, এই প্যানেলের শিক্ষক শিক্ষাকর্মীরা ২০১৮-১৯ সাল এবং পরবর্তীকাল থেকে নিযুক্ত হয়েছেন। ৫-৬ বছর চাকুরি করছেন। সমাজে এঁদের মর্যাদা, সম্মানের সাথে সাথে, নানা সাংসারিক দায়-দায়িত্বও রয়েছে। তাছাড়া দীর্ঘদিন কোনও নিয়োগ না হওয়ায় এমএ, এমএসসি, বিএড এমনকি পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছেন লাখো লাখো উচ্চশিক্ষিত বেকার যুবক-যুবতী। ফলে যোগ্যদের চাকরি কেড়ে নেওয়ার অভিসন্ধি মানা যায় না। চুরি-দুর্নীতিতে যুক্ত যারা, তাদের গ্রেপ্তার করে তদন্ত সাপেক্ষে আইন অনুযায়ী শাস্তি দেওয়া হোক, এটাই সবাই চায়। কিন্তু যাঁরা এই চুরি দুর্নীতিতে যুক্ত নন, যাঁরা কলুষমুক্ত, নিজের মেধার ভিত্তিতে যোগ্যতার সাথে নিযুক্ত হয়ে সক্ষমতার পরিচয় দিয়ে শিক্ষকতা করছেন বা শিক্ষাকর্মীর কাজে যুক্ত রয়েছেন, তাঁদের চাকরি কেড়ে নেওয়া হবে কেন? তদন্ত সংস্থা সিবিআই, স্কুল সার্ভিস কমিশন, মধ্যশিক্ষা পর্ষদ, রাজ্য সরকার যোগ্য-অযোগ্য পৃথকীকরণে মূল ভূমিকা যাদের গ্রহণ করার দরকার ছিল, তাদের শঠতা প্রবঞ্চনা প্রায় ১৯ হাজার যোগ্য শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। প্রতিটি মুহূর্তে চাকরি হারানোর আশঙ্কা তাঁদের যে ভাবে তাড়া করছে, তা থেকে মুক্তি দেওয়ার দায় যেমন রাজ্য সরকারের, সাথে সাথে আমাদের দেশের আইন ব্যবস্থারও।
এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) দল যোগ্যতা ও মেধার ভিত্তিতে নিযুক্ত শিক্ষক শিক্ষাকর্মীদের চাকরি বহাল রাখার দাবি জানিয়েছে এবং আন্দোলনের পাশে থাকার অঙ্গীকার করেছে। পাশে থেকে নানা স্তরে যে আন্দোলন তারা করছে, তাতে এই দলের প্রতি রাজ্যের শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী সহ জনসাধারণের আস্থা বৃদ্ধি পেয়েছে।
অন্যদিকে যে সমস্ত ভোটবাজ দল জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করছে, এই হাজার হাজার চাকরিজীবীর ভবিষ্যৎ নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে, তাদের সম্পর্কে সচেতন হওয়া আজ অত্যন্ত জরুরি।