কলকাতার উপকণ্ঠে সোনারপুরে এক্সোডাস বস্ত্র কারখানার মহিলা শ্রমিকদের উপর মালিক পক্ষের নির্মম শোষণের কাহিনী অনেকেই জানেন না। সম্প্রতি তাঁরা ২৬ দিনের অবস্থান আন্দোলন চালিয়ে আদায় করেছেন কিছু দাবি। ৭০০ টাকা বেতন বেড়েছে। কর্তৃপক্ষ কথা দিয়েছে পি এফ কমানো হবে না।
এই কারখানায় বেশির ভাগ শ্রমিক মহিলা। তাদের বলা হয়, বাড়ি থেকে বাথরুম সেরে কারখানায় আসতে। না হলে সময় নষ্ট হবে, প্রোডাকশন কমে যাবে। এক একটা লাইনে ৩২ জন করে মেয়ে কাজ করে। একটা সময়ে লাইনে টয়লেট কার্ড চালু করেছিল কোম্পানি। কার্ড নিয়ে কোনও মেয়ে টয়লেটে গেলে সে না ফেরা অবধি অন্য কেউ টয়লেটে যেতে পারবে না। দুপুরে লাঞ্চের সময় ৩০ মিনিট। ওই সময়ের মধ্যে বিশ্রাম, খাওয়া শেষ করে ফেরা যায় না। ১৫ মিনিটে কোনও রকমে নাকে-মুখে খাবার গুঁজে আবার প্রোডাকশন ফ্লোরে ফিরতে হয় টার্গেট পূরণের জন্য। সাড়ে ৮ ঘণ্টা ধরে অমানুষিক টার্গেট পূরণ করার পেছনে ছুটতে হয়। টিম লিডার এসে প্রত্যেক ১৫ মিনিটে পিস গুণে যায়। প্রতি ১৫ মিনিটের টার্গেট গত পাঁচ বছরে চারগুণ বেড়ে গেছে। লাঞ্চের সময় বাদ দিয়ে সারাদিনে খিদে পেলে কিছু খাওয়ারও পারমিশন নেই। কেউ বাড়ি থেকে মুড়ি চানাচুর নিয়ে গেলে এইচ আর ম্যানেজার ডেকে বলেন, পরের দিন ধরা পড়লে খাবার নিয়ে নেওয়া হবে। কোনও দিন টার্গেট পূরণ না করতে পারলে অতিরিক্ত সময় কারখানায় থেকে টার্গেট পূরণ করে তবে কারখানা থেকে বেরোনো যায়। অভয়ার ধর্ষর্ণ ও মৃত্যুর খবর শুনে কারখানার মেয়েরা একদিন কাজ বন্ধ রেখে মিছিল করে। সেই একদিনের প্রোডাকশনও পরে অতিরিক্ত কাজ করে উসুল করে দিতে হয়েছে।
পার্মানেন্ট কর্মচারী হওয়া সত্তে্বও কর্মীদের কোনও সিএল নেই। ইএল বা আর্নড লিভ থাকলেও তার হিসেব নানা সময় নানাভাবে বোঝানো হয়। অনুপস্থিত থাকলে একেক সময় একেক হিসেব দেখিয়ে ইএল কেটে নেওয়া হয়। কোম্পানি তিন জায়গায় প্ল্যান্ট চালায়, মাল রপ্তানি করে। অথচ শ্রমিকদের উপর আক্রমণ ক্রমশ বাড়ছে। টার্গেটের চাপে শ্রমিকদের নিংড়ে নেয় কোম্পানি। আর অন্য দিকে প্রাপ্য টাকা থেকে বঞ্চিত করে। প্রায় ৫ বছরেরও বেশি সময় বেতন থেকে শ্রমিকের অংশের টাকা কেটে নিলেও সেই টাকা পিএফ অ্যাকাউন্টে কোম্পানি পুরোপুরি জমা দেয়নি। কোম্পানির ভাগের টাকাও জমা করেনি। ২০২২ সালে শ্রমিকরা বকেয়া পিএফ-এর দাবিতে আন্দোলন করে। ২০২৪ সালের মে মাসে মালিক লিখিত চুক্তি করে জানায় যে বকেয়া পিএফ-এর টাকা ডিসেম্বর ’২৪-এর মধ্যে জমা করা হবে। কিন্তু তা হয়নি। নতুন শ্রমিকদের বলে দেওয়া হচ্ছে যে তারা কোনও ইএসআই, পিএফ পাবে না। শ্রমিকদের বেসিক পে-ও কমিয়ে দেওয়া হয়েছে যাতে পিএফ কমে যায়। শ্রমিকদের নিয়ে কথা বলতে চাইলেও মালিক শ্রমিকদের সাথে কোনও রকম আলোচনা না করে ২১ ফেব্রুয়ারি সাসপেনশন অফ ওয়ার্ক নোটিশ টাঙিয়ে কোম্পানি বন্ধ করে দেয়।
এর প্রতিবাদেই কারখানা গেটে লাগাতার অবস্থানে বসেন মহিলা শ্রমিকরা। তাঁদের দাবি– সমস্ত বকেয়া পিএফ এর টাকা জমা করতে হবে, বেসিক পে কোনও মতেই কমানো যাবে না, যে কর্মচারীরা ৫ বছর বা তার অতিরিক্ত সময় কাজ করে কাজ ছেড়ে দিয়েছেন তাঁদের গ্র্যাচুইটি দিতে হবে।
২২ ফেব্রুয়ারি থেকে কারখানার গেটে অবস্থান শুরু করেন মহিলারা। কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের কথা শুনতে টালবাহানা করতে থাকে। ফলে শ্রমিকরা আন্দোলনে অটল থাকেন। এই আন্দোলনের খবর বহুল প্রচারিত সংবাদপত্রগুলিতে গুরুত্ব সহ প্রকাশিত হয়নি। আরবান আশা ওয়ার্কারদের পক্ষ থেকে তিন জনের প্রতিনিধি দল ১৭ মার্চ এঁদের প্রতি সংহতি জানান। এঁদের পক্ষে রুনা পুরকায়েত আন্দোলনের পাশে থাকার বার্তা দেন। আন্দোলন উল্লেখযোগ্য জয় অর্জন করেছে। কিন্তু প্রতিশ্রুতি দিয়ে লংঘন করা মালিক শ্রেণির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এই কারখানাতেও তার নজির রয়েছে। ফলে আন্দোলনের চাপ জারি রাখা জরুরি।