২৫ রাজ্যের মহিলারা কলকাতায় আওয়াজ তুললেন
সিএএ-এনআরসি বাতিল কর
২১ জানুয়ারি কলকাতা শহর প্রত্যক্ষ করল প্রায় ১০ হাজার মহিলার অভূতপূর্ব এক মিছিল। দৃপ্ত স্লোগানে কলকাতার রাজপথ মুখরিত করে ধর্মতলার লেনিন মূর্তির পাদদেশ থেকে মিছিল মৌলালি হয়ে রামলীলা পার্কে যায়। মিছিলের সামনের সারিতে ছিলেন এক ঝাঁক নানা বয়সের তরুণী। তাঁরা কেউ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, কেউ আইনজীবী, আবার কেউ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গবেষণারত। রয়েছেন শ্রমজীবী, কৃষক রমণীরাও। বিভিন্ন প্রদেশের মহিলাদের অনেকেরই কোলে শিশুসন্তান। মিছিল থেকে জোরালো স্লোগান উঠেছে– ধর্ষণ, গণধর্ষণ, হত্যা সহ সমস্ত প্রকার নারী নির্যাতন বন্ধ করতে হবে, মদ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করতে হবে, এনআরসি, সিএএ নারীসমাজ মানছে না। অধিকাংশই মেহনতি ঘরের মহিলা। ঘর ছেড়ে, কাজ কামাই করে দলে দলে তারা সুশৃঙ্খল মিছিলে এসেছেন। রাস্তার দু’ধারে মানুষ বিস্মিত চোখে তা দেখেছেন। এই মিছিল মানুষের মনে ভরসা জুগিয়েছে যে নারীশক্তির যদি এমন জাগরণ ঘটে তবে সরকারের সব অত্যাচারকে রুখে দেওয়া সম্ভব। উত্তরের হিমাচল প্রদেশ থেকে সুদূর দক্ষিণের কেরালা কর্ণাটক সহ ভারতবর্ষের ২৫টি রাজ্য থেকে হাজার হাজার মহিলা এসেছেন অল ইন্ডিয়া মহিলা সাংস্কৃতিক সংগঠনের সর্বভারতীয় সম্মেলন উপলক্ষে। ২১ জানুয়ারি ছিল রামলীলা ময়দানে প্রকাশ্য সমাবেশ। ধর্ম বর্ণ জাতপাতের ঊর্ধ্বে উঠে এ যেন এক মিনি ভারতবর্ষ, যা এক মহান আদর্শে দীক্ষিত, সংকল্পে অটল।
মানবমুক্তির দিশারি মহান লেনিনের ৯৬তম মৃত্যুদিবসে ধর্মতলায় স্থাপিত তাঁর মূর্তিতে মাল্যদান করে মিছিলের যাত্রা শুরু হয়। এত বিশাল সমাগমের স্থান হওয়া রামলীলা পার্কে সম্ভব নয়। ফলে পার্ক ছাপিয়ে ফুটপাত ও রাস্তার সিংহভাগ জুড়ে মহিলাদের ভিড়। বিশিষ্ট সমাজকর্মী মেধা পাটকর ছিলেন এই সমাবেশের উদ্বোধক। সমগ্র জনতাকে উদ্বুদ্ধ করে তিনি বলেন, ‘‘সারা দেশ জুড়ে আক্রান্ত ও অত্যাচারিত মহিলাদের জন্য অল ইন্ডিয়া মহিলা সাংস্কৃতিক সংগঠন যে আন্দোলন করছে তার জন্য এই সংগঠনকে প্রথমেই আমি অভিনন্দন জানাই। নন্দীগ্রাম ও সিঙ্গুরে প্রতিবাদী মহিলাদের উপর যখন ভয়ংকর আক্রমণ হয়েছিল তখনও আপনারা প্রতিবাদ করেছিলেন। নারীশক্তি যখন আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে তখন তাতে নতুন রোশনাই লাগে।” তিনি কেন্দ্রীয় সরকারকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, যে প্রধানমন্ত্রী নিজের শিক্ষার সার্টিফিকেট দেখাতে পারেন না, তিনি দেশবাসীর কাছে নাগরিকের কাগজ চাইছেন কী করে? উপস্থিত মহিলাদের সাথে গলা মিলিয়ে তিনি আওয়াজ তোলেন ‘আমরা কাগজ দেখাব না’। এনআরসি, সিএএ-র বিরুদ্ধে আন্দোলনে মহিলাদের অগ্রণী ভূমিকার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করে তিনি এই আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করার আহ্বান জানান। নরেন্দ্র মোদি ৩১ শতাংশ মানুষের ভোটে জিতে এসে কীভাবে ৯০ শতাংশ মানুষের ঘৃণা কুড়াচ্ছেন সেকথা উল্লেখ করে বলেন ‘‘আপনারা স্লোগান তুলুন ধর্ম নিয়ে গুন্ডামি করা চলবে না। এমন জোরে স্লোগান তুলুন যেন তা কাল সুপ্রিম কোর্টে পৌঁছে যায়।” সমাবেশে বক্তব্য রাখার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল এস ইউ সি আই (সি) দলের পলিটবুরো সদস্য কমরেড সৌমেন বসুকে। তিনি বলেন, ‘‘একদল মানুষ আছেন যারা রাজনীতি থেকে ভাল মানুষদের দূরে থাকার উপদেশ দেন। তাদের কথা মানলে জনগণকে অসৎ দুর্বৃত্তদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। এটাও আসলে এক ধরনের রাজনীতি। যুগ যুগ ধরে পুরুষশাসিত সমাজ নারীকে যেভাবে অবদমিত রেখেছে, তাকে ভেঙে যে রাজনীতি নারীর সত্যিকারের সমানাধিকারের দাবিতে লড়াই করার দিশা দেখাচ্ছে তাকে শক্তিশালী করুন।” তিনি আরও বলেন ‘‘নারী স্বাধীনতার জন্য দেশে যে লড়াই চলছে তাকে দুর্বল করার জন্যই বিজেপি ধর্মের ভিত্তিতে সমাজকে বিভক্ত করতে চাইছে। অন্য দিকে কংগ্রেস নরম হিন্দুত্বের আড়ালে একই কাজ করছে। দেশে যতদিন পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা বহাল থাকবে ততদিন এ জিনিস চলবে। তাই এআইএমএসএস-এর আন্দোলনকে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা উচ্ছেদের লক্ষ্যে পরিচালিত করতে হবে।”
বাংলাদেশ নারীমুক্তি কেন্দ্রের প্রতিনিধিরা আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে এসেছিলেন এবং তাঁদের পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখেন কমরেড সীমা দত্ত। বক্তব্য রাখেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক কমরেড কেয়া দে, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সভাপতি কমরেড সুজাতা ব্যানার্জী প্রমুখ। সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সর্বভারতীয় সভাপতি কমরেড ছায়া মুখার্জী।
এনআরসি, সিএএ-এর প্রতিবাদে একটি প্রস্তাব উত্থাপন ও গৃহীত হয়। প্রায় এক হাজার জনের উপস্থিতিতে ২২-২৩ জানুয়ারি প্রতিনিধি অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় হাওড়া শরৎ সদনে। মূল প্রস্তাব ছাড়াও সংবিধানের ৩৭০ ধারা বিলোপের প্রতিবাদে এবং অসংগঠিত শ্রমিকদের বঞ্চনা নিয়ে দুটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। সংগঠনের সংবিধান নিয়েও আলোচনা করেন প্রতিনিধিবৃন্দ। সম্মেলনে সভাপতি পদে কমরেড কেয়া দে ও সম্পাদক পদে কমরেড ছবি মহান্তি সর্বসম্মতভাবে নির্বাচিত হন। দ্বিতীয় দিনের শেষ অধিবেশনে এস ইউ সি আই (সি)-র সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ নারী আন্দোলন সম্পর্কে মহিলাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য নিয়ে বক্তব্য রাখেন।