২৪ এপ্রিল এসইউসিআই (সি)-র প্রতিষ্ঠা দিবস উপলক্ষে শোষণমুক্তির সংগ্রামের ডাক

পশ্চিমবঙ্গে চাকরি হারিয়ে এই মুহূর্তে ২৬ হাজার শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীর পরিবারে ভয়াবহ সংকট নেমে এসেছে। একই সাথে জনজীবনের উপর কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের নীতির কারণে ভয়াবহ মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, শিক্ষা ও চিকিৎসার ব্যয়বৃদ্ধি, ওষুধের দামবৃদ্ধি, ফসলের দাম না পাওয়া প্রভৃতি একের পর এক আক্রমণে মানুষ বিপর্যস্ত। এই মূল সমস্যা থেকে মানুষের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিতে ধর্মীয় উন্মাদনা ও সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টির অপচেষ্টা করে চলেছে কেন্দ্র এবং রাজ্য–দুই সরকারই। এই দুর্বিষহ অবস্থা থেকে মুক্তির আশায় এ রকম সময়ে মানুষের মনে জন্ম নেয় সংগ্রামের আকাঙক্ষা। সংগ্রামী বামপন্থার শক্তি বৃদ্ধি যে কত জরুরি এই সময়ে দাঁড়িয়েই আরও গভীরে তা উপলব্ধি করা যায়। এই প্রেক্ষাপটেই সামনে এসেছে ২৪ এপ্রিল, সংগ্রামী বামপন্থার শক্তি, ভারতের মাটিতে একমাত্র সাম্যবাদী দল এসইউসিআই (কমিউনিস্ট)-এর ৭৮তম প্রতিষ্ঠা দিবস।

স্বাধীনতা আন্দোলনের আপসহীন ধারার বিপ্লবী কমরেড শিবদাস ঘোষ মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদের শিক্ষার আলোকে দেশের পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছিলেন, স্বাধীনতা অর্জনের মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের হাত থেকে এ দেশের পুঁজিপতিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর হয়েছে। ফলে এই স্বাধীনতায় সাধারণ মানুষের শোষণ মুক্তির আকাঙক্ষা পূরণ হবে না। বরং শোষণের জাঁতাকলে জনগণ আরও বেশি পিষ্ট হবে, সমাজে বাড়বে অনাচার অত্যাচারের মাত্রা। মার্ক্সবাদের আলোকে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন এর হাত থেকে মুক্তির উপায় হল পুঁজিবাদ বিরোধী বিপ্লবের মাধ্যমে শোষণহীন সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা। আর এই বিপ্লব করার জন্য মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদের ভিত্তিতে একটি সঠিক কমিউনিস্ট দল গড়ে তোলা প্রয়োজন। ১৯৪২-৪৫ সালে জেলের অভ্যন্তরেই তাঁর এই উপলব্ধি গড়ে ওঠে। তিনি এ-ও অনুধাবন করেছিলেন যে, তৎকালীন কমিউনিস্ট নামের দলটির প্রতিষ্ঠাতাদের যত আত্মত্যাগ ও সংগ্রামই থাকুক না কেন, পার্টি গঠনের সুনির্দিষ্ট লেনিনীয় পদ্ধতি অনুসরণ না করার ফলে এটি যথার্থ কমিউনিস্ট পার্টি হিসাবে গড়েই উঠতে পারেনি। তাই কমরেড শিবদাস ঘোষ এ দেশের বুকে একটি সত্যিকারের কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের কষ্টসাধ্য সংগ্রাম শুরু করেন। এই সংগ্রামের মধ্য দিয়েই একটি কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের প্রাথমিক শর্তগুলি পূরণ হওয়ার পরে ১৯৪৮ সালের ২৪ এপ্রিল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) দল। সেদিন তাঁর সাথী ছিল মুষ্টিমেয় কয়েকজন সহযোদ্ধা। সম্পূর্ণ সহায় সম্বলহীন অবস্থায় শুরু করে বহু কঠিন পথ পেরিয়ে আজ এই দলটি দেশের প্রায় প্রতিটি প্রদেশে বিস্তৃত। জনগণের দাবি নিয়ে প্রকৃত কমিউনিস্ট দল হিসাবে উন্নত নীতিনৈতিকতা-মূল্যবোধের ভিত্তিতে এই দল একের পর এক আন্দোলন গড়ে তুলছে। সংগ্রামী বামপন্থার শক্তি হিসাবে দলটি শ্রমজীবী জনগণ সহ সমাজের সব অংশের চিন্তাশীল মানুষের মনে আশার আলো জাগিয়ে তুলেছে। শাসক দলগুলির লাগামহীন দুর্নীতি, নীতিহীন আচরণ, পুঁজিপতি শ্রেণির নিরন্তর শোষণ-লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে তীব্র লড়াই গড়ে তুলে ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্যই এই দলকে আরও শক্তিশালী করা দরকার, যা একমাত্র এই লড়াইয়ে সাধারণ মানুষের ব্যাপক অংশগ্রহণের দ্বারাই সম্ভব হতে পারে।

এ বছর ২৪ এপ্রিল এমন একটা সময়ে এসেছে যখন সুপ্রিম কোর্টের রায়ে প্রায় ২৬ হাজার কর্মরত শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীর চাকরি বাতিল হয়েছে। এঁদের অধিকাংশই স্বচ্ছভাবে ও যোগ্যতার ভিত্তিতেই চাকরি পেয়েছিলেন। প্রশ্ন উঠেছে যে, সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ে কি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ লংঘিত হল না? নির্দোষ চাকরিহারাদের পাশে দাঁড়ানোর নামে আগামী বিধানসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে আসরে নেমে পড়েছে নানা সময়ে গদিতে থাকা যে বড় বড় দলগুলি, তারা দলগতভাবে এমনকি দলের প্রভাবিত শিক্ষক সংগঠনের মাধ্যমেও আদালতে নির্দোষদের পাশে দাঁড়াননি। পশ্চিমবঙ্গের একটিমাত্র শিক্ষক সংগঠন এসটিইএ যোগ্যদের পক্ষ নিয়ে লড়েছিল সুপ্রিম কোর্টে।

একই সাথে সামনে আসছে যে জীবনদায়ী ওষুধেও ভেজাল চক্র প্রসারিত সারা দেশে। সাধারণ মানুষ ওষুধের গুণমান নিয়ে উদ্বিগ্ন। এমন একটা সময়েই কেন্দ্রীয় সরকার ৭৪৮টি অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। বিজেপি সরকারের নয়া জাতীয় শিক্ষানীতির মাধ্যমে একদিকে সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার কফিনে শেষ পেরেকটি মেরে দেওয়া হয়েছে, অন্য দিকে শিক্ষাক্রমের মধ্যে নানা ধরনের অন্ধ কুসংস্কার ও কূপমণ্ডুক মানসিকতা আমদানি করে ছাত্রছাত্রীদের যুক্তিভিত্তিক, বিজ্ঞানসম্মত চিন্তার মৃত্যু ঘটানোর আয়োজন হচ্ছে। মুখে বিজেপি-বিরোধিতার কথা বলে রাজ্যের তৃণমূল কংগ্রেস সরকার এই শিক্ষানীতিকেই রাজ্যে কার্যকর করছে। বকেয়া আদায়ের নামে বিদ্যুতের মাশুলের রেকর্ড বৃদ্ধি হয়েছে এবং স্মার্ট মিটার চালু করে সাধারণ মানুষের কষ্টার্জিত টাকা লুঠের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। কৃষিপণ্য বিপণন আইন আনতে যাচ্ছে বিজেপি সরকার, যার মধ্য দিয়ে এমএসপি অস্বীকার করা হচ্ছে এবং কৃষকদের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত কৃষি আইন ফিরিয়ে আনার চেষ্টা হচ্ছে। কৃষকরা তাঁদের ফসলের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না, অথচ চাষের খরচ ক্রমাগত বেড়েই চলেছে।

কৃষিক্ষেত্রকে ধনুকবেরদের মুনাফা লুণ্ঠনের মৃগয়াক্ষেত্রে পরিণত করার প্রচেষ্টা চলছে। রেল সহ সমস্ত পরিষেবা ক্ষেত্রকে বেসরকারি মালিকদের হাতে জলের দরে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। শ্রমকোড চালু করে শ্রমিকদের বহু সংগ্রামলব্ধ অধিকারগুলোকে কেড়ে নিচ্ছে বিজেপি সরকার। সমস্ত চা-বাগান খোলা এবং শ্রমিকদের ন্যূনতম বেতন ঘোষণার প্রশ্নটি চূড়ান্তভাবে উপেক্ষিত। অভয়ার ন্যায়বিচার আজও অধরা। এই বিচারকে কেন্দ্র করে সিবিআই ও বিচারব্যবস্থার নিরপেক্ষতা নিয়েই প্রশ্ন উঠে গেছে। সরকারের প্রত্যক্ষ মদতে মদের ব্যবসা চলছে রমরমিয়ে, নির্যাতিত নারীর আর্তনাদ এবং বেকার যুবকের দীর্ঘশ্বাস আজ বাতাস ভারী করে তুলছে। স্বাভাবিকভাবেই সাধারণ মানুষের মধ্যে বেড়ে চলেছে অসন্তোষ। তার বহিঃপ্রকাশও হচ্ছে নানা জায়গায়। এই অসন্তোষ যাতে সংগঠিত আন্দোলনের আকারে ফেটে পড়তে না পারে তাই শোষণের জাঁতাকলে পিষ্ট জনগণের ঐক্যে ফাটল ধরাতে শাসকশ্রেণির দল ও শক্তিগুলি জাত-পাত ও সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ফেনিয়ে তুলছে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে গাজায় নৃশংস হত্যাকাণ্ড সহ সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন ভয়াবহতার নতুন নজির সৃষ্টি করেছে। এই কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, সমাজতান্ত্রিক শিবিরের অনুপস্থিতির জন্যই আজ সাম্রাজ্যবাদের এই আগ্রাসন সম্ভব হতে পারছে।

এসইউসিআই(কমিউনিস্ট) দল গঠনের সূচনা পর্ব থেকেই কমরেড শিবদাস ঘোষ এই শিক্ষাই দিয়ে গেছেন যে, সঠিক নেতৃত্বে গণআন্দোলনের মধ্য দিয়েই এই সমস্ত রকমের সঙ্কট থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। তিনি এই শিক্ষাও দিয়েছেন যে, এই আন্দোলনগুলোকে এমনভাবে সংগঠিত করতে হবে যাতে সাধারণ মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা গড়ে তোলা যায় এবং শেষ পর্যন্ত বিপ্লবের আঘাতে শোষণমূলক এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে শোষণহীন সমাজতান্ত্রিক সমাজ গড়ে তোলা যায়। এটাই ইতিহাস নির্ধারিত পথ। এই পথ অনুসরণ করেই এই দল লড়াই করে চলেছে। অন্যান্য বামপন্থী নামধারী দলগুলি যখন সংস্কারবাদী, সংসদীয় পথের কানাগলিতে আন্দোলনকে নিয়ে যেতে চাইছে, এসইউসিআই(সি) তুলে ধরছে সংগ্রামী বামপন্থার লাইন।

এই পরিপ্রেক্ষিতেই আগামী ২৪ এপ্রিল দলের ৭৮তম প্রতিষ্ঠা দিবসে শহিদ মিনার ময়দানে আহ্বান করা হয়েছে জন সমাবেশের। আজকের দিনের পরিস্থিতিতে জনসাধারণ এবং বামপন্থী কর্মীদের সামনে তাঁদের কর্তব্য তুলে ধরে বক্তব্য রাখবেন গণআন্দোলনের দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ দলের সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ। সভাপতিত্ব করবেন দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কমরেড মানব বেরা। এই উপলক্ষে সভাস্থলে আয়োজন করা হয়েছে মহান নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষার উদ্ধৃতি প্রদর্শনীর, যা উদ্বোধন করবেন পলিটবুরোর প্রবীণ সদস্য কমরেড গোপাল কুণ্ডু। এই সমাবেশে উপস্থিত হওয়ার জন্য ও সবরকমের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য জনসাধারণের কাছে আহ্বান জানাচ্ছে দলের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি।