আর জি করের চিকিৎসক-ছাত্রীর নৃশংস খুন-ধর্ষণের ঘটনায় জনমনে যে আগুন জ্বলে উঠেছিল তা কি নিভে এল? কোনও কোনও মহল থেকে বলা হচ্ছে, এটা ছিল মধ্যবিত্তের আন্দোলন। কিন্তু বাস্তবে আন্দোলনটা কি শুধু মধ্যবিত্তের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল? তা কি বৃহৎ অংশের মানুষকে স্পর্শ করতে পারেনি? এমন সব প্রশ্নের উত্তর মিলল ২১ জানুয়ারি মহামিছিলের প্রচার করতে গিয়ে।
উত্তর কলকাতার একটি মধ্যবিত্ত এলাকায় প্রচার চলছিল। প্রচারপত্রে প্রথমে রয়েছে অভয়া কাণ্ড সহ স্বাস্থ্য-শিক্ষা ব্যবস্থায় দুর্নীতি ও থ্রেট কালচারে জড়িত অপরাধীদের বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি। লিফলেটটি হাতে নিয়েই এক ব্যক্তি বলে উঠলেন, কী ভেবেছে সরকার আর সিবিআই? ভেবেছে এই ভাবে খুনিদের আড়াল করবে? পারবে না। আপনারা মিছিলের ডাক দিয়ে একটা অত্যন্ত জরুরি কাজ করেছেন।
প্রচার টিম পাশের বসতিতে গিয়ে ঢুকতে প্রায় প্রতিটি পরিবারের কেউ না কেউ বললেন, আমি তো অভয়ার ন্যায়বিচারের দাবিতে রাত জেগেছি। কেউ বললেন, আমার পরিবার সহ গোটা পাড়া গিয়েছি মিছিলে। বাস্তবিকই মধ্যবিত্তের সাথে নিম্নবিত্ত, দরিদ্র মানুষের ব্যাপক অংশগ্রহণ ছাড়া আর জি কর আন্দোলন এত বৃহৎ, এত দীর্ঘস্থায়ী এবং দেশ-বিদেশে এত প্রভাব ফেলতে পারত না। এই ব্যাপক অংশের মানুষের অংশগ্রহণ এক দিকে যেমন অভয়ার উপর নৃশংসতার বিচার চেয়ে, তেমনই সাধারণ মানুষের, দরিদ্র মানুষের, শোষিত, প্রবঞ্চিত মানুষের প্রতিদিনের ক্ষোভ, বঞ্চনার যন্ত্রণাও মিশে রয়েছে এই বিচার চাওয়ার মধ্যে। অভয়ার ন্যায়বিচারের দাবির মধ্যে সাধারণ মানুষ তাঁদের উপর প্রতিদিন ঘটে চলা অসংখ্য অন্যায়-অবিচারের ন্যায়বিচারের আশা খুঁজে পেয়েছেন। তাই তাঁরা আন্দোলনের সঙ্গে এতখানি একাত্ম হতে পেরেছেন।
বাস্তবিক মূল্যবৃদ্ধি, বেকারি, সীমাহীন দুর্নীতি, সন্ত্রাস, মদ ও মাদকের প্রসার, নারীত্বের অবমাননা প্রভৃতি নিয়ে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ-যন্ত্রণার ছোট ছোট ঢেউগুলো মিশে গিয়েই আন্দোলনের এই জোয়ার তৈরি করেছে। আজ যখন এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) আর জি কর আন্দোলনের দাবির সঙ্গে জীবনের অন্য দাবিগুলিকে মিলিয়ে মহামিছিলের ডাক দিয়েছে তখন মানুষ এই মিছিলকে তাঁদের নিজেদের বাঁচার দাবিতে আন্দোলন বলেই মনে করেছে। মিছিল সফল করতে তাই তাঁরাও উদ্যোগ নিচ্ছেন। একজন বললেন, আমি অতি সাধারণ মানুষ। আপনাদের মতো করে আন্দোলনের কথাগুলো হয়ত বলতে পারব না, কিন্তু পাড়ার কিছু মানুষকে আমি জুটিয়ে দেব, আপনারা আসুন, তাদের মধ্যে এই কথাগুলো বলবেন।
বিজেপি সহ তথাকথিত বিরোধী দলগুলি আন্দোলনের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নিয়ে তাকে নির্বাচনী রাজনীতির স্বার্থে কাজে লাগানোর চেষ্টা করলেও অভয়ার ন্যায়বিচারের দাবিতে আন্দোলনের প্রতি সাধারণ মানুষের এই আবেগই সেই চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়েছে। এই ব্যর্থতা থেকেই জনমনে বিভ্রান্তি ছড়াতে এরা প্রচার করে চলেছে যে, আন্দোলন করে কী লাভ হল, দাবি তো আদায় হল না। এই প্রচার তাদের জনস্বার্থবিরোধী চরিত্রকেই তুলে ধরেছে। সবাই জানেন, আন্দোলনের চাপে চরম উদ্ধত তৃণমূল সরকার যেমন আন্দোলনকারী জুনিয়র চিকিৎসকদের সঙ্গে বৈঠকে বসতে বাধ্য হয়েছে, তেমনই আন্দোলনের চাপেই মেডিকেল কলেজগুলিতে থ্রেট-কালচারের বিরুদ্ধে, দুর্নীতি প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছে। যদিও আন্দোলন জারি রেখেই সেই সব প্রতিশ্রুতি পালনে সরকারকে বাধ্য করতে হবে। শাসক দলগুলি তাদের কার্যকলাপের দ্বারা সাধারণ মানুষের মধ্যে যে হতাশার জন্ম দিয়েছে এই আন্দোলন সেই হতাশাকে অনেকখানি ঝেড়ে ফেলতে সাহায্য করেছে। জনমনে জন্ম দিয়ে গেছে অদ্ভূত এক প্রতিবাদী সত্তার।
সরকারের চোখে চোখ রেখে কথা বলার, দাবির কথা ঘোষণা করার যে স্পর্ধা মানুষ দেখিয়েছে তা কি এই আন্দোলনের কম অর্জন! জীবন-যন্ত্রণার বিরুদ্ধে যাঁদের প্রতিদিন লড়াই করতে হয়, কর্মস্থলে যাঁদের প্রতিদিন অজস্র প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়, অপমান সহ্য করতে হয়, তাদের এই অর্জন বুঝতে কোনও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। এই অর্জনকে তারাই অস্বীকার করতে চায় যারা এই স্থিতাবস্থার সুবিধা ভোগ করছে, যারা এই স্থিতাবস্থাকে রক্ষা করতে চায়, শোষণ-বঞ্চনাকে স্থায়ী করতে চায়। অন্য দিকে যাঁরা এর অবসান চান তাঁরা বুঝবেন, প্রতিপক্ষ এখানে কতখানি শক্তিশালী এবং আন্দোলন সেই অচলায়তনকে কতখানি ধাক্কা দিয়েছে। একদিকে রাজ্য ও কেন্দ্র সরকার, পুলিশ-সিবিআই, বিচার ব্যবস্থা, সুবিধাভোগী নানা কায়েমি শক্তি, তার সাথে আগের সরকারের আমলের ঔদ্ধত্য ও অপশাসনের ধারাবাহিকতা, আর তার বিপরীতে কোটি কোটি শোষিত নির্যাতিত বঞ্চিত সাধারণ মানুষ, যাদের সম্বল সততা, নিষ্ঠা এবং ন্যায়বিচার আদায়ের অদম্য আকাঙক্ষা। সম্পূর্ণ দাবি আদায়ের জন্য তাই দরকার আন্দোলনকে আরও সচেতন, সংঘবদ্ধ ও দীর্ঘস্থায়ী করা। এই আন্দোলন ইতিমধ্যেই মানুষের মধ্যে যে চেতনা, যে স্পর্ধার জন্ম দিয়েছে তা-ই আন্দোলনকে আরও বহু দূর পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে যাবে, সমস্ত বিভ্রান্তি, হতাশা থেকে রক্ষা করবে। ছিনিয়ে নেবে ন্যায়বিচারের দাবি, যা আসলে মানুষের বাঁচার দাবি।
পাশাপাশি লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধি মানুষের জীবনকে জেরবার করে দিচ্ছে। অথচ তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কোনও চেষ্টা রাজ্য কিংবা কেন্দ্র কোনও সরকারের নেই। ফাটকাবাজি, কালোবাজারি অবাধে চলছে। সর্বত্রই মানুষ এ-সবের বিরুদ্ধে তাঁদের ক্ষোভ উগরে দিচ্ছেন। মূল্যবৃদ্ধি রোধ মিছিলের অন্যতম দাবি হিসাবে থাকায় মানুষ মিছিলকে দু-হাত তুলে সমর্থন করছেন। একই ভাবে মিছিলের দাবি হিসাবে উঠে এসেছে কৃষকের ফসলের ন্যায্য দাম পাওয়ার বিষয়টি– যা রাজ্য ও কেন্দ্রের সরকার কৃষিপণ্যের একচেটিয়া ব্যবসায়ীদের হাতেই ছেড়ে দিয়েছে। কেন্দে্রর শাসক বিজেপি নতুন করে যে কৃষি-বাণিজ্য সংক্রান্ত আইন আনছে তা কৃষকদের সর্বনাশকে আরও বাড়িয়ে তুলবে। যে নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি তারা নিয়ে এসেছে, তা শিক্ষাকে সম্পূর্ণ বেসরকারি মালিকদের ব্যবসার পণ্যে পরিণত করবে, অন্য দিকে শিক্ষার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি সম্পূর্ণ ধ্বংস করে তাতে অবৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার আমদানি ঘটাবে। নতুন শ্রমনীতি যেমন শ্রমিকদের সমস্ত গণতান্ত্রিক অধিকারগুলিকে কেড়ে নেবে, আট ঘণ্টা কাজের রীতি বাতিল করে মালিকদের হাতে যতক্ষণ খুশি খাটানোর অধিকার তুলে দেবে, তেমনই নতুন বিদ্যুৎনীতিও সাধারণ মানুষের উপর বাড়তি বোঝা চাপাবে আর বিদ্যুৎ ব্যবসায়ীদের অবাধ লুঠের ব্যবস্থা করে দেবে। চা-শ্রমিকদের দুরবস্থা আগের সরকারের মতোই বর্তমান সরকারের আমলেও একই রকম ভাবে বেড়ে চলেছে। মহিলাদের উপর অত্যাচার, ধর্ষণ-খুন বেড়েই চলেছে। বেকারত্ব আকাশ ছুঁয়েছে। সব সরকারের সব প্রতিশ্রুতি বেকারদের প্রতি চরম প্রতারণা বলে প্রমাণিত হয়েছে।
আজ আন্দোলন ছাড়া জনগণের হাতে আর কোনও বিকল্প নেই। অথচ রাজ্যের তথাকথিত বিরোধী দলগুলি জনজীবনের সমস্যা নিয়ে আন্দোলনের পরিবর্তে, কী ভাবে মানুষের ক্ষোভকে ভোটের কাজে লাগানো যায় সেই চিন্তাতেই মশগুল। এই অবস্থায় এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-এর লাগাতার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এই মহামিছিলের ডাক জনমনে প্রবল আলোড়ন তুলছে।