একটি সফল গণঅভ্যুত্থান অথবা একটি সেনা বিদ্রোহের ঘটনা শোষক শ্রেণিকে এক ধাক্কায় ক্ষমতাচ্যুত করে দিতে পারে। কিন্তু খুবই বিরল ও বিশেষ ক্ষেত্র বাদে কখনওই এক ধাক্কায় শোষক শ্রেণিকে ধ্বংস করে দেওয়া যায় না। কোনও বৃহৎ দেশে একই সঙ্গে সমস্ত জমির মালিক ও পুঁজিপতির স্বত্ব বিলোপ ঘটানো অসম্ভব। অধিকন্তু আইন করে বা রাজনৈতিকভাবে শুধুমাত্র স্বত্ব বিলোপ হলেই বিষয়টির চূড়ান্ত মীমাংসা হয়ে যায় না। কারণ বাস্তবে জমির মালিক ও পুঁজিপতিদের উচ্ছেদ করতে হলে কলকারখানায় এবং জমিতে বা কৃষিতে তাদের পরিচালন ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে, তার স্থানে ভিন্ন পরিচালন ব্যবস্থা শ্রমিক শ্রেণির বাস্তবে গড়ে তোলা প্রয়োজন। শোষক সম্প্রদায়, যারা বহু প্রজন্ম ধরে শিক্ষার সুযোগ পেয়েছে, বৈভবের জীবন ও অভ্যাসের মধ্যে সুখে দিন কাটিয়েছে এবং শোষিত সম্প্রদায়, যারা অধিকাংশই এমনকি অত্যন্ত উন্নত ও সবচেয়ে গণতান্ত্রিক বুর্জোয়া রাষ্ট্রেও উৎপীড়িত, পশ্চাৎপদ, অশিক্ষিত, লাঞ্ছিত ও অসংগঠিত জীবন অতিবাহিত করছে– সেই শোষক ও শোষিত সম্প্রদায় কখনও সমান হতে পারে না। বিপ্লবের পরেও বহুদিন ধরে শোষক শ্রেণির আয়ত্তে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বাস্তব ক্ষমতা ও সুযোগ অনিবার্য ভাবেই থেকে যায়। তখনও তাদের হাতে থেকে যায় অর্থসম্পদ (যেহেতু মুদ্রার বিলোপ সঙ্গে সঙ্গে ঘটানো সম্ভব নয়)। কিছু অস্থাবর সম্পত্তি–যার পরিমাণ প্রায় ক্ষেত্রেই নেহাত কম নয়। তখনও বিভিন্ন ধরনের যোগাযোগ, সংগঠন ও পরিচালন ক্ষেত্রে ব্যুৎপত্তি, পরিচালনব্যবস্থার সব রকম ‘গোপন’ (রীতি পদ্ধতি, উপায় ও সম্ভাবনা) বিষয়ে জ্ঞান ও উচ্চতর শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে তারা বিরাজ করে।
প্রশাসনের উচ্চ মহলে আমলাদের সঙ্গে (জীবনযাত্রা ও চিন্তায় যারা বুর্জোয়াদেরই অনুরূপ) ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ, যুদ্ধের কলা-কৌশল (এই বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ) সম্পর্কে সর্বহারাদের তুলনায় অনেকগুণ বেশি অভিজ্ঞতা এবং এ জাতীয় আরও কিছু ক্ষমতা শোষক শ্রেণির থেকে পায়।
এই প্রেক্ষাপটে প্রকৃত যুগান্তকারী একটি বিপ্লবে জয়-পরাজয়ের গুরুতর প্রশ্নটি নিছক সংখ্যার ভিত্তিতে অর্থাৎ, বিপ্লবের পক্ষের শক্তি সংখ্যাগরিষ্ঠ, না সংখ্যালঘু– তা দিয়েই নির্ধারিত হয়ে যায়, এ কথা মনে করা চূড়ান্ত মুর্খামি। এ হল অত্যন্ত সাধারণ স্তরের একজন উদার-নীতিকের নিতান্তই বদ্ধমূল ছেঁদো ধারণা। আসলে জনগণকে প্রতারণার উদ্দেশ্যে এর দ্বারা সুপ্রতিষ্ঠিত একটি ঐতিহাসিক সত্যকে আড়াল করার চেষ্টা হয়। প্রতিটি যুগান্তকারী বিপ্লবেই রাষ্ট্রক্ষমতা হারানোর পর শোষকেরা বহু বছর ধরে শোষিতের চেয়ে বাস্তবে যে অনেক বেশি ক্ষমতা ও সুবিধা আয়ত্তে রেখে দেয়, বিপ্লবের বিরুদ্ধে তারা যে দীর্ঘকাল, মরিয়া ও বেপরোয়া প্রতিরোধ চালায়, এটাই যে প্রতিটি বিপ্লবে ঘটে, এটাই যে নিয়ম– এই ঐতিহাসিক সত্যকে আড়াল করার চেষ্টা হয়। শোষকেরা তাদের সুযোগ-সুবিধাকে ব্যবহার করে ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার জন্য একবার নয়, বারবার বেপরোয়া চেষ্টা চালায়। শেষ লড়াই না লড়ে তারা কখনওই সংখ্যাগরিষ্ঠ শোষিত শ্রেণির সিদ্ধান্তের কাছে নতি স্বীকার করে না। (প্রোলেটারিয়ান রেভলিউশন অ্যান্ড রেনিগেড কাউটস্কি – লেনিন)
… (সর্বহারা) এই একনায়কতন্ত্র বলতে বোঝায় শোষকশ্রেণি, পুঁজিপতি, জমির মালিক ও তাদের তাঁবেদারদের প্রতিরোধকে চূর্ণ করার জন্য অত্যন্ত কঠোর, দ্রুত ও দৃঢ় বলপ্রয়োগ। সর্বহারা একনায়কত্বের এই তাৎপর্য অনুধাবনে যিনি অক্ষম তিনি বিপ্লবী নন এবং তাকে সর্বহারা শ্রেণির নেতৃত্ব ও উপদেষ্টা পদ থেকে অবশ্যই অপসারিত করতে হবে।
কিন্তু শুধু বলপ্রয়োগ সর্বহারা একনায়কত্বের মূল কথা নয়, এমনকি এটি তার প্রধান বৈশিষ্ট্যও নয়। শ্রমজীবী মানুষের সবচেয়ে সচেতন অংশ, তাদের অগ্রগামী বাহিনী তাদের একমাত্র নেতা যে সর্বহারা শ্রেণি– যাদের লক্ষ্য সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, সমাজে শ্রেণিবিভেদের অবলুপ্তি ঘটানো, সমাজের সমস্ত মানুষকে শ্রমজীবীতে রূপান্তরিত করা এবং মানুষের দ্বারা মানুষের শোষণের ভিত্তি অপসারিত করা– সেই সর্বহারা শ্রেণির সংঘশক্তি ও শৃঙ্খলাই হল সর্বহারা একনায়কত্বের মূল বৈশিষ্ট্য। এই লক্ষ্য এক ধাক্কায় অর্জিত হতে পারে না। এর জন্য দরকার পুঁজিবাদ থেকে সাম্যবাদে উত্তরণের বেশ দীর্ঘ এক অন্তর্বর্তী পর্যায়। কারণ, উৎপাদন ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস ঘটানো দুরূহ বিষয়, জীবনের সমস্তক্ষেত্রে অমূল পরিবর্তন সাধন এক দীর্ঘ সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া এবং পেটিবুর্জোয়া ও বুর্জোয়া পদ্ধতিতে বিভিন্ন বিষয় পরিচালনার অভ্যাসের যে প্রবল শক্তি, তার হাত থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য প্রয়োজন এক দীর্ঘ ও অবিচল সংগ্রাম। এই কারণেই মা’র্ সর্বহারা একনায়কত্বের সমগ্র পর্যায়টিকে পুঁজিবাদ থেকে সাম্যবাদে উত্তরণের অন্তর্বর্তী পর্যায় বলেছিলেন।
সমগ্র এই অন্তর্বর্তী পর্যায় ধরেই পুঁজিপতি শ্রেণি এবং বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে তাদের অসংখ্য সেবাদাসরা সচেতনভাবেই বিপ্লবের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ চালিয়ে যাবে। অপরদিকে পেটিবুর্জোয়া অভ্যাস ও ঐতিহ্যের শৃঙ্খলে বাঁধা চাষি সহ শ্রমজীবী মানুষের এক বিরাট অংশ প্রায়শই অসচেতনভাবে বিপ্লবকে বাধা দেবে। এইসব গোষ্ঠীগুলির মধ্যে দোদুল্যমানতা অবশ্যম্ভাবী। একজন শ্রমজীবী মানুষ হিসাবে চাষি সমাজতন্ত্রের প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং বুর্জোয়া একনায়কত্বের চেয়ে শ্রমিক শ্রেণির একনায়কত্বকেই পছন্দ করে। কিন্তু আবার সেই চাষিই যখন শস্যের বিক্রেতা, তখন সে বুর্জোয়া শ্রেণির প্রতি টান অনুভব করে, অবাধ বাণিজ্যের স্বাধীনতা পেতে চায়, অর্থাৎ সেই ‘অভ্যস্ত’, পুরনো, ‘শাশ্বত মহামান্বিত’ পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ফিরে যেতে চায়।
(গ্রিটিংস টু দি হাঙ্গেরিয়ান ওয়ার্কার্স– লেনিন)