১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগে চারদিক ঘিরে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালিয়ে যে গণহত্যা চালিয়েছিল, সেখানে হাজার হাজার স্বাধীনতাকামী মানুষ শহিদ হয়েছিলেন। যা দেখে শিউরে উঠেছিলেন দেশের আপামর জনসাধারণ। শপথ নিয়েছিলেন ভগত সিং, বয়স তখন তাঁর ১২। নাইট উপাধি ত্যাগ করেছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের এই বর্বর গণহত্যার বিরুদ্ধে অসংখ্য ছাত্র যুবক বিপ্লবী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাঁরা স্বপ্ন দেখেছিলেন স্বাধীন ভারতে পুলিশী অত্যাচার থাকবে না, মানুষ অন্ন-বস্ত্র-শিক্ষা পাবে। কিন্তু স্বাধীন ভারতে সেই স্বপ্ন অধরাই থেকে গেল। নেতাজির ভাষায় সাদা চামড়ার শাসকের জায়গায় বসল কালো চামড়ার শাসক।
এই ঘটনার ঠিক ৪০ বছর পর স্বাধীন ভারতে এই বাংলায় খাদ্যের দাবিতে ভুখা মানুষ প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে কলকাতায় জড়ো হয়। কলকাতার রাজপথে হাজারে হাজারে মানুষ ‘খাদ্য চাই খাদ্য দাও’ এই স্লোগান দিতে দিতে যখন ধর্মতলা অভিমুখে মিছিল দৃপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে চলছিল। তখন পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের পুলিশ জালিয়ানওয়ালাবাগের কায়দায় চারদিক থেকে ঘিরে ভুখা মানুষের উপর লাঠি ও গুলিবর্ষণ শুরু করল। হাজার হাজার মানুষ রক্তাক্ত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। ২০০ জনেরও বেশি গরিব কৃষক, মজুর, ছাত্র-যুবক, শিশু শহিদ হলেন। মৃত্যুর সংখ্যা কম দেখানোর জন্য বহু লাশ গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দেওয়া হল। গঙ্গার জল রক্তে লাল হয়ে গেল। ৮০ জনের মৃতদেহ পাওয়া গেল। প্রতিবাদে স্তব্ধ হল বাংলা! নেতাজি ক্ষুদিরামের উত্তরসূরী এ বাংলার বামপন্থী গণতন্ত্রপ্রিয় ছাত্র যুব সমাজ তীব্র প্রতিবাদে, ঘৃণায় ও ক্ষোভে ফেটে পড়ল। পরের দিন ১ সেপ্টেম্বর পশ্চিমবাংলার প্রান্তে প্রান্তে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ সংঘটিত হল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের লনে হাজারে হাজারে প্রতিবাদী ছাত্র জমায়েত হলেন। জামার বোতাম খুলে দৃপ্ত পদক্ষেপে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের লন থেকে ছাত্ররা সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো মিছিল নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের বাড়ির দিকে এগোতে থাকল। মিছিল ওয়েলিংটন স্কোয়ারের কাছাকাছি আসতেই আবারও কংগ্রেসী সরকারের পুলিশ ছাত্রদের বুক লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ শুরু করল। ৮ জন তরতাজা ছাত্র শহিদের মৃত্যু বরণ করলেন। শোকস্তব্ধ ছাত্রসমাজ প্রতিবাদের শপথ নিল। প্রতিবাদ জানালেন ছাত্র-শিক্ষক অধ্যাপক ও পশ্চিমবাংলার গণতন্ত্রপ্রিয় সাধারণ মানুষ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টর ডক্টর ত্রিগুণা সেন ঘৃণায় ক্ষোভে কালো পতাকা উত্তোলন করলেন এবং বাংলার ছাত্র সমাজকে এই বর্বরতার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানালেন। বঙ্গবাসী কলেজের প্রিন্সিপাল অধ্যাপক প্রশান্ত বসু শহিদ বেদিতে মাল্যদান করে বক্তব্য রাখেন। সিটি কলেজ, বিদ্যাসাগর কলেজ সহ সমস্ত জায়গায় ছাত্র-শিক্ষকরা মিলে গভীর আবেগের সঙ্গে এই শহিদদের স্মরণের পাশাপাশি এই অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার শপথ নিলেন।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই দিনটি সাধারণ গরিব মানুষের উপর অন্যায় অত্যাচার অবিচারের বিরুদ্ধে, শিক্ষার উপর আক্রমণ প্রতিরোধ করতে অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়ার লক্ষে্য ছাত্রশহিদ দিবস হিসাবে পালিত হচ্ছে। দিনটিকে স্মরণ করে ছাত্ররা শপথ নিচ্ছে যে-কোনও অন্যায়-অত্যাচার, শিক্ষা সংহারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য। তারই অঙ্গ হিসাবে প্রতি বছর ছাত্র যুব সাধারণ মেহনতি মানুষ ৩১ আগস্ট ও ১ সেপ্টেম্বর শহিদ দিবস হিসাবে স্মরণ করে আসছেন। কংগ্রেসী জামানার পতনের পরে যখন এ রাজ্যে সিপিএম ফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় এল তখনও ১৯৯০ সালের ৩১ আগস্ট বাসভাড়া বৃদ্ধি প্রতিরোধ আন্দোলনে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতিবাবুর নির্দেশে ‘নিরামিষ আন্দোলনকে আমিষ করতে’ সিপিএমের পুলিশ আন্দোলনকারীদের বুক লক্ষ্য করে গুলি চালাল। ৩৪ জন গুলিবিদ্ধ হন এবং শহিদ হন কিশোর কর্মী মাধাই হালদার। আবারও পশ্চিমবাংলার ছাত্রসমাজ ক্ষোভে ফেটে পড়েন। পরের দিন ১ সেপ্টেম্বর পশ্চিমবাংলার প্রতিটি কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ক্ষোভে ফেটে পড়েন।
যেদিনে গণআন্দোলনের ইতিহাসে পুলিশ বাহিনী কলঙ্কিত অধ্যায় রচনা করেছিল সেই দিনটিকেই এ রাজ্যের বর্তমান তৃণমূল সরকারের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী পুলিশকে তুষ্ট করতে ‘পুলিশ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করলেন। আর এই দিবস ঘোষণার মধ্যে দিয়ে পুলিশের বর্বরতাকে মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী স্বীকৃতি দিয়ে চূড়ান্ত স্বৈরাচারী ভূমিকা প্রকাশ করলেন। যা দেশে দেশে শাসকের নগ্ন ঘৃণ্য চরিত্রই প্রকাশ করল, যার সঙ্গে পরাধীন ভারতের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের পুলিশ কিংবা কংগ্রেস, সিপিএম, বিজেপির পুলিশের কোনও পার্থক্য থাকল না। তাই ছাত্র শহিদ দিবসকেই বেছে নিতে হল ‘পুলিশ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করার। সরকারের এমন আচরণকে ধিক্কার জানাই। আসুন এর প্রতিবাদে সোচ্চার হই।