১ শতাংশ ধনকুবেরের হাতে দরিদ্রতম ৭০ শতাংশ মানুষের মোট সম্পদের চার গুণ
এই কুৎসিত বৈষম্য পুঁজিবাদের সৃষ্টি
ভারতের মাত্র ১ শতাংশ ধনকুবেরের হাতে রয়েছে দেশের ৯৫.৩ কোটি মানুষের হাতে থাকা সম্পদের চার গুণেরও বেশি। অর্থাৎ নিচুতলার ৭০ শতাংশ নাগরিকের মোট সম্পদের চার গুণেরও বেশি সম্পদ রয়েছে ১ শতাংশ ধনকুবেরের হাতে। এ দেশে ধনবৈষম্যের এমন ভয়ানক চিত্র প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক সংগঠন অক্সফ্যাম।
বিশ্বের অবস্থাটা কী? বিশ্বের ২১৫৩ জন প্রথম সারির ধনকুবেরের হাতে রয়েছে দরিদ্রতম ৪৬০ কোটি (সারা পৃথিবীর জনসংখ্যার ৬০ শতাংশ) মানুষের মোট সম্পদের চেয়েও বেশি। জানা গেছে, গত এক দশকে বিশ্বে ধনকুবেরদের (যাদের সম্পত্তির পরিমাণ ১০০ কোটি মার্কিন ডলার অর্থাৎ ৭ হাজার ১২৭ কোটি টাকা বা তার বেশি) সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে।
সারা বিশ্বেই এই আর্থিক বৈষম্য ক্রমশ বেড়েই চলেছে। এর কারণ কী? মূল্যবৃদ্ধি, বেকারি, কর্মসংকোচন, দুর্নীতি ইত্যাদি নানা কারণ থাকলেও এর মূল কারণ বতর্মান পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা। পুঁজি যত একচেটিয়া স্তরে পৌঁছেছে তার শোষণ ততই নির্মম হয়েছে। যে ব্যবস্থার ফলেই শিল্পপতিরা বা পুঁজিপতি শ্রেণি সম্পদের এমন নির্বিচার, নির্মম লুঠতরাজ চালাতে পেরেছে। এরই পরিণতিতে দেশের সিংহভাগ মানুষ নিঃস্ব হয়েছে আর মুষ্টিমেয় ধনীর-পুঁজিপতির-শিল্পপতির পুঁজির পাহাড় ক্রমশ আরও উঁচু হয়ে চলেছে। ভারতে আম্বানি-আদানিদের মতো একচেটিয়া পুঁজিপতি আর বৃহৎ ব্যবসায়ীরা সরকারি সহায়তায়সাধারণ মানুষের উপর শোষণের স্টিমরোলার চালাচ্ছে। ৯৯ শতাংশ মানুষের শ্রমের ফসল চুরি করে মুনাফার পাহাড়কে গগনচুম্বী করে তুলছে। অন্য দিকে ভুখা মরছে ফুটপাতবাসী। কৃষক ঋণের জ্বালায় আত্মহত্যা করতে বাধ্য হচ্ছে। শ্রমিক ছাঁটাই হয়ে ভবঘুরে হয়ে যাচ্ছে। সন্তানদের মুখে খাবার দিতে না পারার যন্ত্রণায় গৃহবধূরা রাস্তায় দেহ বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। অপুষ্টিতে, শিশুমৃত্যুতে দেশ বিশ্বে শীর্ষে। সরকারগুলির কোনও হেলদোল নেই। তারা পুঁজিবাদী এই ব্যবস্থার ম্যানেজার হিসাবে কাজ করছে। কখনও কংগ্রেস, কখনও বিজেপি– পুঁজিমালিকদের পক্ষে এবং জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে একের পর এক নীতি নিচ্ছে, জল-জমি-জঙ্গল বিক্রি করে দিচ্ছে ধনকুবেরদের কাছে, রাষ্ট্রায়ত্ত লাভজনক সংস্থাগুলি যা জনসাধারণের বহু শ্রমে গড়ে উঠেছিল তা তুলে দিচ্ছে কর্পোরেটদের হাতে। কৃষকের-শ্রমিকের চোখের জলের কোনও মূল্য নেই তাদের কাছে। গরিবের মানুষ হিসাবেও স্বীকৃতি নেই। তার একমাত্র পরিচয় সে পুঁজিপতি শ্রেণির মুনাফা উৎপাদনের যন্ত্র।
একসময় ইন্দিরা গান্ধী ‘গরিবি হটাও’ স্লোগান তুলেছিলেন। তাতে গরিবি দূর হয়নি, বরং ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য আরও বেড়েছে। বিজেপি তথা নরেন্দ্র মোদির ‘সব কা সাথ, সব কা বিকাশ’ স্লোগানও বাস্তবে ছিল গরিব, পিছিয়ে পড়া মানুষের সাথে প্রতারণা। তাদের বিকাশ তো ঘটেইনি, সরকারের জনবিরোধী নীতিতে বিনাশ ঘটছে। গরিব আরও গরিব হচ্ছে, ধনী পরিণত হচ্ছে ধনকুবেরে। সরকার সাধারণ মানুষের জন্য বাজেটে যা বরাদ্দ করে একবছরের জন্য, তার থেকেও বেশি ভোগ করে ভারতের মাত্র ৬৩ জন ধনকুবের। সম্প্রতি প্রকাশিত অক্সফ্যামের রিপোর্টই এর প্রমাণ– ভারতে ৬৩ জন ধনকুবেরের মোট সম্পদ ২০১৮-১৯ অর্থবর্ষের বাজেটের (২৪.৪২ লক্ষ কোটি টাকা) চেয়ে বেশি।
সরকারের এক দল তাঁবেদার, সরকারের প্রসাদ কুড়িয়ে জীবন ধারণ করেন, তারা এই ব্যবস্থাকে সাধারণ মানুষের কাছে সহনীয় করে তুলতে এর মহত্ত্ব ব্যাখ্যা করে থাকেন। এই ভয়ঙ্কর বৈষম্য তারা দেখেও দেখতে পান না! মুমুর্ষু পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় তীব্র বাজার সংকটের দাওয়াই হিসাবে নানা টোটকার কথা বলে থাকেন (নিজেরাও বিশ্বাস করেন কি না বলা শক্ত)। তাঁরা বলেন, বর্তমান (পুঁজিবাদী) বাজারকে আপন নিয়মে তার মতো চলতে দিলে নাকি সকল অংশের মানুষের কাছে উন্নয়নের সুফল পৌঁছে যাবে। তাঁরা বলেন এই সুফল প্রথমে উপরের অংশের কাছে পৌঁছলে তার থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে নিচের অংশে পৌঁছবে। কিন্তু বাস্তবে পৌঁছয় না। সমাজটা যে শ্রেণিবিভক্ত, শোষণযন্তে্রর মালিকানা যে পুঁজিমালিক-শিল্পমালিকদের হাতে (ধনী-দরিদ্রে তথা শোষক-শাসকে) তা তারা স্বীকার করেন না। তারা ভুলেও বলেন না, পুঁজিবাদী এই ব্যবস্থায় আর্থিক বৈষম্য অনিবার্যভাবে তীব্র হবে, ১ শতাংশ ধনকুবেরের আরও উন্নয়ন হবে, ৯৯ শতাংশ সাধারণ মানুষ দারিদ্রের অতলে তলিয়ে যাবে। ভুলেও তারা উচ্চারণ করেন না, এই ভয়ঙ্কর আর্থিক বৈষম্য, দুঃসহ বেকারি, আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি– এ সমস্তই এই পুঁজিবাদী সমাজের অনিবার্য পরিণতি। পুঁজিপতিদের মুনাফা-লালসার কারণে এমনটা ঘটে। এগুলির বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ তীব্র হলে বড়জোর এরা ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে দু’-চার কথা লিখে লক্ষ লক্ষ মানুষের উৎসারিত ক্ষোভের লাভাস্রোতকে ভোটের বাক্সে পরিচালিত করেন। কিন্তু বৈষম্যমূলক পুঁজিবাদী ব্যবস্থার গায়ে আঁচড়টিও যাতে না পড়ে কিংবা এটিই যে বৈষম্যের মূল কারণ তা যাতে মানুষ বুঝতে না পারে তার জন্য সদা সচেষ্ট থাকেন। এই ব্যবস্থার সেবাদাস ক্ষমতাপিপাসু দলগুলিও এই সমাজের মূল গলদটিকে দেখায় না। তারা জানে, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার শত সংকট সত্তে্বও ক্ষমতার গদিতে আসীন থেকে তারা পুঁজিপতিদের আর্শীবাদ কুড়োতে পারবে। কিন্তু এই ব্যবস্থার পতন ঘটলে তাদের পতনও অনিবার্য। তাই সে সমস্ত কথা তারা ভুলেও উচ্চারণ করে না।
এই শোষণমূলক ব্যবস্থার আমূল বদল না ঘটিয়ে মানুষে-মানুষে সীমাহীন বৈষম্য দূর করা অসম্ভব– এই সত্য আজ থেকে ১০০ বছর আগেই প্রমাণিত হয়েছে। রাশিয়ার বুকে এই আর্থিক বৈষ্যমেরই অবসান চেয়ে ১৯১৭ সালে সংঘটিত হয়েছিল পুঁজিবাদ বিরোধী সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। এই আর্থিক বৈষম্য থেকে মানুষকে মুক্তির দিশা দিতে বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন বিশ্বসাম্যবাদী আন্দোলনের মহান নেতা কমরেড লেনিন। শোষণের শৃঙ্খল ছিঁড়ে ফেলতে দেশের আপামর জনসাধারণ লেনিন-স্ট্যালিনের নেতৃত্বে বলশেভিক পার্টির আহ্বানে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বিপ্লবে। গড়ে তুলেছিল শোষণহীন নতুন সমাজ। আজ পুঁজিবাদী বিশ্ব-ব্যবস্থায় শোষণের নাগপাশ থেকে মুক্তি পেতে দরকার এমনই বিপ্লবী পার্টির। যাদের নেতৃত্বে গড়ে উঠবে দেশব্যাপী আন্দোলন, যার মধ্য দিয়ে উৎপাটিত হবে সামাজিক বৈষম্য, গড়ে উঠবে মানুষের সমানাধিকার। এই অসহনীয় বৈষম্য যাদের ব্যথিত করছে তারা এই সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করবেন– এটাই সময়ের দাবি।
ভারতের তরুণরা আজ আন্দোলনে মুখর। সরকারের সামাজিক বৈষম্যমূলক আইনের বিরুদ্ধে তারা বুক চিতিয়ে লড়ছে। সমাজের অর্থনৈতিক বৈষম্যের অবসানেও লড়াইয়ে তারা এগিয়ে আসবে, সরকারের অন্যায় নীতির বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলবে। তুলছেও।