দেশজোড়া ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ১১ জানুয়ারি দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার কৃষক আন্দোলন তথা গণআন্দোলনের শহিদদের স্মরণ করার আহ্বান জানিয়েছে এস ইউ সি আই (সি)।
দেশ আজ আন্দোলিত দিল্লির কৃষক আন্দোলনে। ২০০৬-‘০৭ সালে রাজ্যও আন্দোলিত হয়েছিল সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের চাষিদের এসইজেড-বিরোধী বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামে। তারও কয়েক দশক আগে থেকে গরিব কৃষক-ভাগচাষি আন্দোলনের দীর্ঘ ইতিহাস রচিত হয়েছে দক্ষিণ ২৪ পরগণায়। ওই সময় মর্যাদা নিয়ে বাঁচার অধিকার বুঝে নিতে মহান নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তার আলোকে চাষিদের জাগিয়ে তুলেছিলেন এস ইউ সি আই (সি) দলের় কৃষক নেতা-সংগঠকেরা।
পাঁচের দশকের কথা। কংগ্রেসের রাজত্ব। জঙ্গল হাসিল করে গড়ে ওঠা ছোট ছোট গ্রাম নিয়ে সুন্দরবন দ্বীপাঞ্চল। নদীতে নিঃশব্দে ওঁৎ পেতে আছে কুমিরের দল। জনবসতির সন্নিকটে ঘন জঙ্গলে হিংস্র বাঘের আস্তানা। ডাঙায় জোতদার-জমিদারের অত্যাচার আর পুলিশের জুলুম। একেই নিয়তি মেনে গ্রামের গরিব মানুষেরা স্ত্রী-সন্তান নিয়ে কোনও রকমে দিন গুজরান করতেন। কখনও সহ্যের শেষ সীমায় পৌঁছে মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়তে চাইলে জমিদারের লেঠেল, বন্দুক ও পুলিশের সম্মিলিত আক্রমণের সামনে তাদের প্রতিবাদ খড়কুটোর মতো উড়ে যেত। ঘর জ্বালিয়ে দেওয়া, মেরে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া, মা-বোনেদের সম্ভ্রম লুঠ করা জোতদারদের গুন্ডাবাহিনীর কাছে ছিল জলভাত। চাষ করা ধান জোতদারদের গোলায় তুলে দিতে চাষিদের বাধ্য করা হত। ভাগচাষির আইনসঙ্গত অস্তিত্ব মানত না জোতদার আর প্রশাসনের কর্তারা। মজুরির বিনিময়ে জোতদারদের জমিতে কাজ করে মাত্র। কোনও চাষি প্রতিবাদ করলে তার নামে আদালতে মামলা ঠুকে দিত জোতদাররা। টাকার জোরে পুলিশ হানা দিত ঘরে। অত্যাচারের নির্মমতা দেখে আর কেউ মাথা তুলতে সাহস পেত না। চাষি বুঝত, টাকা যার, পুলিশ, আইন, সরকার– সবই তার। গরিবের কেউ নেই।
এই অবস্থায় এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) দল দক্ষিণ ২৪ পরগণার গরিব মানুষের পাশে দাঁড়ায়। কমরেড শিবদাস ঘোষের সুচিন্তিত পরিকল্পনা, শচীন ব্যানার্জীর দক্ষ পরিচালনা, সুবোধ ব্যানার্জীর গণজাগরণী ভাষণে চাষিদের ঘুম ভাঙে, উদ্দীপ্ত হয় তারা। বিস্তীর্ণ এলাকায় গরিব খেতমজুর, নিম্ন-মধ্য চাষি ধীরে ধীরে বুকে বল পায়। জোতদার কংগ্রেস ও পুলিশের বিরুদ্ধে লড়ার শক্তি এস ইউ সি আই (সি)-কে নিজের সন্তানের থেকেও বেশি যত্নে বড় করে তুলতে কোমর বাঁধে সুন্দরবনের নোনামাটির গরিব মানুষ। সমুদ্র তীরের মৈপীঠ থেকে কুলতলি, জয়নগর ছাপিয়ে ক্যানিং পর্যন্ত অঞ্চলে অঞ্চলে আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে গড়ে ওঠেন খেটে খাওয়া মানুষের অন্তরের প্রিয় বীর সংগ্রামী নেতারা। এক এক জনের নাম কিংবদন্তীর মতো ছড়িয়ে যায় গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে।
একদিকে কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষায় শচীন বান্যার্জী, সুবোধ বান্যার্জীর নেতৃত্বে আন্দোলন চলছে। এলাকায় এলাকায় কর্মী বৈঠক, সমাবেশ ও বিক্ষোভ সভা হচ্ছে। গ্রামে গ্রামে গড়ে উঠছে গরিব চাষি আন্দোলনের দুর্জয় ঘাঁটি। আর এরই সাথে চলছে বিপ্লবী রাজনীতির শিক্ষা। যুগ যুগ ধরে শাসকরা গরিবের মগজে এমন ধারণাই ঢোকাতে চেয়েছে যে, বেগার খেটে যাওয়াই ধর্ম, অন্যের দয়াতেই বেঁচে থাকতে হবে। সরকার বদল হলেও এই অপচেষ্টার কোনও পরিবর্তন হয়নি। নিরক্ষর এই চাষিদের নিয়ে রাজনৈতিক ক্লাস করতেন কমরেড শিবদাস ঘোষ। গরিবের দিন বদলাতে হলে বদলাতে হবে এই শোষণমূলক সমাজটাকে, আর সেই বদলের হাতিয়ার হল মার্কসবাদ। বিজ্ঞানের এই তত্ত্ব বুঝিয়ে দিতেন সহজ-সরল ভাষায়। এইভাবে দীক্ষিত শিক্ষিত হয়ে এগিয়ে এসে তার চর্চা এলাকার চাষিদের মধ্যে নিজের ভাষায় নিয়ে যেতেন যে দক্ষ সংগঠকরা, তাঁদের উপর বারবার নেমে এসেছে শাসকের অত্যাচার। তাঁদের রক্তে বাদাবনের নোনা মাটি বারবার রাঙা হয়েছে। এক দলের সরকার গিয়ে অন্য দলের সরকার এসেছে। কিন্তু চাষি আন্দোলনের এই দুর্জয় ঘাঁটি ভাঙতে, কর্মী-সংগঠকদের প্রাণ নেওয়ার এই হীন পথ থেকে কোনও শাসকই সরে আসেনি। বরং সরকারি ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে এই জেলাকে গণতন্তে্রর কবরখানা বানিয়েছে তারা। শত প্রলোভনে নত না হওয়া এসইউসিআই(সি) কর্মীদের বীভৎস হত্যালীলায় আরও বেশি করে মেতেছে শাসক দলগুলি।
গণআন্দোলনের ভিত গড়ে তুলতে গিয়ে শহিদ হয়েছেন ১৭৫ জন বিপ্লবী কর্মী। এই জেলার মাটি সেই রক্তে স্নান করে পবিত্র হয়েছে। দলের রাজ্য কমিটির সদস্য এবং এআইকেকেএমএস-এর রাজ্য সম্পাদক বিশিষ্ট কৃষক নেতা কমরেড আমির আলি হালদার ১৯৯৭ সালের ১১ জানুয়ারি প্রকাশ্য দিবালোকে নৃশংস ভাবে খুন হন। প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরকে দমন করতে শাসকগোষ্ঠী এমন আক্রমণ বারবার করেছে। আহতদের যন্ত্রণা, মা-বোনের সম্ভ্রমহানির বেদনা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগের বীভৎসতা, জমি ও ভিটেমাটি থেকে দলের কর্মী-সমর্থকদের বিতাড়নের নির্মমতা সুন্দরবনের জনগণকে বার বার তীব্র বেদনার সাক্ষী হতে বাধ্য করেছে। চক্রান্ত করে অসংখ্য মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো, জেলবন্দি করা, এমনকি সাজানো মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড করিয়ে মানসিক নির্যাতন চালিয়ে জেলার পরিবেশকে লাগামহীন ভাবে সন্ত্রস্ত করে রেখেছে শাসক দলগুলি। সর্বশেষ গত জুলাইয়ে মৈপীঠের নারকীয় বর্বরতা বিবেকবান মানুষের বুকে তীব্র আলোড়ন তুলেছে।
মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারায় কমরেডদের আদর্শবোধ, উন্নত রুচি সংস্কৃতি, চিন্তা-চেতনার ভিত্তিতে আন্দোলনের বলিষ্ঠতা দেখে শোষক শ্রেণি তাদের ঘ্রাণশক্তি দিয়ে বুঝে নিয়েছিল এসইউসিআই(সি)-র শক্তিবৃদ্ধিতে তাদের সর্বনাশ। কমরেড শচীন ব্যানার্জী, সুবোধ ব্যানার্জী, পরবর্তী কালে কমরেড ইয়াকুব পৈলান প্রমুখ জেলার বিশিষ্ট, বলিষ্ঠ ও যোগ্য নেতারা একদিকে আদর্শগত চর্চার মাধ্যমে দলের কর্মী সংগ্রহ করে এবং অপর দিকে সফল গণআন্দোলনের ঢেউ তুলে দলকে যতই শক্তিশালী করেছেন, ততই শাসকরা ভয় পেয়ে সন্ত্রাসের পথ বেছে নিয়েছে।
এই জঘন্য অপরাধের নায়ক জোতদার, পুলিশ এবং কংগ্রেস, সিপিএম, টিএমসি ও তাদের মদতপুষ্ট সমাজবিরোধীরা। কিন্তু শত অপচেষ্টা সত্ত্বেও কোনও মতেই তারা জেলার সংগ্রামী জনগণের মাথা নত করাতে পারেনি। আজও স্বজন হারানোর ব্যথা বুকে চেপে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে অবিচল তারা। আজ কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের ‘বদান্যতায়’ বলীয়ান হয়ে বড় বড় কর্পোরেট মালিকরা চাষির ফলানো ফসল ও জমি ব্যবহার করে মুনাফার পাহাড় গড়তে উদ্যোগী। তাই দিল্লির রাজপথে দেশের লক্ষ লক্ষ কৃষক নিজেদের জীবন-জীবিকা রক্ষায় সংকল্পবদ্ধ হয়ে লড়াই করছেন।
সংগ্রামের এই গৌরবময় ইতিহাসকে স্মরণ করতে ও কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে দিল্লিতে গড়ে ওঠা ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানাতে ১১ জানুয়ারি শহিদ আমির আলি হালদারের স্মরণ দিবসে বকুলতলা নতুন হাটে শহিদদের স্মরণে সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে। সভায় প্রতিটি শহিদ পরিবারের পক্ষে একজন প্রতিনিধির হাতে শহিদস্মারক তুলে দিয়ে সম্মান জানানো হবে। সভায় সভাপতিত্ব করবেন দলের পলিটবুরো সদস্য ও জেলা সম্পাদক কমরেড দেবপ্রসাদ সরকার।