বিজেপি সভাপতি তথা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ৭০ বছরে কেউ যা করতে পারেনি ১০০ দিনেই তা করে দেখিয়ে দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি৷ প্রধানমন্ত্রীর মুখেও দেশবাসী শুনেছিল এমন কথা৷ বোঝা যায় আপন কৃতিত্বে মোহিত তাঁরা৷ কথিত আছে, নিজের সৌন্দর্যে মোহিত গ্রিক উপকথার রাজা নার্সিসাস শুধু মোহের ঘোরেই আত্মধ্বংসের পথে এগিয়ে গিয়েছিলেন৷ বিজেপি সরকার কি সে পথেই দেশকে নিয়ে চলেছে!
কী কী মহৎ কীর্তি গত ১০০ দিনে করে ফেলেছেন তাঁরা? তাঁরা কি দেশের কর্মক্ষম যুবশক্তির কর্মসংস্থানের কথা ভেবে কথাটা বলেছেন? নিশ্চিতভাবে বলা যায়– না৷ কারণ মোদি সরকারের আগের পাঁচ বছরেই বেকারত্ব ৪৫ বছরে সর্ব্বোচ্চ জায়গায় পৌঁছে গেছে৷ আরও অতল খাদের দিকেই তার দৌড় অব্যাহত৷ দেশের সাধারণ মানুষের রোজগার কি বেড়েছে? বিজেপি সরকার অসংগঠিত ক্ষেত্রে শ্রমিকদের মজুরি বাড়িয়েছে দু’টাকা৷ আর এমপিদের বেতন দ্বিগুন বাড়িয়ে মাসে করেছে ১ লক্ষ টাকা, সব সুবিধা যোগ করে যা হয় মাসে ২ লক্ষ ৭০ হাজার টাকা৷ রিলায়েন্সের মালিকদের আয় দিনে ৩০০ কোটি টাকাতে পৌঁছে দিতে তেল–গ্যাসের ব্যবসার বেশিরভাগটাই তাদের হাতে তুলে দিয়েছে আগেই৷ নতুন জমানার প্রথম ১০০ দিনে মোদিজি তার সঙ্গে যোগ করেছেন, সাধারণ মানুষের জন্য রান্নার গ্যাসের ভর্তুকিটা নিঃশব্দে লোপাট করে দেওয়ার কারসাজি৷
আর কী করেছেন? শ্রম আইন সংস্কার করে মালিকদের হাতে ইচ্ছামতো ছাঁটাই করা, বেতন কমানোর অধিকার দিয়েছেন৷ ইএসআই তুলে দেওয়ার পথে হেঁটে, পিএফের জমা টাকা মালিকদের লাভের জন্য খাটানোর ব্যবস্থা করে তাদের প্রশংসা কুড়িয়েছেন৷ মালিকদের জন্য মোদি সাহেবদের ১০০ দিনের সাফল্য সত্যিই বলবার মতো৷ বিগত পাঁচ বছরে তাঁদের জমানায় ১ শতাংশ ধনকুবেরের হাতে জমা হয়েছে দেশের সম্পদের ৭৭ শতাংশ৷ জনসংখ্যার প্রায় ৬৭ শতাংশ মানুষ অতল দারিদ্রের গহ্বরে নিমজ্জিত৷ নতুন দফার ১০০ দিনে এই বৈষম্য আরও বাড়ছে৷ সাধারণ মানুষের হাতে সামান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কেনারই টাকা নেই৷ শিল্পদ্রব্য কিনবে কে? চাহিদা নেই বলে সারি সারি কলকারখানা বন্ধ হচ্ছে৷ বেড়ে চলেছে জনজীবনের সংকট৷ অর্থনীতি মন্দার করাল গ্রাসে৷ গাড়ি শিল্পেই ১০ লক্ষ লোক ছাঁটাইয়ের কোপে, রেলে সরকার নিজে সাড়ে তিন লক্ষ কর্মচারীকে ছাঁটাই করছে৷ এর মধ্যেই ১৪ লক্ষ কোটি টাকা বিনিয়োগ কমে যাওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে শেয়ার বাজার (ইকনমিক টাইমস ডট কম ৯ সেপ্টেম্বের ২০১৯)৷ ফলে ছাঁটাই আরও বাড়বে৷ চাষে এমনিতেই সংকট, এর উপর নানা জায়গা থেকে পরিযায়ী শ্রমিকরা কাজ হারিয়ে গ্রামে ফিরতে শুরু করায় গ্রামীণ ক্ষেত্রে বেকারি মারাত্মক বাড়ছে৷ ৪০ কোটির বেশি শ্রমিক অতি সামান্য মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য হয়৷ সেই মজুরি এত সামান্য যে নেই বললেই হয় (পিইডব্লু রিসার্চ সেন্টার,ওয়াশিংটন, মার্চ ২০১৯)৷ ভক্তের দল আওয়াজ তুলেছে ‘মোদি হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়’– মোদি থাকলে সব মুশকিল আসান হয়ে যাবে কিন্তু মোদিজি থেকে শুরু করে অমিত শাহ কিংবা তাঁদের অর্থমন্ত্রী– সকলের ভাব দেখে মনে হয় তাঁরা এত মহান চিন্তায় ব্যস্ত যে, দেশের মানুষের খাওয়া–পরার মতো তুচ্ছ বিষয়ে তাঁদের ভাবতে বলাই অপরাধ!
তাহলে ১০০ দিনে কিছুই কি করেননি তাঁরা? অবশ্যই করেছেন৷ এক মাসের বেশি হয়ে গেছে কাশ্মীর দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন৷ ফোন বন্ধ, খবর আদানপ্রদান বন্ধ, স্কুল–কলেজ বাজার–হাট, হাসপাতালের স্বাভাবিক পরিষেবা সব বন্ধ৷ যতটুকু খবর বাইরে আসছে তাতে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার কোনও লক্ষণ কাশ্মীরের নেই৷ কাশ্মীর নিয়ে সারা দেশে বিজেপি এত লম্ফঝম্প করছে, অথচ কাশ্মীরের মানুষের মত নেওয়ার কথা প্রধানমন্ত্রীর একবারও মনে হল না৷ গণতন্ত্র ফেরানোর চেষ্টা দূরে থাক, সামরিক বাহিনীর দাপটের উপরই ভরসা সরকারের৷ আসামের ১৯ লক্ষের বেশি ভারতবাসীকে চূড়ান্ত অনিশ্চয়তায় ঠেলে দিয়ে সারা দেশে ধর্ম–বর্ণ–সম্প্রদায়গত বিভেদের জিগির তুলতে ব্যস্ত বিজেপি সরকার৷ ত্রিপুরায় এর মধ্যেই বিজেপি সরকার এই ডামাডোলের সুযোগে গরিব মানুষের হাসপাতালে চিকিৎসার সুযোগটুকুও কেড়ে নিয়েছে৷ বিজ্ঞানসম্মত, সার্বজনীন শিক্ষার কফিনে শেষ পেরেক পুঁতে দিতে ১০০ দিনের ‘সাফল্যে’ যোগ হয়েছে সর্বনাশা শিক্ষানীতি৷
নরেন্দ্র মোদি অমিত শাহদের কথা থেকে আবার একটা সত্য সামনে এল, কোনও কিছু গড়া সময়সাপেক্ষ, ভাঙাটা সহজ৷ বিজেপির বেতনভোগী এবং প্রসাদভোগী ‘ভক্ত’বাহিনী এই দুই প্রধান কুশীলবের আস্ফালনের সাথে তাল মিলিয়ে দেশের সভ্যতা–সংস্কৃতি, মানুষে মানুষে ঐক্য ভাঙতেই ব্যস্ত৷ তাই বহু বছরের ভারতীয় ঐতিহ্যকেও অল্পদিনেই ভাঙতে নেমেছেন তাঁরা৷ ভোটের আগে কলকাতায় বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভেঙেছিলেন তাঁরা৷ জেতার পর, ১০০ দিনের মধ্যেই ‘বিজেপি ভক্ত’বাহিনী নবজাগরণের উদগাতা রামমোহনকে ব্রিটিশের দালাল বলেছে৷ বিজেপির জয়রথের ধাক্কায় কাশ্মীরে, আসামে মানুষের ঘর ভেঙেছে৷ সারা দেশে একচেটিয়া মালিকদের স্বার্থে তারা ভাঙছে শ্রমিক–কৃষক সাধারণ মানুষের জীবনের সুস্থিতি৷ তাকতদার বটে!