কলকাতার বড়বাজারের হোটেলের আগুনে যে মা তাঁর দুই সন্তানকে হারালেন, যে সব পরিবার তাদের প্রিয়জনকে হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেল, কলকাতা পুরসভার শাসক তথা রাজ্যের শাসন তখতে আসীন কর্তারা কি একবারও তাঁদের কাছে করজোড়ে ক্ষমা চাইবার কথা ভেবেছেন! এ দেশের শাসকদের স্বভাব জানলে এমন আশা স্বপ্নেও কেউ করবেন না। কিন্তু জনগণের পয়সায় আমিরি করা কাউন্সিলর, মেয়র, মন্ত্রীর দলের এতটুকু মানবিকতা অবশিষ্ট থাকলে তাঁরা তা করতেন। ফলে যথারীতি দুই শিশু সহ ১৪ জন মানুষের জীবন চলে যাওয়ার পরে তাঁদের কাছ থেকে সেই পুরনো দায় ঠেলাঠেলির খেলা ছাড়া আর কিছু দুর্গত পরিবারগুলির জুটলো না। আগুন লাগার কারণ যে সর্বোচ্চ লাভের নেশায় হোটেল মালিকের নিয়মের তোয়াক্কা না করা এবং পুরসভা, পুলিশ, দমকল এই তিন দপ্তরের নজরদারিতে চরম অনীহা– তা যে কোনও মানুষই বুঝবেন। সে কারণেই সরকারি কর্তারা ব্যস্ত থেকেছেন হোটেল মালিকের নিয়ম না মানার দায় একে অন্যের ঘাড়ে ঠেলে নিজে হাত ধুয়ে ফেলতে। মুখ্যমন্ত্রী দিঘায় ধর্মীয় কর্মসূচি সাঙ্গ করে পোড়া হোটেলের সামনে গিয়ে যখন কড়া হাতে সব দমন করার কথা বলে ‘সব ঠিক হ্যায়’ ধরনের বার্তা দিতে চেয়েছেন, তাতেও তাঁর দল পরিচালিত সরকারের গাফিলতি ঢাকার বদলে আরও স্পষ্ট হয়েছে।
প্রশ্নটা এখানেই, জানা যাচ্ছে ওই হোটেলের দমকলের ছাড়পত্র শেষ হয়ে গেছে অন্তত তিন বছর আগেই। দমকলের ছাড়পত্র না থাকলে হোটেলের ট্রেড লাইসেন্স, ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লাইসেন্স নবীকরণ হওয়ারই কথা নয়। তবু রমরমিয়ে ব্যবসা চালাতে হোটেল মালিকের কোনও অসুবিধা হয়নি। জানা গেছে গোটা বাড়িতে আগুন নেভানোর ব্যবস্থা কার্যত কিছুই ছিল না। ফলে ফায়ার অ্যালার্মের কোনও প্রশ্নই নেই। ছাদে বেআইনি নির্মাণ, দ্বিতীয় সিঁড়ি শাটার দিয়ে বন্ধ রাখা ইত্যাদির বিষয়েও পুরসভা চোখ বুজে ছিল।
আর পুলিশ! তাদের খুশি রাখার মন্ত্র জানেন না এমন ব্যবসায়ী দুর্লভ বললেও কম বলা হবে। স্থানীয় থানায় প্রণামী না পৌঁছলে এমন অনিয়ম তো অসম্ভব। সে প্রণামীর ভাগ স্তরে স্তরে থাকায় থানাও এ নিয়ে নিশ্চিন্ত। প্রায় ১০০ আবাসিক থাকার মতো একটা হোটেল, প্রত্যন্ত কোনও এলাকাতেও নয়, একেবারে বড়বাজারের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় তার অবস্থান। সেখানে পুলিশ, পুরসভা এবং দমকলের সবচেয়ে বেশি নজরদারি থাকার কথা। যে কোনও দুর্ঘটনা কী ভয়াবহ পরিস্থিতি ডেকে আনতে পারে, তা না বোঝার মতো অবুঝ সরকারি কর্তারা নন নিশ্চয়ই! আসলে দমকল কর্তা, পুলিশ, কাউন্সিলর, মন্ত্রী ইত্যাদিদের নজর অবশ্যই ছিল– তা বিশেষভাবে ছিল ‘নগদ নারায়ণ’-এর প্রতি। এ দিকে গভীর নজর না থাকলে তাঁরা কি সমস্ত গাফিলতি মেনে নিয়ে নিশ্চিন্তে চোখ বুজে চলতে পারতেন! সমালোচনা হতেই পুরমন্ত্রী তথা কলকাতার মেয়র বলেছেন, এ সব যখন তৈরি হয়েছে তখন সমালোচকরা প্রশ্নগুলি তোলেননি কেন? অপূর্ব যুক্তিধারা সন্দেহ নেই! প্রশ্নগুলো কি এখন উঠল? স্টিফেন কোর্ট, আমরি হাসপাতাল, একাধিক বাজারে আগুন এই সমস্ত ঘটনার পরে বারবার নজরদারি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। পুরমন্ত্রী কি বলতে চাইছেন যে, তাঁর পরিচালিত পুরসভার অপদার্থতার জন্য তিনি নন, সমালোচকরাই দায়ী!
মুখ্যমন্ত্রী বড়বাজারের দগ্ধ হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে যথারীতি ‘রাফ অ্যান্ড টাফ’ ধরনের কিছু উত্তেজক মন্তব্য করেই নাকি পার্ক স্ট্রিটে একটি রেস্টুরেন্টে পঞ্চাশটি গ্যাস সিলিন্ডার মজুত থাকা ও সরু সিঁড়ির বিষয়টা ধরে ফেলেছেন! তিনি নাকি নির্দিষ্ট খবর নিয়েই গিয়েছিলেন! দেখা যায় প্রাণহানি, দুর্ঘটনা ঘটার পরেই এই ধরনের খবরগুলো কিছুদিনের জন্য সরকারি কর্তা ও নেতামন্ত্রীরা পেয়ে যান! কিন্তু তাঁদের এই ‘খবর পাওয়া’-র সোর্স কিছুদিনের মধ্যেই একেবারে উবে যায় কী করে? এখন নানা নির্দেশ জারি হচ্ছে, হোটেল মালিকরা জানেন এই ডামাডোলে একটু চুপ করে থাকাই মঙ্গল। কিছুদিন বাদে সব ঠিক হয়ে যাবে। আবার একটা আগুন লাগার ঘটনার আগে যা চলছিল তাই চলবে। আর দমকল? দমকলের কর্তাদের ইনস্পেকশন নিয়ে কথাই চালু আছে, সব কিছু ঠিক থাকলেই তাঁরা বেশি রুষ্ট হন! কারণটা সকলের জানা।
কলকাতার যত্রতত্র শপিং মল, হোটেল, নানা নামের বাজার ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান গজিয়ে উঠেছে। এর যে কোনওটিরই সুরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন আছে। অগ্নি সুরক্ষা, অন্যান্য দুর্ঘটনা রোধে আগাম সুরক্ষার ব্যবস্থা করার জন্য কোনও রকম খরচ করতে মালিকরা অনিচ্ছুক। সর্বোচ্চ লাভ অটুট রাখতে গিয়ে তাঁরা মানুষের জীবনের কোনও তোয়াক্কা করছেন না। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন বটে, আমাকে ভোট দিতে হবে না, নিয়ম মানুন, কিন্তু কোনও নিয়ম না মানার এই সাহস মালিকরা পাচ্ছে কোথা থেকে? শাসকদলের মদত ছাড়া কি তা সম্ভব? অল্প কিছুদিনের মধ্যেই কলকাতার একাধিক বাজার, কারখানা, গুদাম ইত্যাদিতে আগুন লাগার ঘটনা এই কথাকেই প্রতিষ্ঠা করে। প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে শাসকদল এবং দমকল-পুলিশ-পুরসভার কর্তাদের সঙ্গে মুনাফালোভী ব্যবসায়ী চক্রের আঁতাত মানুষের জীবনে বিপদ ডেকে আনছে।
মুনাফালোভী মালিকের কাছে মুনাফাটাই একমাত্র বিচার্য। মানুষের প্রাণ সেখানে পিছনের সারিতে। একই ভূমিকা নেয় শাসকদলগুলো এই মালিকি ব্যবস্থার ম্যানেজার হিসাবে তারা যে যেখানে ক্ষমতায় থাকে সেখানে তারা মালিকদের বাড়তি লাভের ব্যবস্থা করে দিয়ে নিজেদের পকেট ভরাতে ব্যস্ত থাকে। সে কারণেই এরা যখন বিরোধী আসনে থাকে তখন এই ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলে আসরে নামে বাজার গরম করে নিজেদের মুখগুলো জনমানসে নতুন করে ভাসিয়ে তুলতে। বলে, ওদের বদলে আমাদের গদিতে বসান– সব ঠিক করে দেব। সরকারে বসলেই তারা যে একই ভূমিকা নেয় তা মানুষের জানা। সেই কারণে গুজরাটে, দিল্লিতে, মধ্যপ্রদেশে, মহারাষ্ট্রের বেআইনি বাড়ি ভেঙে পড়লে, হাসপাতালে, বাজারে আগুন লেগে মানুষের মৃত্যু ঘটলে বিজেপি নেতাদের ভূমিকা হয় এ রাজ্যের শাসকদের মতোই। আবার তাদেরই ঠিক উল্টো ভূমিকায় এখন দেখা যাচ্ছে বড়বাজারের দগ্ধ হোটেলের সামনে টিভি ক্যামেরায় গলা ফাটানোর কাজে। মালিকের মুনাফার লোভ আর গদিলোভী রাজনৈতিক দুষ্টচক্রের আখের গোছানোর তাগিদে সাধারণ মানুষের জীবন ঝুলছে একটা সরু সুতোর মধ্যে। এ ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের সচেতনতা যেমন জরুরি, তেমনই সরকারকে বেআইনি কারবারিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াতে বাধ্য করাতে পারে একমাত্র সাধারণ মানুষের ঐক্যবদ্ধ উদ্যোগ ও আন্দোলন।
বড়বাজারের হোটেলে মর্মান্তিক মৃত্যুর পুনরাবৃত্তি না চাইলে শাসকদের এই বাধ্য করার কাজে সক্রিয় হতে হবে সাধারণ মানুষকেই।