কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার আগে যে প্রতিশ্রুতিগুলি জনতার দরবারে রেখেছিলেন তাতে আমজনতা একটা নতুনত্বের স্বাদ আশা করেছিল৷ চার বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর দেখা গেল নানা চমকের আড়ালে সমস্ত প্রতিশ্রুতি চাপা পড়ে গিয়েছে৷ কোটি কোটি বেকার চাকরি পায়নি৷ কাশ্মীর সমস্যার সমাধান এক ইঞ্চিও এগোয়নি৷ কালো টাকা উদ্ধার তো দূরের কথা, নোট বাতিলের ফলে শাসক দল ও তাদের নেতারাই ফুলে ফেঁপে ঢোল৷ ১৫ লক্ষ করে টাকা অ্যাকাউন্টে ভরে দেওয়ার গল্প তো এখন অলীক ব্যাপার৷ রাম মন্দির আজও তৈরি হয়নি, ‘হিন্দুদের উন্নতিও’ আটকে৷ এবার পঞ্জিকরণের নামে বৈধ নাগরিকদের বিতাড়নের জিগির৷ কেবল উন্মাদনার রাজনীতি দিয়ে কি বেশিদিন মানুষ ক্ষেপানো যায়? পেট বড় বালাই৷ সঙ্কটে জর্জরিত মানুষকে ধর্মের আফিং দিয়ে কিছুদিন ঘোরে রাখা যায়৷ ঘোর কেটে গেলেই মানুষ কিন্তু হিসাব চাইবে৷
আসামে পূর্বতন অগপ সরকার অসমিয়া সেন্টিমেন্টকে কাজে লাগিয়ে, জাতিগত, ধর্ম ও ভাষাগত বিদ্বেষ তৈরি করে ক্ষমতায় এসেছিল৷ কংগ্রেসও একই ভাবে একে কাজে লাগিয়েছিল৷ এই সেন্টিমেন্টকে কাজে লাগিয়ে তারা ১৯৮৫ সাল থেকে বৈধ নাগরিকত্বের সমীক্ষা চালায় ও তদন্ত করে৷ এর দ্বারা তারা কখনও এনআরসি–এর চূড়ান্ত তালিকায় ৩ লক্ষ ৭০ হাজারের বেশি নাম তুলতে পারেনি৷ আর আজ বিজেপি সরকার ক্ষমতায় এসে এক ধাক্কায় সেই সংখ্যাকে ছাড়িয়ে ৪০ লক্ষ মানুষকে বাদ দিয়েছে৷ ভুলের তো একটা সীমা আছে এতটা ভুল হতে পারে? নাকি প্রকৃত নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও ভাষাগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়িয়ে বিষাক্ত পরিবেশ তৈরি করে জাতি বিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িকতার তাস খেলাই আসল উদ্দেশ্য? যে কোনও প্রকারে ক্ষমতা দখলই প্রধান উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ অনুপ্রবেশ ঠেকানো আর প্রকৃত নাগরিকদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া এক জিনিস নয়৷ মানুষের মৌলিক সমস্যাগুলির কোনওটিই আজও পূরিত হল না৷ কেবল জাত–পাত, ধর্ম–বর্ণ, সম্প্রদায়কে কেন্দ্র করে মানুষে মানুষে বিদ্বেষ তৈরি করে মানুষের অর্থনৈতিক সঙ্কটের মোকাবিলা করা যায় না৷ প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন তিনি পুঁজিপতিদের পাশে দাঁড়াতে ভয় করেন না৷ সেটা না হয় বুঝলাম, তাহলে কি জনগণের পাশে দাঁড়াতে তিনি ভয় করেন?
অক্সফ্যামের রিপোর্টে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী ২০১৭ সালে ভারতের মোট সম্পদের ৭৩ শতাংশ কুক্ষিগত হয়েছে দেশের ১ শতাংশ ধনকুবেরদের হাতে৷ এই ১ শতাংশ ধনকুবেরদের সম্পদ শুধু গত এক বছরে বেড়েছে ২০.৯ লক্ষ কোটি টাকা৷ যা দেশের ২০১৭–’১৮ আর্থিক বর্ষের মোট বাজেটের সমান৷
২০১৭ সালে ফোর্বস সংস্থার এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ধনীদের তালিকায় শীর্ষস্থানে রয়েছে মুকেশ আম্বানি৷ তাঁর সম্পদের পরিমাণ এক বছরে ৬৭ শতাংশ বেডে হয়েছে ৩৮ বিলিয়ন ডলার, যা ভারতীয় মূল্যে প্রায় ২.৫ লক্ষ কোটি টাকা৷ ২০১৬ সালে ২৬,০০০ কোটি টাকার সম্পত্তি এক বছরে পাঁচ গুণ বাড়িয়ে আজিম প্রেমজির সম্পত্তি হয়েছে ১,২৪, ৫০০ কোটি টাকার৷ সম্পদের পরিমাণ বৃদ্ধিতে এরপরে ক্রমান্বয়ে রয়েছে হিন্দুজা, মিত্তল, পালানজি, গোদরেজ, শিবনাদার, বিড়লা, দিলীপ সাংভি ও গৌতম আদানি গোষ্ঠী৷ এই ধনকুবেরদের প্রথম ১০০ জনের সম্পদ বেড়েছে ২৬ শতাংশ হারে৷ জনগণকে শোষণ ছাড়া এ বিপুল পরিমাণ সম্পদ বৃদ্ধি কি সম্ভব?
যাঁরা বলেন কেবল জনসংখ্যা বৃদ্ধিই মানুষের সার্বিক সঙ্কটের কারণ তাঁদের বলি, সম্পদের সুষম বন্টন হলে বর্তমান জনসংখ্যাতেও অফুরন্ত সম্পদ রয়েছে আমাদের দেশে৷ একদিকে পুঁজিমালিকদের সম্পদ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে৷ সরকারগুলি তাদেরই সহায়তা করছে৷ উল্টো দিকে জনগণের সম্পদ আনুপাতিক হারে কমছে৷ শাসকরা আমাদের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেয় আর ধনকুবেরদের টাকায় ভোটে জিতে তাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি পালন করে৷ কারণ তারা জানে জনগণের ঐক্য গড়ে উঠলে বিপদ৷ ইংরেজদের বেলায় ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসি খারাপ আর আমাদের বেলায় তা ভালো, এ চিন্তা স্বাধীন ভারতে কি মঙ্গলজনক?
কিংকর অধিকারী
বালিচক, পশ্চিম মেদিনীপুর
(৭১ বর্ষ ৫ সংখ্যা ৩১ আগস্ট, ২০১৮)