গ্রাম, শহর সর্বত্র কর্মসংস্থানের সমস্যাটি সরকারের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসাবে উঠে এসেছে। বেকারত্বের মতো জনজীবনের এক মারাত্মক সঙ্কট সমাধানের কোনও সুনির্দিষ্ট রূপরেখা কি বিজেপি কিংবা কংগ্রেস–এই দুই জোটের আছে? দেশের চাকরির সঙ্কট যত বাড়ছে, এরা সমস্যার প্রকৃত কারণ অনুসন্ধানের পরিবর্তে নানা বিভ্রান্তির বিষয় এনে মানুষের দৃষ্টিকে ঘুলিয়ে দিচ্ছে। যেমন বিজেপি ভোটের সময় প্রচার করেছে দেশে বিভিন্ন অ-বিজেপি সরকারের তোষণের জন্য মুসলিমরা চাকরির সুযোগ হিন্দুদের তুলনায় বেশি পেয়ে যাচ্ছে। যেন হিন্দুদের চাকরি না হওয়ার জন্য দায়ী মুসলিমরা! কেউ কেউ এসব কথায় বিভ্রান্তও হচ্ছেন।
দেশে চাকরির বাস্তব চিত্রটি কী? ভারতে হিন্দুদের মধ্যে চাকরির হার কেমন? মুসলিমদের মধ্যে চাকরির হার হিন্দুদের তুলনায় কম না বেশি? খ্রিস্টান, শিখ, বৌদ্ধদের মধ্যেই বা চাকরির হার কেমন? এই সমস্ত প্রশ্নের তথ্যনিষ্ঠ উত্তর সম্প্রতি প্রকাশ করেছে গবেষণা-সংস্থা লোকনীতি-সিএসডিএস। সেই তথ্য বিশ্লেষণের সুবিধার্থে বেকারত্বের হার, চাকরির হার, লেবার ফোর্স পার্টিসিপেশন রেট কী এবং কীভাবে বা এসব পরিমাপ করা হয় তা দেখে নেওয়া দরকার। লেবার ফোর্স পার্টিসিপেশন রেট কী? একটা দেশে কর্মক্ষম জনগণের যত অংশ (১৫-৬০ বছর বয়সী) কোনও ধরনের চাকরি বা কাজে যুক্ত, অথবা কাজ খুঁজছেন, সেই অংশটি। এই লেবার ফোর্স পার্টিসিপেশন রেট থেকে বোঝা যায় একটা অর্থনীতিতে চাকরির প্রকৃত চাহিদা কতটা। মোট শ্রমশক্তির যত শতাংশ চাকরি খুঁজছে, কিন্তু এখনও পায়নি, তাই হল বেকারত্বের হার। সারা বিশ্বে এটাই প্রচলিত। কিন্তু ভারতে বেকারত্বের সঠিক হিসাব পাওয়ায় সমস্যা হল, এখানে লেবার ফোর্স পার্টিসিপেশন রেট অদ্ভূতভাবে কমছে। চাকরি হচ্ছে খুবই কম। তা হলে এই হার কমছে কেন? বিরাট অংশ কমে যাচ্ছে হতাশ হয়ে, দীর্ঘ চেষ্টার পর বিরাট অংশ চাকরির আশা ছেড়ে দেয় বলেই লেবার ফোর্স পার্টিসিপেশন রেট কমে যায়। ফলে কাজ পাচ্ছে না। অথচ কাজ খোঁজার আশাও চলে যাচ্ছে।
এবার দেখা যাক বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষের মধ্যে চাকরির হার, অর্থাৎ কর্মরত ও কর্মক্ষম মানুষের অনুপাতটি কেমন। লোকনীতি-সিএস ডি এস দেখাচ্ছে, ২০১৬-১৭ সালে অর্থাৎ মোদি সরকারের দ্বিতীয় বছরে হিন্দুদের চাকরির হার ৪৩.২১ শতাংশ, মুসলিমদের মধ্যে ৩৯.৯৫ শতাংশ, খ্রিস্টানদের মধ্যে ৪০.৯১ শতাংশ, শিখদের মধ্যে ৪১.৬ শতাংশ। তথ্য দেখাচ্ছে মুসলিমদের মধ্যে চাকরির হার কম। অথচ দেশে বিজেপি ও তার দোসররা উল্টো কথা বলে চলেছে। মোদি সরকারের দশ বছরের মাথায় পরিস্থিতি কী দাঁড়াল? হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টান-শিখ– সকলেরই চাকরির হার কমে গেল। ২০২৩-’২৪ সালে হিন্দুদের মধ্যে চাকরির হার ৩৭.২৬ শতাংশ, মুসলিমদের মধ্যে ৩৫.৫ শতাংশ, খ্রিস্টানদের মধ্যে ৪০.৪৩ শতাংশ, শিখদের মধ্যে ৩৭.৪ শতাংশ (তথ্যসূত্রঃ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস–২৫-০৫-’২৪)।
মোদি শাসনে কেন সব ধর্মের মানুষের মধ্যে চাকরির হার কমল? এর পিছনে রয়েছে বিজেপি সরকারের শ্রমিক স্বার্থ বিরোধী নীতি, কর্মী ও কর্মসংকোচন নীতি এবং অর্থনীতির মন্দার কারণে জনগণের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ার দরুন শিল্পায়ন না হওয়া ইত্যদি নানা বিষয়। এই সংকট দূর করার কোনও পথ কোনও বুর্জোয়া জোটই দেখাতে পারে না। এক সময় কংগ্রেস বলত, বেকারত্বের কারণ হল যোগ্যতার অভাব। এ কথাও মিথ্যাচার বলে প্রমাণিত। সম্প্রতি খবরে প্রকাশিত হয়েছে আইআইটি পাশ ৩৮ শতাংশ পড়ুয়া এ বছর চাকরি পায়নি।
ইঞ্জিনিয়ারিং ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইআইটিতে দেশের অন্যতম মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা পড়ার জন্য মুখিয়ে থাকেন। এতদিন আইআইটি পাশ করা কোনও ছাত্রকে চাকরির জন্য কারও দরজায় কড়া নাড়তে হত না। সেখানেও এখন বেকারত্বের তীব্র সংকট।
তথ্য জানার অধিকার আইনে আইআইটির এক প্রাক্তনী বেকারত্বের বিস্ফোরক তথ্য সামনে এনেছেন। সেই তথ্যে দেখা যাচ্ছে ২০২২ সালে দেশের ২৩টি আইআইটির ১৭,৯০০ জন ছাত্র চাকরির জন্য নাম নথিভুক্ত করান। এদের মধ্যে ১৯ শতাংশ চাকরি পাননি। ২০২৩ সালে চাকরি পেতে নাম লেখান ২০ হাজার পড়ূয়া। এর মধ্যে কাজ না পাওয়ার হার ২১ শতংশ। আর ২০২৪ সালে ক্যাম্পাসিং-এ আবেদন করেন ২১, ৫০০ জন পড়ুয়া। কাজ পাননি ৩৮ শতাংশ (সূত্রঃ বর্তমান ২৩ মে ২০২৪)। কেন পাননি? যোগ্যতার অভাব? আদৌ তা নয়। ১৯৯১ সালে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের নেতৃত্বে কংগ্রেস সরকার বিশ্বায়ন তত্ত্ব নিয়ে আসে। তার অন্যতম শর্ত বেসরকারিকরণ, ডাউন সাইজিং। নতুন কর্মক্ষেত্র তৈরির বদলে সঙ্কুচিত হচ্ছে। মনমোহন সিংয়ের এই নীতিই তো বিজেপি সরকার অনুসরণ করে চলেছে। ফলে সরকারের বদল হলেও নীতির বদল হয়নি। সেই কারণে, শুধু সরকারের বদল দ্বারা জনজীবনের এই সমস্যা দূর হতে পারে না। যে অর্থনীতি অবিরত বেকারত্বের জন্ম দিয়ে চলেছে তাকে সমূলে উপড়াতে না পারলে এই সমস্যার সমাধান নেই।