Breaking News

হিন্দুত্বের বিবেক ছেড়ে জাতির বিবেক সাজার চেষ্টা মোহন ভাগবতের

নরেন্দ্র মোদির ঔদ্ধত্যের কথা কি হঠাৎ জানতে পারলেন আরএসএস প্রধান! সমাজে বিভেদ সৃষ্টি করার মতো কথার স্রোত যে গোটা লোকসভা নির্বাচন পর্ব ধরে চলেছে তা কি আরএসএস প্রধান জানতেও পারেননি? আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবতের মুখনিঃসৃত বাণী শুনলে কারও এমনটা মনে হতেও পারে। সম্প্রতি তিনি আরএসএসের শিক্ষানবিশদের নিয়ে একটি বৈঠকে বলেছেন, প্রকৃত সঙ্ঘসেবক যিনি, তিনি নিজের কাজ করেন, কিন্তু কত কাজ করেছেন তা নিজের মুখেকখনও উচ্চারণ পর্যন্ত করেন না। আরও বলেছেন, শাসক এবং বিরোধী দুই পক্ষই নির্বাচনী প্রচারে এমন কথা বলেছে যাতে সমাজে বিভেদের সৃষ্টি হয়, এটা উচিত নয়। বলেছেন, ‘ভোটের সময় মর্যাদা রক্ষা করা হয়নি’। তাঁর কথায়, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের বিরোধী হিসাবে নয়, দেখা উচিত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে। অন্যত্র তিনি বলেছেন, অন্য দলের দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদের বিজেপিতে আশ্রয় দেওয়া উচিত হয়নি।

শুনে মনে হতে পারে, মোহন ভাগবতজি তথা আরএসএসের হলটা কী? আরএসএস কি সত্যিই বিজেপির এই সমস্ত কার্যকলাপে অনুমোদন দিচ্ছে না? কিন্তু যত দিন ধরে নির্বাচনী প্রচারে এই সমস্তগুলি চলল, তার মধ্যে একটিবারও মোহন ভাগবতজি তাঁর সাবধানবাণী উচ্চারণ করলেন না কেন? যদিও এবারের নির্বাচনের কথাই বা উঠছে কেন, ২০০২-এর গুজরাট গণহত্যা থেকে শুরু করে একেবারে ২০২৪-এর নির্বাচন পর্যন্ত দেখলে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক, মোহন ভাগবতজি কি জেগে ঘুমোচ্ছিলেন, না হঠাৎ করে এমন বোধোদয়ের পিছনে তাঁর বিশেষ কোনও উদ্দেশ্য আছে!

ঘটনাপ্রবাহ কিন্তু দ্বিতীয় সম্ভাবনাটির দিকেই ইঙ্গিত করছে। ২০১৪-তে বিজেপি কেন্দ্রীয় সরকারে ক্ষমতায় আসার পর থেকে গো-রক্ষার অজুহাতে একের পর এক মানুষ হত্যার ঘটনা মোহন ভাগবতজি হয় দেখতে চাননি, অথবা এ বিষয়ে তাঁর অনুমোদন ছিল বলে নীরব থেকেছেন। বিজেপির নেতারা যখন ‘গোলি মারো শালো কো’ বলে মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছেন, দিল্লি দাঙ্গায় ইন্ধন দিয়েছেন, নরেন্দ্র মোদি নিজে যখন মুসলিমদের বিরুদ্ধে উস্কানি দিতে বলেছেন, ‘পোশাক দেখলেই অপরাধী চেনা যায়’ ভাগবতজির পবিত্র কানে এ সব পৌঁছতে পারেনি। রহস্যটা কী?

ভাগবতজি কি জানতেন না যে তাঁর সংগঠন আরএসএসের পরম প্রিয় সেবক নরেন্দ্র মোদির পৃষ্ঠপোষকতায় বিলকিস বানোর ধর্ষক এবং তাঁর সন্তান ও আত্মীয়দের খুনিদের ব্রাহ্মণত্বের দোহাই পেড়ে মালা পরিয়েছে সংঘ পরিবারেরই লোকজন? কোথায় নারীর মর্যাদা ভাগবতজি? ভাগবতজি, আপনি ভাষার মর্যাদা লঙ্ঘিত হয়েছে বলে দুঃখিত? আপনার সংঘের দীর্ঘ দিনের সেবক নরেন্দ্র মোদি ভারতের আন্দোলনরত কৃষকদের আন্দোলনজীবী, খালিস্তানি, টুকরে টুকরে গ্যাংয়ের সদস্য বলে ব্যঙ্গ করেছেন, জানতেন না আপনি? মোহন ভাগবতজি কি উত্তরাখণ্ড এবং দিল্লি থেকে জারি হওয়া সংঘ ঘনিষ্ঠ সাধুদের ঘৃণা ভাষণের বিরুদ্ধে কোনও দিন কিছু বলেছেন? নাকি তখন ভেবেছিলেন এতে যদি বিজেপির ভোট বাড়ে ক্ষতি কী? ভয় ছিল যে ওই সময় ‘কথার মর্যাদা’ রক্ষার চেষ্টা করতে গিয়ে পাছে সরকারি গদির সুফলটা হাত ছাড়া হয়, মন্ত্রী-সান্ত্রী পরিবেষ্টিত হয়ে দেশের গার্জেন সেজে ভাল মন্দ উপদেশ দেওয়ার সুযোগটা যদি ফস্কে যায়! আদানি, আম্বানি, বিড়লাদের টাকার থলির বদ্যান্যতায় ঘাটতি পড়ে যায়! এ জন্যই কি সে দিন শিকেয় তোলা ছিল আপনার ‘মর্যাদা’!

ভেঙে ফেলা বাবরি মসজিদের জমিতেই গড়া অযোধ্যার রাম মন্দিরের সামনে মোদিজির শুয়ে পড়ার দৃশ্যটা আর একবার দেখে নেবেন নাকি মোহন ভাগবতজি? আপনি নিশ্চয়ই জানতেন ভাগবতজি, সেখানে ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে যে প্রকল্পটার নির্মাণ সুপরিকল্পিত ভাবে করা হচ্ছিল তার নাম চরম উগ্র হিন্দুত্ব! আর তার সাথে ঝরে পড়া বিজেপি তথা সংঘ পরিবারের নেতাদের চরম ঔদ্ধত্য চোখে না পড়ে উপায় আছে? তাতে কি আপত্তি ছিল না আপনার? এই রাম মন্দিরের উদ্বোধনকেই যখন ভারতের ‘নতুন স্বাধীনতা দিবস’ বলে অভিহিত করলেন নরেন্দ্র মোদি– মোহন ভাগবতজি আপনি কোনও আপত্তি জানিয়েছিলেন নাকি? গোটা রাম মন্দির ইভেন্টটাই যে আদ্যোপান্ত রাজনৈতিক, কোনও রকম ধর্মীয় অনুষঙ্গ এতে নেই– মোহন ভাগবতজি এবং তাঁর আরএসএসের কাছে তা অজানা ছিল নাকি? আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে ভাগবতজি, অযোধ্যার অসম্পূর্ণ রাম মন্দিরের উদ্বোধনে গিয়ে আপনি বলেছিলেন, নরেন্দ্র মোদির একার তপস্যায় এটা সম্ভব হয়েছে। এ রকম তপস্যা আমাদের সকলকে করতে হবে। কীসের তপস্যা ভাগবতজি? কাশী-মথুরায় মন্দির-মসজিদ বিতর্কে ইন্ধন দিয়ে নতুন করে দাঙ্গার আগুন জ্বালানোর তপস্যা? ভাগবতজি আপনার এবং আপনাদের সংঘ পরিবারের অনুমোদন ছাড়া বাবরি মসজিদ ধ্বংস থেকে শুরু করে এই পুরো ব্যাপারটা ঘটেছে নাকি? সমাজে বিভেদ সৃষ্টির এতবড় যজ্ঞের সহ-তপস্যী এবং অন্যতম হোতা আপনিও কি নন!

মোহন ভাগবতজি– আপনাকে আপনারই কয়েকটা কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া যাক বরং। ২০১৪-তে নরেন্দ্র মোদির কেন্দ্রীয় গদি লাভের কিছুদিন পরে মুম্বই-এর বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সুবর্ণ জয়ন্তী উৎসবে যোগদান করে আপনি বলেছিলেন, ‘ভারত হিন্দু রাষ্ট্র। দেশের প্রতিটি হিন্দু পরিবারের মধ্যে সেই হিন্দু পরিচয়ের আত্মশ্লাঘা জাগিয়ে তুলতে হবে। ভারতের সংস্কৃতির সনাতন আচারই হল হিন্দুত্ব’ (বর্তমান, ১৯ আগস্ট, ২০১৪) এরই কয়েকদিন আগে কটকে গিয়ে আপনি বলেছিলেন, ‘হিন্দুস্তানের গভীরে একটাই ধর্ম প্রোথিত আছে। সেটি হল হিন্দুত্ব’ (ওই)। সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টির অতি পরিচিত কণ্ঠস্বর নয় কি?

মোহন ভাগবতজি আপনি নিশ্চয়ই জানেন, আপনার সংঘের প্রেরণায় লিখিত গুজরাটের স্কুল পাঠ্য বই ‘প্রেরণাদীপ’-এ লেখা হয়েছে যে, গঙ্গায় মেশার পর কোনও স্রোতের কোনও আলাদা সত্ত্বা থাকতে পারে না। তাই যারা ভারতীয় সংস্কৃতিকে মিশ্র সংস্কৃতি বলে তারা সঠিক নয় (প্রেরণাদীপ বইয়ের ‘শিক্ষণ নু ভারতীয়করণ’ অংশ– পৃঃ ১৫)। আপনি এখন সব ধর্ম-বর্ণের মানুষকে সাথে নিয়ে চলার কথা বলছেন! আশ্চর্য!

মোহন ভাগবতজির গুরুদেব গোলওয়ালকর সাহেবের কথায়–‘হিন্দুস্তানের সমস্ত অহিন্দু মানুষ হয় হিন্দুর ভাষা ও সংস্কৃতি গ্রহণ করবে ও পবিত্র বলে জ্ঞান করবে, হিন্দু জাতির গৌরবগাথা ভিন্ন অন্য কোনও ধারণাকে প্রশ্রয় দেবে না। … এক কথায় তারা হয় বিদেশি হয়ে থাকবে, না হলে হিন্দু জাতির দেশে তারা থাকবে সম্পূর্ণভাবে হিন্দুদের অধীনস্থ হয়ে, কোনও দাবি ছাড়া, কোনও রকম সুবিধা ছাড়া ও কোনও রকম পক্ষপাতমূলক ব্যবস্থা ছাড়া। এমনকি নাগরিক অধিকারও তাদের থাকবে না’ (উই অর আওয়ার নেশনহুড ডিফাইন্ড, পৃঃ ৫২)। কী বোঝা গেল?

আরএসএস-এর চিন্তার মধ্যেই আছে এই বিদ্বেষের বিষ। তাদেরই রাজনৈতিক শাখা হিসেবে বিজেপিকে এই বিদ্বেষ বিষ দেশে ছড়ানোর কাজে বেছে নিয়েছে ভারতীয় পুঁজিপতি শ্রেণি। মূল্যবৃদ্ধি, বেকারি, দারিদ্র জর্জরিত জীবনে জনগণ যাতে প্রতিবাদের পথে না হাঁটে, তাদের দুর্দশার জন্য আসল দায়ী পুঁজিপতি শ্রেণির বদলে জনগণ যেন অপর ধর্ম, অপর জাত-বর্ণের মানুষকেই নিজেদের শত্রু বলে ভাবে, এটাই হল আসল পরিকল্পনা। এ দেশের শাসক শ্রেণির পরিকল্পনার ভিত্তিতেই সমাজের রন্ধে্র রন্ধে্র বিদ্বেষের চাষ করে চলেছে আরএসএস। তাদের হয়ে রাজনীতিতে এই বিদ্বেষ এনেছে বিজেপি। সমাজে এই বিদ্বেষ, এই অমর্যাদার পরিবেশ আরএসএস তৈরি করে রেখেছে বলেই স্বাধীনতার পর থেকে খেটে খাওয়া মানুষের ঐক্যকে ভাঙতে কখনও কংগ্রেস, কখনও জাতপাত ভিত্তিক নানা দল তাকে কাজে লাগাতে পেরেছে। আজ বিজেপি সে দায়িত্ব আরও বেশি দক্ষতার সঙ্গে পালন করে চলেছে।

মোহন ভাগবতজি আসলে কী চেয়েছেন? বিজেপি যখন রামমন্দির, মঙ্গলসূত্র কেড়ে নেওয়া ইত্যাদি নানা উস্কানিতে হিন্দু-মুসলমান বিভেদের জিগির তোলার আপ্রাণ চেষ্টা করেও সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের রোষের আগুন পুরোপুরি চাপা দিতে ব্যর্থ, তিনি তখন ভাল ভাল জনমোহিনী কথা বলে আরএসএস-বিজেপির কুকর্মের ওপর একটা মিষ্টি প্রলেপ লাগাতে চাইছেন। তাঁর ভাবখানা দেখে মনে হতে পারে কোনও শিশু ভুল করলে যেমন অভিভাবকরা ছদ্ম গাম্ভীর্যে বকুনি দেন, তেমন করেই তিনি নরেন্দ্র মোদিকে ভুল ধরাচ্ছেন! আসলে এতদিন যে ভাবে মোদিজিকে প্রায় অবতারের পর্যায়ে তুলে নিয়ে গিয়েছিল আরএসএস-বিজেপি, সে বেলুন চুপসে গেছে। তাই এখন তিনি নিজেই দেশের বিবেক সাজতে চেয়েছেন। যদি তাতে বিজেপির ক্ষতি কিছুটা মেরামত করা যায়! এ জন্যই এত উদার তিনি! হিন্দুত্বের শ্রীমুখ ছেড়ে তিনি এখন জাতির বিবেক এবং অভিভাবক সেজে বিদ্বেষের রাজনীতিকেই মানুষের রোষ থেকে একটু আড়াল করতে চান। নরেন্দ্র মোদির ভেকের মতোই এটা তাঁর নতুন ভেক। তবে মানুষ যে সহজে এতে ভুলছে না, এ বারের নির্বাচনে তা কিছুটা হলেও দেখা গেছে। খেটে খাওয়া মানুষকে সাবধান থাকতে হবে এই ভেকধারিদের কৌশল যাতে তাঁদের দৃষ্টিকে গুলিয়ে দিতে না পারে।