বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ‘অত্যন্ত দায়িত্ববান’ শাসক হিসেবে ইতিহাসের পুনর্লিখনে উদ্যোগী হয়েছেন। এমন ভাবে তারা ভারতের প্রাচীন ঐতিহ্য ও গরিমা পুনরুদ্ধারের জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন, যা দেখে মনে হতে পারে ভারতের জনগণ এতদিন যে ইতিহাস পড়ে এসেছিলেন তা সার্বৈব মিথ্যা! সে জন্যই নাকি তাদের এমন উদ্যোগ।
কিন্তু এই হিন্দুত্ববাদীদের ইতিহাস বা ইতিহাসের ধারণা জানলেন মানুষ আজ সহজেই বুঝতে পারবেন, প্রমাণহীন অন্ধ স্তুতিবাক্যে তাদের জুড়ি মেলা ভার। হিন্দুদের ইতিহাস গৌরবান্বিত করার নামে তাদের আসল উদ্দেশ্য ভারতীয় নাগরিকদের মধ্যে মুসলিম বিদ্বেষের বিষ ছড়ানো।
এ ক্ষেত্রে তাদের নতুন সংযোজন, ভারতে মুসলিমদের আক্রমণকারী হিসাবে চিহ্নিত করা। এছাড়া মুসলিম শাসকদের দ্বারা হিন্দু দেবদেবী, মন্দির এবং দেবত্তর সম্পত্তি লুঠপাট এবং ধ্বংসের অভিযোগ। তাদের মতে, ভারতের প্রাচীন ঐতিহ্য এবং অত্যন্ত উন্নত সমাজ, সভ্যতা পতনের মূলে রয়েছে মুসলিম শাসকরা। তারা ভারতে এসে এখানকার হিন্দু শাসকদের সাম্রাজ্য শুধু ধ্বংস করেছে তাই নয়, বহু হিন্দু মন্দির এবং হিন্দু দেবতাদের মূর্তি ধ্বংস করে তাদের ঐতিহ্য ও বিশ্বাসকে কালিমালিপ্ত করেছে। মুঘল পূর্ববর্তী বহিঃআক্রমণকারী এবং শাসকদের মূর্তি ধ্বংসের ইতিহাস বাদ দিয়েও বিজেপি নিযুক্ত ইতিহাস লেখকরা বলছেন, শুধুমাত্র মুঘলরা ভারতবর্ষের প্রায় ৮৬ হাজার হিন্দু মন্দির ধ্বংস করেছেন। যদিও এই সংখ্যা নিয়ে তাদের দলের মধ্যেই মতভেদ রয়েছে। বিজেপি সরকারের কোনও মন্ত্রী কখনও বলছেন, এই সংখ্যা ৫০ হাজার, অন্য কেউ বলছেন ৩০ হাজার। তাদের বক্তব্য, মুঘল পূর্ববর্তী মুসলিম শাসকরা হিন্দু মন্দির ধ্বংস এবং লুটপাটের যে রীতিনীতি চালু করে গেছেন, সেটি অত্যন্ত সুচারু ভাবে পালন করে গেছেন তার পরবর্তী মুঘল শাসকরা।
প্রকৃত ইতিহাস কিন্তু বলছে অন্য কথা। ইতিহাসবিদ রিচার্ড ইটনের ‘এসেস অন ইসলাম অ্যান্ড ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি’-তে দেখা যাচ্ছে, বিজেপির নেতৃত্বে হিন্দুত্ববাদীরা যে হাজার হাজার হিন্দু মন্দির ধ্বংসের কথা বলছেন তার কোনও ভিত্তি নেই। প্রামাণ্য নথি থেকে সুলতানি যুগে মোট ৮০টি হিন্দু মন্দির লুটপাট এবং ধ্বংসের হদিশ পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়াও দেখা যাচ্ছে, এই হিন্দু মন্দির লুটপাট ধ্বংসের শুরু হয় রাষ্ট্রকূট রাজা তৃতীয় ইন্দ্র- এর আমলে। দশম শতাব্দীর শুরুর দিকে তিনিই প্রথম কলাপ্রিয়ার হিন্দু মন্দির ধ্বংস করে সেখানকার সম্পত্তি লুটপাট করে নিজের সাম্রাজ্যে নিয়ে আসেন। প্রাক-আধুনিক যুগের ইতিহাস অনুযায়ী মন্দিরগুলি শুধুমাত্র আরাধনা গৃহ নয়, সংশ্লিষ্ট সাম্রাজ্যের স্বাস্থ্য এবং ধনসম্পদের প্রতিমূর্তি হিসেবেও গণ্য হত। মন্দিরগুলিতে সেই সময় প্রচুর ধনসম্পদ রাখা হত। সেই ধন-সম্পদ লুটপাট করে নিজের সাম্রাজ্যের সেনাবাহিনী রক্ষণাবেক্ষণ করার উদ্দেশ্য নিয়েই প্রথম বাইরের আক্রমণকারীরা ভারত ভূখণ্ডে আসেন। তার প্রায় কয়েক শতাব্দী পরে এখানে প্রতিষ্ঠিত হয় সুলতানি শাসন।
ঐতিহাসিকরা বলছেন সোমনাথ মন্দির সহ যে যে মন্দির ধ্বংস হয়েছে, তা মুসলিম শাসকরা তখনই ধ্বংস করেছে, যখন সেই সাম্রাজ্যের শাসকরা শক্তিশালী হয়ে সুলতানি শাসন বা মুঘল সম্রাটদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ ইতিহাস বলছে, ধর্মীয় কারণে নয়, নিজেদের আধিপত্য এবং শক্তিশালী উপস্থিতি জানান দিতেই তৎকালীন মুসলিম শাসকরা কেউ কেউ হিন্দু মন্দির ধ্বংস করেছেন। এই কথাগুলি বিজেপি নেতারা বলেন না। ক্রমাগত উস্কানি এবং অনৈতিক মিথ্যাচারের ফলে কিছু মানুষের মধ্যে এই মিথ্যা হিন্দুত্ববাদের ঝোঁক তৈরি করতে তাঁরা সফল হয়েছেন। যারই ফলে ধ্বংস হয় ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ। দেশের মানুষ ভুলতে পারেননি সেই কলঙ্কিত দিন। ভুলতে পারেননি বহু দাঙ্গার ইতিহাস। ভারতবর্ষের মতো একটি দেশে যেখানে বহু ধরনের ধর্ম বিশ্বাসী মানুষের বাস, সে দেশে এই মিথ্যা ইতিহাসের প্রচলন করতে চাইছে বিজেপি সরকার। যে ইতিহাস পড়ে সত্যিকারের ইতিহাস জানা তো দূর, সাধারণ মানুষের মনে জন্ম নেবে ধর্মীয় ঈর্ষা, প্রতিহিংসা। আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে পড়বে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প। তারা এই মিথ্যাকে ইতিহাস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছেন ইতিহাসের পুনর্লিখনের মাধ্যমে। তারা তৈরি করতে চাইছেন এমন একদল মানুষ উদার, মানবিক দৃষ্টির বদলে যারা বহন করবে উগ্র হিন্দুত্ববাদের দৃষ্টিভঙ্গি।
ভাস্বর হালদার
ছাত্র, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়