২৯ এপ্রিল ৩০০–র বেশি ‘দলিত’ সম্প্রদায়ের মানুষ হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করলেন৷ এঁরা প্রত্যেকেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির রাজ্য গুজরাটের৷ ৪৫ জন উনা শহরের একই পরিবারের৷ ২০১৬ সালের জুলাইয়ে এই পরিবারের চার যুবককে মারধর করে অর্ধনগ্ন অবস্থায় একটি জিপের সঙ্গে শক্ত করে বেঁধে প্রকাশ্য দিবালোকে রাজপথে ঘুরিয়ে ছিল বিজেপির গোরক্ষক বাহিনী৷ দেশ জোড়া তীব্র প্রতিবাদের চাপে গুজরাটের তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী আনন্দীবেন প্যাটেল প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এই হেনস্থার প্রতিকার করবেন৷ করেননি৷ দুষ্কৃতীরা তাই উৎসাহিত৷ জামিনে মুক্ত হয়ে তারা একইভাবে দলিতদের হুমকি দিয়ে চলেছে৷ দলিত হেনস্থা প্রতিরোধে যে আইন ছিল, ইতিমধ্যে তাকেও সুপ্রিমকোর্ট লঘু করে দিয়েছে৷ দলিতরা এর বিরুদ্ধে ভারত বনধের ডাক দিলে বিজেপি সরকারের পুলিশের আক্রমণে ৯ জন দলিত নিহত হন৷ এই অবস্থায় গভীর দুঃখে, অপমানে এবং নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কায় তিনশতাধিক দলিত হিন্দুধর্ম ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিলেন, এখানে ধর্মান্তর গৌণ, আসল হল প্রাণভয়৷
জোর করে ধর্মান্তরিত করার অভিযোগ বরাবরই বিজেপি করে থাকে৷ এবার যাতে সেই অভিযোগ তুলতে না পারে সে জন্য উক্ত দলিতরা স্বেচ্ছায় বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণের ফর্ম পূরণ করে জেলাশাসকের দপ্তরে জমা দিয়েছেন৷ স্পষ্ট ঘোষণা করেছেন, দলিত অপমানের প্রতিবাদে এই ধর্ম পরিবর্তন৷ অর্থাৎ দলিতদের কাছে এই ধর্মান্তর আসলে প্রতিবাদ আন্দোলনের একটা রূপ৷
বাস্তবিকই বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর দলিতদের উপর অত্যাচার অনেক বেড়ে গিয়েছে৷ বিজেপির হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি যত উগ্র রূপ নিচ্ছে ততই বেড়ে চলেছে হিন্দু সমাজের বর্ণ ব্যবস্থার সবচেয়ে নিচের স্তরের এই মানুষদের উপর আক্রমণ৷ একইভাবে বেড়ে চলেছে মুসলিমদের উপর আক্রমণ৷
বিজেপি হিন্দুর স্বার্থ রক্ষার যে বাগাড়ম্বর করে সে কোন হিন্দু? হিন্দু সমাজের সবেচেয়ে দরিদ্র, অবহেলিত, নিষ্পেষিত যে অংশ ‘শূদ্র’ নামে পরিচিত–যার জাগরণ দেখতে চেয়েছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ– সেই শূদ্ররা বিজেপি শাসনে চূড়ান্ত নিরাপত্তাহীন এবং অমর্যাদার শিকার হয়ে হিন্দুধর্ম ছেড়ে বাঁচতে চায়৷ এটা কি বিজেপির হিন্দুস্বার্থ রক্ষার নমুনা? না হিন্দু ধর্মের প্রতি অমর্যাদা প্রদর্শন? এ কি জনগণের হিতার্থে ধর্মাচরণ, না হিন্দু ধর্মের আলখাল্লা পরে ধর্মীয় আবেগকে কাজে লাগিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের ভোট দখলের অভিসন্ধি?
হিন্দু সমাজের বর্ণপ্রথা—ব্রাহ্মণ–ক্ষত্রিয়–বৈশ্য-শূদ্র অতীতে যে কারণেই এর উদ্ভব ঘটে থাকুক, আজ তার বিশেষ মূল্য নেই৷ এই বর্ণ বিভেদ যুগ যুগ ধরে বর্ণবিদ্বেষের জন্ম দিয়ে নিম্নবর্ণের হিন্দুদের উপর উচ্চবর্ণের অত্যাচার কায়েম করেছে৷ এই উচ্চবর্ণীয় ব্রাহ্মণ্যবাদী অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচতে একটা বিরাট অংশের নিম্নবর্ণের মানুষ মুসলিম হয়েছেন, যার উল্লেখ পাওয়া যায় বিবেকানন্দ সহ অন্যান্য ইতিহাসবিদদের রচনাবলিতে৷ পরবর্তীকালে আরেকটা বড় অংশ ডঃ বি আর আম্বেদকরের নেতৃত্বে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন৷ এখনও করছেন৷
কিন্তু এই ধর্মান্তরকরণ দ্বারা এই সমস্যার সমাধান কি সম্ভব? দলিতদের মধ্য থেকে রামনাথ কোবিন্দের মতো কেউ রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী হলেই কি সমাজে দলিতদের সম্মান প্রতিষ্ঠিত হবে? দলিত জাগরণ আন্দোলনকে ব্যবহার করে দলিতদের মধ্যে যারা পুঁজিপতি বা কোটি কোটি টাকার মালিক, তারা বা তাদের দল কোনও কোনও রাজ্যে নির্বাচনে সংগরিষ্ঠতা অর্জন করে সরকার গঠন করতে পারে, কিন্তু তার দ্বারা পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক শোষণ থেকে দরিদ্র দলিতদের মুক্তি ঘটবে না৷ দলিতরা শুধু সামাজিক ভাবেই তো দলিত নন, কিছু কোটিপতি দলিত বাদ দিলে এদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ জনগণের অন্য অংশের মানুষের মতোই আর্থিকভাবে শোষিত এবং কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের জনবিরোধী শাসনে তারা একইভাবে বঞ্চিত৷ পুঁজিপতি শ্রেণির অর্থনৈতিক শোষণ এবং সরকারের জনবিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে দলিত অদলিত নির্বিশেষে সব অংশের শোষিত–লাঞ্ছিত মানুষকে যুক্ত করে গণআন্দোলন গড়ে তুলতে পারলে, সেই আন্দোলন তাদের মধ্যে এক নতুন উন্নত ভাব বা চেতনার জন্ম দেবে৷ এই আন্দোলনের সমস্বার্থবোধই তাঁদের মধ্যে ঐক্য সংহতি গড়ে তুলবে, বিভেদকে ভোলাতে সাহায্য করবে৷ এপথেই সামাজিক বিভেদ অনেকটা দূর করা সম্ভব৷ ধর্মান্তরকরণ দ্বারা এর হাত থেকে মুক্তি নেই৷ সমমর্যাদা বা সাম্যের যে আকাঙক্ষা নিয়ে দলিতরা বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করলেন, নিশ্চয়ই তাঁরা উপলব্ধি করবেন বৌদ্ধ ধর্মের মানুষরাও ধনী ও গরিবে বিভক্ত৷ ধর্ম যতই সাম্যের বাণী শোনাক, বৌদ্ধ পুঁজিপতির শোষণে দরিদ্র বৌদ্ধরা জর্জরিত৷ পুঁজিবাদী ব্যবস্থা উচ্ছেদ করে অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠা ছাড়া বাস্তবে সামাজিক সাম্যও সম্ভব নয়৷ যথার্থ কমিউনিস্টরা এই সাম্যের বনিয়াদ রচনার সংগ্রামে লিপ্ত৷ সেই কারণে কমিউনিজমই দলিত মুক্তির যথার্থ রাস্তা৷
(৭০ বর্ষ ৩৬ সংখ্যা ২৭ এপ্রিল, ২০১৮)