70 Year 33 Issue 6 April, 2018
প্রথম কিস্তি
কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী ‘সত্যদ্রষ্টা’ সত্যপাল সিং একটি নতুন সত্য ‘আবিষ্কার’ করেছেন৷ সম্প্রতি তিনি ডারডইনের বিবর্তন তত্ত্বকে নস্যাৎ করার অপচেষ্টায় বলেছেন যে, ডারডইনের তত্ত্ব ‘বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে ভুল’৷ তাঁর ব্যাখ্যা, ‘আমাদের পূর্বপুরুষরা কোথাও উল্লেখ করেননি যে, তারাও কখনও কোনও বাঁদরকে মানুষ হতে দেখেছেন৷ কেডই বলে বা লিখে যাননি যে, তাঁরা কেউ এ ঘটনা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছেন৷ আমাদের পূর্বপুরুষদের লেখা কোনও বই বা গল্প–গাথায় এ ধরনের ঘটনার উল্লেখ নেই৷ তাই বিজ্ঞানের বই থেকে এই তত্ত্বকে বাদ দিতে হবে৷’
স্বাভাবিকভাবেই মানবসম্পদ উন্নয়ন দপ্তরের একজন মন্ত্রীর এ ধরনের দায়িত্বজ্ঞানহীন এবং বিজ্ঞানবিরোধী মন্তব্যের বিরুদ্ধে সারা দেশ জুড়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে৷ বিশেষ করে দেশের শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞানীরা এর তীব্র প্রতিবাদ করেছেন৷ দেশের তিনটি শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞান অ্যাকাডেমি এক যৌথ বিবৃতিতে বলেছে, ‘মন্ত্রী মহোদয়ের বক্তব্যের কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই৷ বিবর্তন তত্ত্ব, যাতে ডারডইনের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে, তা দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত৷ বিবর্তনের তত্ত্বের বাস্তবতা নিয়ে বৈজ্ঞানিকদের মধ্যে কোনও বিতর্ক নেই৷ এটা একটা বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব এবং এমন একটা তত্ত্ব যার ভিত্তিতে এমন বহু অনুমান বা ভবিষ্যদ্বাণী (প্রেডিকশন) করা সম্ভব হয়েছে, যেগুলো পরীক্ষা–নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে সত্য প্রমাণিত হয়েছে৷ এই তত্ত্বের একটা গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য হল, এই গ্রহের বাসিন্দা মানুষ ও অন্যান্য বানর জাতীয় প্রাণী সহ সমস্ত জীবই কোনও না কোনও পূর্বতন জীব (প্রোজেনিটর) থেকে বিবর্তিত হয়েছে৷’
দু’হাজারেরও বেশি প্রথম সারির বৈজ্ঞানিক এই বিজ্ঞান অ্যাকাডেমিগুলির সাথে যুক্ত৷ এগুলি হল, নিউ দিল্লির দি ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল সায়েন্স অ্যাকাডেমি, ব্যাঙ্গালোরের দি ইন্ডিয়ান অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস এবং এলাহাবাদের দি ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস অফ ইন্ডিয়া৷
উক্ত বিবৃতিতে বিজ্ঞানীরা আরও বলেছেন, ‘স্কুল–কলেজের পাঠ্যক্রম থেকে বিবর্তন তত্ত্বের শিক্ষা বাদ দেওয়া বা এ সম্পর্কে অবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বা কল্পকথা (মিথ) পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভূক্ত করে বিবর্তনের বৈজ্ঞানিক তত্ত্বকে লঘু করার যে কোনও সিদ্ধান্ত বাস্তবে পশ্চাদমুখী পদক্ষেপ হবে৷ বিবর্তন সংক্রান্ত ‘প্রাকৃতিক নির্বাচনের’ তত্ত্ব, যা ডারডইন প্রথম আবিষ্কার করেছিলেন এবং পরবর্তীকালে যা উন্নত হয়েছে, আধুনিক জীববিদ্যা ও চিকিৎসাশাস্ত্রে এবং অবশ্যই আধুনিক বিজ্ঞানে তার প্রভূত প্রভাব রয়েছে৷ সারা বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানীমহলে এটা সর্বজন স্বীকৃত৷’
উক্ত বিজ্ঞানীরা মন্ত্রী মহোদয়ের বক্তব্যের বিরুদ্ধে একটি অনলাইন পিটিশনে স্বাক্ষর করেছেন৷ ইতিমধ্যেই পাঁচ হাজারেরও বেশি বিজ্ঞানী এতে সই করেছেন৷ প্রতিবাদ করেছে সর্বভারতীয় বিজ্ঞান সংগঠন ব্রেকথ্রু সায়েন্স সোসাইটি সহ বিভিন্ন বিজ্ঞান সংগঠন৷ ব্রেকথ্রু সায়েন্স সোসাইটির পক্ষ থেকে ডারডইনের জন্মদিন ১২ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৮ ফেব্রুয়ারি প্রতিবাদ সপ্তাহ পালন করা হয়৷
বিজ্ঞানী মহল থেকে প্রবল প্রতিবাদ হলেও মন্ত্রীমশাই তাঁর বক্তব্যে অনড়৷ তাঁর দাবি, তিনি একজন বিজ্ঞান জগতের মানুষ এবং বলেছেন, ‘বিশ্বজুড়ে ডারডইনের তত্ত্ব চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে, ডারডইনবাদ হল একটা মিথ৷ আমি যদি কোনও কথা বলি, তাহলে তা ভিত্তিহীনভাবে বলি না৷ …আমি বিজ্ঞানের ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে এসেছি, আর্টস–এর ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে নয়৷ …আমি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কেমিস্ট্রিতে পি এইচ ডি করেছি৷’ তিনি এখানেই থামেননি৷ জোরের সাথে বলেছেন, ‘মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক অর্থ বরাদ্দ করলে ডারউইনের মতবাদ স্কুল–কলেজে পড়ানো উচিত কি না তা ঠিক করার জন্য একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন ডাকার জন্য আমি প্রস্তাব রাখছি৷’
ফলে বিষয়টি এমন নয় যে, মন্ত্রীমহোদয় ভুল করে এসব বলে ফেলেছেন৷ এটা তাঁর ‘সুচিন্তিত’ মতামত এবং তিনি তাঁর মতটিকেই ‘বৈজ্ঞানিক’ বলে প্রতিষ্ঠিত করতে চান৷ তাই ডারউইনের বিবর্তনবাদের বৈজ্ঞানিক ভিত্তিটিকে যেমন ঠিক ভাবে বোঝা দরকার, তেমনি ভেবে দেখা দরকার যে, দেড় শতাধিক বছর ধরে বহু পরীক্ষায় প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত একটা বৈজ্ঞানিক তত্ত্বকে নস্যাৎ করে দেওয়ার পিছনে কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকারের ডদ্দেশ্য কী?
জীব বিবর্তন সম্পর্কিত ধারণার সূত্র
সত্যপাল সিং যে একেবারে নতুন কথা বলেছেন এমন নয়৷ প্রাচীনকালে, এমনকী রেনেসাঁস পূর্ববর্তী সময়ে, যখন ভূতত্ত্ব ও জীববিজ্ঞানের বিকাশ হয়নি, তখন মানুষ জীব সৃষ্টি সম্পর্কে যে রকম ভাবনা ধারণা নিয়ে চলত, ‘কেমিস্ট্রিতে পিএইচডি ডিগ্রিধারী’ মন্ত্রীমশাইয়ের ধারণা সেই চিন্তার সমগোত্রীয়৷ সেদিন মানুষ তার অভিজ্ঞতা দিয়ে দেখেছে যে, তার জীবনকালে যে সমস্ত গাছপালা, জন্তু–জানোয়ার সে দেখেছে তার কোনও পরিবর্তন হয়নি৷ তাই মানুষ ধরেই নিয়েছে, সমস্ত গাছপালা, জন্তু–জানোয়ার প্রথম থেকে এমনটাই ছিল৷ ধর্মীয় গ্রন্থে বলা হয়েছিল যে, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড যিনি সৃষ্টি করেছেন তিনিই মানুষের সুবিধা–সুবিধার কথা ভেবে এই সব সৃষ্টি করেছেন৷ এমনকী যিনি জীববিজ্ঞান চর্চার সূত্রপাত করেছিলেন, সেই অ্যারিস্টটলও এই ধরনের চিন্তার শরিক ছিলেন৷ তিনি তাঁর দেখা জীব জগৎকে কতকগুলি শ্রেণিতে ভাগ করেন৷ এই শ্রেণিগুলি ছিল বিশুদ্ধতার মাত্রা অনুসারে নির্ধারিত৷ ক্রমবিন্যাসের নিম্নস্তরে ছিল খনিজ পদার্থ, উপরের ধাপে মানুষ৷ অ্যারিস্টটল মনে করতেন বিশ্বজগৎ অপরিবর্তনীয়৷ সমস্ত প্রাণ ও জড় জগৎ বিশুদ্ধতার মাত্রাকে বজায় রেখে শাশ্বতকাল একই রয়েছে৷ এই চিন্তার সাথে বাইবেলের চিন্তা বেশ খাপ খেয়ে গিয়েছিল৷ তাই এই চিন্তা প্রায় দু’হাজার বছর ধরে সমাজ মননে স্থান করে নিয়েছিল৷
এই ধারণা নিয়ে প্রশ্ন উঠল রেনেসাঁসের যুগে৷ ব্যবসা–বাণিজ্যের ব্যাপক বিস্তারকে ভিত্তি করে যখন মানুষের চেনা জগৎটা প্রসারিত হল, নিত্য নতুন অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হতে শুরু করল, তখন নতুন নতুন জিজ্ঞাসারও সৃষ্টি হল৷ নতুন নতুন জায়গায় নতুন নতুন উদ্ভিদ ও প্রাণীর দেখা পাওয়া গেল৷ বিশেষ করে জীবাশ্মের আবিষ্কার একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করল৷ এমন অনেক প্রাণী বা উদ্ভিদের জীবাশ্ম ভূবিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করলেন, যাদের কোনও জীবিত সদস্য পাওয়া যায় না৷ প্রশ্ন ডঠল– এরা জন্মেছিল কবে এবং অবলুপ্ত হল কবে? অবলুপ্ত হলই বা কেন? এরই পাশাপাশি আর একটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য৷ বিজ্ঞানী লিনিয়াস বিভিন্ন উদ্ভিদ ও প্রাণীর শ্রেণিবিভাগ ও নামকরণ করতে গিয়ে একটা ঘটনা লক্ষ করলেন৷ দেখলেন যে, উদ্ভিদ ও প্রাণী জগতের এই বিশেষ বিশেষ প্রজাতি, গণ ইত্যাদি গোষ্ঠীগুলির মধ্যে কতকগুলির দেহগঠন সরল, আবার আর একদলের দেহগঠন জটিল৷ যাদের দেহগঠন সরল, তাদের জৈবিক ক্রিয়া প্রক্রিয়াও সরল৷ আর যাদের দেহ–গঠন জটিল, তাদের জৈবিক ক্রিয়া প্রক্রিয়াও জটিল৷ তিনি বিভিন্ন উদ্ভিদ ও প্রাণীর দৈহিক গঠনের সাদৃশ্য–বৈসাদৃশ্যর ভিত্তিতে তাদের বিভিন্ন প্রজাতি ও গণে বিভক্ত করলেন৷ যেমন বাঘ, চিতা, জাগুয়ার, সিংহ ও গৃহপোষ্য বিড়ালের মধ্যে একটা সাদৃশ্য আছে৷ তাই তারা একই গণ–এর সদস্য৷ প্রশ্ন এল বিভিন্ন উদ্ভিদ বা প্রাণীর মধ্যেকার সাদৃশ্য কি নিতান্তই কাকতালীয়, না এর মধ্যে কোনও কার্যকারণ সম্পর্ক রয়েছে? সরল ও জটিল দেহগঠনের জীব কি একসঙ্গে সৃষ্টি হয়েছে, নাকি এর মধ্যে কোনও পর্যায়ক্রম রয়েছে?
এ ক্ষেত্রে ভূতাত্ত্বিকরা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সামনে নিয়ে এলেন৷ দেখা গেল, যে জীবাশ্মগুলি যত প্রাচীনকালের ভূত্বকে পাওয়া যাচ্ছে, সাধারণত সেগুলি তত সরল দেহগঠন সম্পন্ন এবং যত আধুনিক কালের ভূস্তরে পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলি সাধারণভাবে তত জটিল ও বৈচিত্র্যপূর্ণ৷
এই তথ্য থেকে এটা পরিষ্কার হল পৃথিবীতে সব উদ্ভিদ বা সব প্রাণী এক সঙ্গে সৃষ্টি হয়নি৷ তাদের মধ্যে কিছু আগে এবং কিছু পরে হয়েছে৷ অর্থাৎ তাদের সৃষ্টির একটা পর্যায়ক্রম রয়েছে৷
জৈব বিবর্তনের ধারণার সূত্রপাত : লামার্কের মতবাদ
এরকম কেন হয়? অনেকেই সেদিন এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন৷ কিন্তু প্রথম এর একটা বিজ্ঞানসম্মত ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করলেন বিজ্ঞানী লামার্ক৷ তিনি বললেন, উদ্ভিদ বা প্রাণীর বিবর্তন বলতে বোঝায় মূলত জীবদেহের বিভিন্ন অঙ্গগুলির রূপান্তর এবং তার মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে নতুন জীবের উৎপত্তি৷ কিন্তু এই রূপান্তর হয় কেন? লামার্ক এর উত্তরে ব্যবহার–ব্যবহারে তত্ত্ব উপস্থিত করেন৷ তিনি বললেন, প্রাকৃতিক পরিবেশের পরিবর্তনের ফলে একটা বিশেষ পরিবেশে অভ্যস্ত উদ্ভিদ বা প্রাণী যখন একটা নতুন ভিন্নতর পরিবেশের মধ্যে এসে পড়ে, তখন সেই অবস্থার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে গিয়ে সেই জীবের কোনও কোনও অঙ্গের প্রয়োজন বেড়ে যায়, ফলে তার ব্যবহারও বাড়ে৷ অন্যান্য অঙ্গগুলির প্রয়োজন কমে যায়, ফলে তার ব্যবহারও কমে৷ যার ব্যবহার বাড়ে তার বিকাশ ঘটে, সেটা সুগঠিত হয় এবং স্থায়ী রূপ নেয়৷ যার ব্যবহার কমে যায় সেটা বিলুপ্তির দিকে এগোয়৷ এইভাবে কয়েক প্রজন্ম পার হওয়ার পর সেই জীবের দেহগঠন পালটে যায় এবং এক সময় নতুন প্রজাতির সৃষ্টি হয়৷ এটাই হল লামার্কের ব্যবহার–ব্যবহার তত্ত্বের মূল কথা৷
বিবর্তনের এই পদ্ধতি অর্জিত বৈশিষ্ট্যের উত্তরাধিকার নামে খ্যাত৷ তাঁর মতে, ব্যবহার ও অব্যবহারের পদ্ধতির ফলে জীবদেহে যে অল্প অল্প পরিমাণে পরিবর্তন ঘটে তা উত্তরাধিকার সূত্রে জীবের সন্তানরা পেয়ে থাকে৷ এই ভাবে বংশ পরম্পরায় ক্রমপরিবর্তনের ফলে পরিবর্তিত প্রজাতির সৃষ্টি হয়৷ এই তত্ত্বের দ্বারা অনেক প্রাণীর বিবর্তনের ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব হলেও৷ কিছু প্রশ্ন থেকেই গেল৷ যেমন, সম্পূর্ণ নতুন ধরনের অঙ্গ সৃষ্টির কী? আবার সত্যিই কি যে অঙ্গ ব্যবহূত হয় এবং তার ভিত্তিতে সুগঠিত হয় তা পরবর্তী প্রজন্মে সঞ্চারিত হয়? বাস্তবে বহু পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে বোঝা গেছে কোনও একটি জীবের জীবদ্দশায় ব্যবহার বা অব্যবহারের ফলে অর্জিত বৈশিষ্ট্য পরবর্তী প্রজন্মে বর্তায় না৷
ডারউইন ও বিবর্তনবাদ
লামার্কের বিবর্তন সংক্রান্ত ধারণা তাঁর পরবর্তী বিজ্ঞানীদের প্রবলভাবে প্রভাবিত করে৷ চার্লস ডারউইন তাঁদের মধ্যে অন্যতম৷ জীব জগতের সৃষ্টি যে বিবর্তনের মধ্য দিয়ে– এই ধারণাকে ভিত্তি করে ডারউইন তাঁর কাজ শুরু করেন৷ তাঁর ‘অরিজিন অফ স্পিসিস’ গ্রন্থে ডারউইন দুটি বিষয় সম্বন্ধে তথ্যপ্রমাণ দাখিল করেছেন৷ তার মধ্যে একটি হল বিবর্তনের অস্তিত্ব এবং অপরটি হল বিবর্তনের পদ্ধতি সম্বন্ধে তত্ত্ব, অর্থাৎ প্রাকৃতিক নির্বাচন৷ লামার্কের মতো ডারউইনও নিশ্চিত ছিলেন যে, অতীতের সদৃশ কিন্তু কিছু কিছু পার্থক্য বিশিষ্ট পূর্বসূরি থেকেই আজকের প্রজাতিগুলির উদ্ভব৷ এ বিষয়ে যে বিপুল সাক্ষ্যপ্রমাণ তিনি হাজির করেন, তা আসে মূলত গৃহপালিত এবং বন্য জীবের প্রকারণ (ভ্যারিয়েশন) সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান থেকে৷ তাঁকে আরও সাহায্য করেছিল জীবজগতের শ্রেণি বিন্যাস, তুলনামূলক শারীর সংস্থানবিদ্যা এবং ভ্রূণ বিদ্যা, প্রজাতিগুলির ভৌগোলিক বণ্টন, ভূ–বিদ্যা– এ সমস্ত বিষয়ে তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য৷
কিন্তু ডারউইন মাননীয় মন্ত্রী সত্যপালজির মতো ‘সায়েন্স ব্যাকগ্রাউন্ডের’ মানুষ ছিলেন না৷ তিনি যথার্থই বৈজ্ঞানিক মননের অধিকারী ছিলেন৷ তাই বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের মধ্য দিয়েই তিনি তাঁর ধারণা তৈরি করেছিলেন এবং সেই ধারণাকে তথ্যপ্রমাণ দিয়ে বারংবার যাচাই করেছেন, সত্যপালজির মতো মনগড়া ধারণার ভিত্তিতে কিছু বলেননি৷ বিবর্তন সম্বন্ধে ডারউইনের দেওয়া যে সাক্ষ্যপ্রমাণ, তার অধিকাংশই আসে বিগল জাহাজে তাঁর পাঁচ বছরের ভ্রমণের সময়৷ পাঁচ বছরের এই দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রায় বিগল মাঝে মাঝে দীর্ঘ সময় থেমে থাকত, তার অনেকটাই ছিল দক্ষিণ আমেরিকার সমুদ্রে৷ অ্যাটলান্টিক মহাসাগরের অজানা অচেনা দ্বীপে ততোধিক অজানা অচেনা জৈব বৈচিত্র্যে তিনি ডুবে গিয়েছিলেন৷ এই সফরের সঞ্চিত অভিজ্ঞতাই তাঁকে বিবর্তন সম্পর্কে চিন্তা শুরু করতে বাধ্য করেছিল৷ ওই সময় বিভিন্ন দ্বীপের প্রাণীজগতকে তিনি খুব খুঁটিয়ে লক্ষ করেন৷ দক্ষিণ আমেরিকার উত্তর থেকে দক্ষিণে কীভাবে প্রজাতিগুলি পরিবর্তিত হচ্ছে এবং একই অঞ্চলে তাঁর আবিষৃক্ত জীবাশ্ম এবং বর্তমান প্রজাতিগুলির কী সম্পর্ক৷ তা তিনি শুধু লক্ষ করেই ক্ষান্ত হননি, প্রচুর জীবন্ত এবং ফসিল নমুনা সংগ্রহ করেছিলেন৷
১৮৩৬ সালে ইংল্যান্ডে ফেরার পর ডারউইন তাঁর ভ্রমণের ফলাফল লিখে ফেলায় মন দেন৷ সঙ্গে সঙ্গে তিনি জীবের পরিবর্তনের উপর বিভিন্ন সূত্র থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে থাকেন৷ প্রজাতির উৎপত্তি সম্পর্কে ডারউইন তাঁর ধ্যান ধারণা প্রথম লিখতে শুরু করেছিলেন ১৮৪২ সাল নাগাদ এবং ১৮৪৪ সালে মোটামুটি একটা পূর্ণাবয়ব খসড়া প্রস্তুত করেন৷ কিন্তু তাঁর প্রমাণ সংগ্রহের কাজ ১৮৫৬ সাল পর্যন্ত চলছিলই৷ সেই সময় তাঁর বন্ধু ভূতত্ত্ববিদ লায়েলের উৎসাহে তিনি চারখণ্ডে তাঁর কাজের কথা লিখবেন বলে ভাবেন৷ কিন্তু এই কাজ যখন প্রায় কিছুই এগোয়নি, তখন মালয় দ্বীপপুঞ্জ থেকে আলফ্রেড ওয়ালেস তাঁর কাছে একটি পাণ্ডুলিপি পাঠান, যাতে প্রাকৃতিক নির্বাচনের তত্ত্বের রূপরেখা দেওয়া হয়েছে৷ ডারউইন পাণ্ডুলিপিটির ভূয়সী প্রশংসা করে লায়েলের কাছে পাঠান এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এটি ছাপতে বলেন৷ লায়েল এবং হুকার, যাঁরা ডারউইনের কাজের সাথে পরিচিত ছিলেন, তাঁরা পরামর্শ দেন ওয়ালেসের পাণ্ডুলিপি এবং মার্কিন বিজ্ঞানী গ্রেকে লেখা তাঁর একটি চিঠি একসঙ্গে প্রকাশ করতে৷ ১৮৫৮ সালে এগুলি প্রকাশিত হয়৷ আগের পরিকল্পনা বাতিল করে ডারউইন এক খণ্ডে তাঁর বিখ্যাত বই ‘অরিজিন অফ স্পিসিস’ প্রকাশ করেন এক বছর পরে ১৮৫৯ সালে৷ বইটি প্রকাশ হওয়া মাত্র চারিদিকে সাড়া পড়ে যায়৷
ডারউইন ছিলেন আপাদমস্তক বৈজ্ঞানিক৷ বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা–নিরীক্ষা এবং বাস্তব তথ্য ব্যতিরেকে অন্য কোনও বিষয়ের উপর, কোনও মনগড়া ধারণার উপর তিনি নির্ভর করেননি৷ তাই ১৮৪৪ সালের মধ্যে বিবর্তন সংক্রান্ত ধারণার খসড়া তৈরি করলেও তখনই তা প্রকাশ করেননি৷ বাস্তব তথ্যের ভিত্তিতে তা যাচাই করেছেন৷ একবার নয়, বার বার বারো বছর ধরে৷ এমনকী যখন তিনি জানতে পারলেন যে, আলফ্রেড ওয়ালেস তাঁরই মতো বিবর্তনের পদ্ধতি হিসাবে প্রাকৃতিক নির্বাচনের কথা বলছেন, তখনও উদ্বেগবোধ করেননি৷ সেটা ছাপার ব্যবস্থা করেছেন৷ এখানে তাঁর উচ্চ বৈজ্ঞানিক নৈতিকতারও পরিচয় পাওয়া যায়৷
যে সমস্ত পর্যবেক্ষণ ও ধারণার উপর ডারউইন নির্ভর করেছিলেন, সেগুলি অত্যন্ত সহজ কিছু ঘটনা এবং তার থেকে আসে এমন কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে গড়া৷ যেমন সহজেই দেখা যায় যে, সমস্ত প্রজাতির অপত্য উৎপাদনের ক্ষমতা তাদের বর্তমান সংখ্যা বজায় রাখতে যা দরকার তার তুলনায় অবিশ্বাস্য পরিমাণে বেশি৷ এই উৎপাদনের ক্ষমতা যদি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয় তবে প্রজাতির জনসংখ্যা বাড়তে থাকবে জ্যামিতিক প্রগতিতে৷ এমনকী যাদের সব থেকে কম সন্তান ডৎপাদনকারী বলে মনে করা হয়, সেই হাতির কথাও যদি ধরা হয়, তাদেরও এই ক্ষমতা আছে৷ ডারউইন হিসেব করে দেখিয়েছিলেন যে, এক জোড়া হাতি থেকে শুরু করলে ৭৫০ বছরে হাতির সংখ্যা দাঁড়াবে এক কোটি নব্বই লক্ষ৷
অপত্য উৎপাদনের এত ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও একটা অঞ্চলে একটা প্রজাতির জনসংখ্যা মোটামুটি সমান থাকে৷ সময়ের সাথে খুব একটা বাড়ে না, বা কমে না৷ বছরে বছরে একটা ওঠাপড়া সবসময়েই থাকে, কিন্তু সাধারণত ক্রমাগত সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটে না৷ আগের দুটি পর্যবেক্ষণ থেকে যে সিদ্ধান্তে আসতেই হয় তা হল– জন্ম নেওয়া বাচ্চাদের সবকটি নিশ্চয়ই বড় হয়ে ডঠতে পারে না৷ বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রামে তাদের মধ্যে অধিকাংশই প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই মারা যায়৷
কেন এমন হয়? এই প্রশ্ন নিয়ে ভাবতে গিয়ে ডারউইন লক্ষ করলেন যে, কোনও প্রজাতির দু’টি জীব কখনও একেবারে একরকম হয় না৷ সবসময়ই তাদের মধ্যে কিছু না কিছু পার্থক্য থাকে যাকে জীববিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় প্রকারণ (ভ্যারিয়েশন)৷ জীবজগতে প্রকারণ একটা সর্বব্যাপী ঘটনা৷
এই পর্যবেক্ষণ থেকে ডারউইন এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে, যেহেতু দু’টি জীবের দেহগঠনে কিছু না কিছু পার্থক্য থাকে, তাই পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষমতায়ও পার্থক্য থাকে, ফলে কিছু কিছু জীব অন্যদের তুলনায় বাঁচার পক্ষে বেশি ডপযোগী হয়৷ এই ঘটনাকে বলা হয় অভিযোজন (অ্যাডাপটেশন)৷ তাই যাদের অভিযোজন ক্ষমতা বেশি তাদের পক্ষেই প্রজননক্ষম অবস্থায় পৌঁছানোর সম্ভাবনা বেশি৷ তারাই জীবনযুদ্ধে জয়ী হয়৷ আর অভিযোজনের ক্ষমতাসম্পন্ন গুণগুলি যদি বংশানুক্রমিক হয়, তবে তাদের অপত্যের মধ্যেও এই গুণগুলি সঞ্চারিত হবে৷ তার ফলে পরবর্তী প্রজন্মে উপযুক্ত জীবের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে৷ সুতরাং সময়ের সঙ্গে প্রাকৃতিক নির্বাচনের প্রক্রিয়া এইভাবে একটি প্রজাতির বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করতে সক্ষম, যার ফলে বিবর্তন ঘটে৷
তাহলে একটা বিষয় পরিষ্কার হল যে, সময়ের সাথে সাথে প্রজাতির পরিবর্তন হয় – কিছু নতুন প্রজাতির সৃষ্টি হয়, কিছু প্রজাতি অবলুপ্ত হয়ে যায়৷ আবার কিছু প্রজাতি নতুন নতুন প্রজাতিতে বিভক্ত হয়ে যায়৷ অর্থাৎ এক পূর্বসূরি থেকে বিভিন্ন প্রজাতির সৃষ্টি হয়৷ কালের প্রবাহে এই প্রক্রিয়া চলতেই থাকে৷ তাই ডারউইন বিবর্তনের এই প্রক্রিয়াটিকে গাছের সাথে তুলনা করেছিলেন৷ গাছের যেমন শাখা–প্রশাখা থাকে, একটা শাখা থেকে একাধিক প্রশাখা বের হয়, বিবর্তনের প্রক্রিয়াটিও সেইরকম৷ একই পূর্বসূরি প্রজাতি থেকে দুই বা ততোধিক প্রজাতি সৃষ্টি হয়৷
ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই ‘কমন ডিসেন্ট’–এর ধারণা যা তাঁকে তাঁর পূর্বসূরিদের থেকে আলাদা করেছিল৷ তাঁর সময়কালে বা অব্যবহিত পূর্বে যাঁরা বিবর্তনের কথাও বলেছেন, তাঁরা একটা প্রজাতির অন্য প্রজাতিতে রূপান্তর বা ‘ড্রান্সমিশন’–এর কথা বলেছেন, কিন্তু ‘কমন ডিসেন্ট’ বা ‘কমন অ্যানসেস্টর’এর কথা বলেননি৷
দ্বিতীয় কিস্তি
জিনতত্ত্ব ও ডারউইনের বিবর্তনবাদ
বিজ্ঞান একটি গতিশীল প্রক্রিয়া৷ নিত্য নতুন আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে কখনও পুরনো চিন্তা বাতিল হয়ে যায়, আবার কখনও নতুন আবিষ্কারের আলোকে পুরনো তত্ত্ব পরিশীলিত হয়, নতুন রূপে দেখা দেয়৷ বংশগতিবিদ্যার প্রতিষ্ঠার পর ডারউইনবাদের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় ঘটনাটিই ঘটেছে৷ বংশগতিবিদ্যার জনক মেন্ডেল যখন তাঁর যুগান্তকারী গবেষণা করছিলেন এবং গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেছিলেন, সেই সময়টা ডারউইনের সমসাময়িককাল৷ কিন্তু মেন্ডেলের কাজটি দীর্ঘদিন বিজ্ঞানী মহলে অজানাই থেকে যায়৷ ১৯০০ সালে কোরেন্স, দ্য ফ্রিজ এবং ফনৎসেরমাক মেন্ডেলের জেনেটিক তত্ত্ব পুনরাবিষ্কার করেন৷ এরপর ডারউইনবাদ কিছুকালের জন্য তীব্র আক্রমণের মুখে পড়ে৷ ১৯০২ সালে দ্য ফ্রিজের পরিব্যক্তি (মিউটেশন) তত্ত্ব প্রকাশের পর প্রাকৃতিক নির্বাচন এবং নিরন্তর প্রকারণের (ভ্যারিয়েশন) ধারণা প্রশ্নের মুখে পড়ে৷ ‘ওইনোথরা’ গণের উদ্ভিদ নিয়ে কাজ করার সময় দ্য ফ্রিজ আকস্মিক পরিবর্তন বা পরিব্যক্তির যে রূপ দেখতে পান, তার থেকে তিনি সিদ্ধান্তে আসেন যে, বিবর্তন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিবর্তনের উপর নির্বাচনের ফলে না হয়ে আকস্মিক পরিবর্তন বা পরিব্যক্তির ফলে উদ্ভূত বড় মাপের পরিবর্তন থেকে হয়৷
পরবর্তীকালে অবশ্য ক্রমশ বিজ্ঞানীদের কাছে পরিষ্কার হতে থাকে যে, ডারউইনবাদ এবং জেনেটিক তত্ত্বের মধ্যে কোনও বিরোধ তো নেই–ই, বরং জেনেটিক তত্ত্ব ডারউইনের বিবর্তনবাদের পক্ষে মূল স্তম্ভস্বরূপ৷ এর ফলে যে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আমরা বিবর্তনকে দেখতে শুরু করলাম তাকে বলা যায় প্রাকৃতিক নির্বাচনের জেনেটিক তত্ত্ব বা সুক্ষ্ম বিবর্তনের তত্ত্ব (মাইক্রোএভোলিডশন)৷ মেন্ডেলের সময় বা তার পরে যখন মেন্ডেলের তত্ত্ব পুনরাবিষ্কৃত হয়, তখন ধারণা ছিল, একটি প্রজাতির জেনেটিক বৈশিষ্ট্য অপরিবর্তনীয়৷ কিন্তু সুক্ষ্ম বিবর্তনের বিষয়বস্তু হল প্রজাতির জেনেটিক বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন বা পরিব্যক্তির ফলে কেমন করে নতুন প্রকারণ সৃষ্টি হয় এবং তার মধ্য দিয়ে কী করে নতুন প্রজাতির উদ্ভব হয়৷ নতুন প্রজাতির উদ্ভব থেকে শুরু হয় বিবর্তনের নতুন পর্যায়– যাকে বলা যেতে পারে স্থূল বিবর্তন (ম্যাক্রোএভোলিডশন)৷
বিবর্তনের প্রক্রিয়া
আমরা আগেই বলেছি, পরিব্যক্তির ফলে জনগোষ্ঠীর মধ্যে নতুন ধরনের জিন জন্ম নিতে পারে৷ পরিব্যক্তির ফলেই সৃষ্টি হয় নতুন বৈশিষ্ট্য৷ তাই নিঃসন্দেহে পরিব্যক্তি বিবর্তনের মূল চালিকাশক্তি৷ কিন্তু শুধুমাত্র পরিব্যক্তির দ্বারাই জীবজগতের বিবর্তন ঘটতে পারে না৷
প্রাকৃতিক নির্বাচনের ফলেই বিবর্তন হয়৷ ডারউইনবাদের এটাই মূল স্তম্ভ৷ কিন্তু প্রজাতির মধ্যে নতুন জিনের সূত্রপাত হওয়া দরকার৷ না হলে নির্বাচন হবে কীসের ভিত্তিতে? ডারউইন বলেছিলেন, একই প্রজন্মের সন্তানদের মধ্যেও গুণাবলির প্রকারণ দেখা যায়৷ কিন্তু এই প্রকারণের মূল সূত্র কোথায়? ডারউইনের সময় এটা জানা ছিল না৷ এখন আমরা জানি পরিব্যক্তিই প্রকারণের মূল সূত্র৷ তাই বলা যায়, পরিব্যক্তি এবং প্রাকৃতিক নির্বাচনের যোগসাজসেই বিবর্তন হয়৷ এখন বোঝা গেছে মিউটেশনের ফলে স্বাভাবিকভাবেই যে কোনও প্রজাতিতে নতুন নতুন বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন জীব সৃষ্টি হয়৷ কিন্তু সেই বৈশিষ্ট্য তাকে অভিযোজনে সাহায্য না করলে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে তা অপসারিত হয়ে যায়৷ আর যদি কোনও অভিযোজনের অনুকূল বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি হয় তবে তা ওই প্রজাতিতে টিকে যায় ও পরবর্তী প্রজন্মের জন্ম দেয়৷ এর ফলেই প্রজাতির সামগ্রিক জেনেটিক বৈশিষ্ট্যে পরিবর্তন হতে পারে৷ বর্তমানে জনগোষ্ঠীর বংশগতিবিদ্যার সাহায্যে অনেক শক্তিশালী ও সম্ভাবনাময় গাণিতিক সূত্রের আবিষ্কার হয়েছে৷ এখন পরিষ্কারভাবে বলে দেওয়া যায় কোনও একটি নবপরিব্যক্ত জিন জনগোষ্ঠীতে স্থান পাবে কি পাবে না, বলা যায় কোন কোন নতুন জিন হবে প্রবল এবং কোনটা হবে স্তিমিত৷ প্রাকৃতিক নির্বাচনের প্রাবল্যের সঙ্গে কোনও জিনের প্রকারণের কী সম্পর্ক হবে সে সম্পর্কে গাণিতিক উপপাদ্য প্রমাণিত হয়েছে৷ বর্তমানে এই তাত্ত্বিক বিজ্ঞানের সাহায্যে প্রমাণিত হয়েছে যে, জীবের গুণাবলির ডপর যেমন পরিবেশের প্রভাব রয়েছে, তেমনি তার জেনেটিক গঠনেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে৷
পৃথকীকরণ বিবর্তনের একটি অন্যতম উৎস৷ নবপরিব্যক্ত জীবেরা যদি তাদের প্রজাতির অন্য সদস্যের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তাহলে খুব তাড়াতাড়ি বিবর্তন ঘটতে পারে৷ পৃথকীকরণ নানা ভাবে ঘটতে পারে৷ যেমন, ভৌগোলিক পৃথকীকরণ৷ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বা অন্য কোনও কারণে একই প্রজাতি অনেক সময় দ্বিধা বিভক্ত হয়ে যায়৷ বহুকাল বাদে এই দুই অংশকে একই প্রজাতির বলে শনাক্ত করা মুশকিল হয়ে পড়ে৷ উদাহরণস্বরূপ অষ্ট্রেলিয়ার কথা বলা যায়৷ এই ভূখণ্ডটি পৃথিবীর অন্যান্য অংশ থেকে বহুকাল বিচ্ছিন্ন৷ সেইজন্য এখানে বিবর্তন এমন এক পথে হয়েছে যে, সারা পৃথিবীতে তার সাদৃশ্য পাওয়া যায় না৷ আফ্রিকা আর ভারত– দুই জায়গাতেই চিতা, হায়না, সিংহ, হাতি, গণ্ডার পাওয়া যায়৷ কিন্তু তাদের শারীরিক বৈশিষ্ট্য আলাদা৷ এ থেকে বোঝা যায় সুদূর অতীতে এই দুই ভূখণ্ড সংযুক্ত ছিল৷ এক সময় বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় দুই ভূখণ্ডের জীব দুই পথে বিবর্তিত হয়েছে৷ পৃথকীকরণের সবচেয়ে জোরালো প্রকাশ ঘটে যখন প্রজননগত বিভেদ ঘটে৷ একটি প্রজাতির দু’টি অংশ বহুদিন পৃথক থাকতে থাকতে নিজেদের মধ্যে প্রজননের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে৷ এদের মধ্যে যৌন সংযোগ হলে সন্তান হয় না বা মৃত সন্তান হয় অথবা নির্বীজ সন্তানের জন্ম হয়৷ তখন তারা হয়ে যায় দু’টি আলাদা প্রজাতি৷
এতক্ষণের আলোচনায় এটা পরিষ্কার যে জীবজগতের বিবর্তন একটি বাস্তব ঘটনা৷ সূর্যের চারিদিকে পৃথিবীর আবর্তন যতখানি সত্য, এটাও ততখানি সত্য৷ আজকে এটা প্রমাণিত এবং এর ঐতিহাসিক উপাদান পৃথিবীর উপরিত্বকের স্তরে স্তরে সংরক্ষিত আছে, যা কঠিন বাস্তব এবং বিজ্ঞান মানলে যাকে অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই৷
বানর থেকেই কি মানুষের উদ্ভব?
সত্যপালজির মতো কেউ কেউ ডারউইনের সময়েই এই প্রশ্নটি উত্থাপন করেছেন এবং এটা যে কোনও মতেই হতে পারে না তা জোরগলায় বলেছেন৷ মন্ত্রীমশাই একটা সত্য কথাই বলেছেন– কেউ কখনও কোনও বানরকে মানুষ হতে দেখেনি, এমনকী আমাদের পূর্বপুরুষরাও নয়৷ আসলে ডারউইনও কোথাও বলেননি যে, বানর থেকেই মানুষের উদ্ভব৷ ডারউইন ও বিবর্তন তত্ত্বের মূল কথাটা হল– গোড়ায় পৃথিবী ছিল নিষ্প্রাণ, তারপর এক সময় প্রাণের উৎপত্তি হল, প্রাণের বিকাশ ও বিবর্তনের ধারায় এককোষী এবং পরে বহুকোষী উদ্ভিদ ও প্রাণীর জন্ম হল৷ প্রাণীগুলির বিবর্তনের পথে এক সময় বানর সদৃশ প্রাণীর উদ্ভব হল৷ এই বানর সদৃশ প্রাণীগুলির কোনও কোনও প্রজাতি থেকেই ভিন্ন ভিন্ন সময়ে উল্লুক, বেবুন, গরিলা, শিম্পাঞ্জি, ওরাংওটাং ও মানুষের উদ্ভব হয়েছে৷
এই বানর সদৃশ প্রাণীগুলিকে এক বৃহৎ বর্গ প্রাইমেটের অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে৷ মানুষও প্রাইমেট বর্গভূক্ত প্রাণী৷ কোনও একটি অধুনালুপ্ত প্রাচীন প্রজাতি থেকেই মানুষের বিবর্তন শুরু হয়েছিল৷ আজকাল নানা জায়গায় যে সমস্ত বানর দেখতে পাওয়া যায়, তারা মানুষের পূর্বপুরুষ নয়৷ এমনকী গরিলা, শিম্পাঞ্জি, ইত্যাদি যাদের এপ বলা হয়, তারাও মানুষের পূর্বপুরুষ নয়৷ এরা প্রত্যেকেই অতীতের এক একটি প্রাইমেট প্রজাতি থেকে বিবর্তিত হয়ে আজকের পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে৷ আধুনিক ভাষায় বলা যায়, ‘‘মানুষ বানর থেকে উদ্ভূত হয়নি, কিন্তু মানুষ ও এপ কোনও এক সাধারণ প্রাইমেট প্রাণী থেকেই বিবর্তিত হয়েছে৷’’ বিজ্ঞানীরা মানুষের বিবর্তনকে এভাবেই ব্যাখ্যা করেছেন৷ কিন্তু কেমিস্ট্রিতে পিএইচডি মাননীয় মন্ত্রীর এই সাধারণ জ্ঞানটুকুর বড়ই অভাব!
প্রশ্ন হল, বানর–সদৃশ প্রাইমেট থেকে মানুষের উদ্ভবের যে রূপরেখা ডারউইন তুলে ধরেছিলেন, তার ভিত্তি কী? ডারউইন এর উত্তর দিয়েছেন তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ডিসেন্ট অফ ম্যান’–এ৷ হেকেলের ‘দ্য এভোলিউশন অফ ম্যান’ গ্রন্থেও এ সম্পর্কে আলোচনা পাওয়া যায়৷ এইসব গ্রন্থে যে সমস্ত যুক্তির অবতারণা করা হয়েছে সেগুলি হল–
(১) এক পর্যায়ের প্রজাতি থেকে পরবর্তী পর্যায়ের প্রজাতির এবং নিম্নতর প্রাণী থেকে উচ্চতর প্রাণীর উদ্ভবের সাধারণ বিবর্তনবাদী সূত্রটি মেনে নিলে মানুষের উৎপত্তির ক্ষেত্রেও তা অস্বীকার করা চলে না৷
(২) গঠন সাদৃশ্য বিচার সংক্রান্ত যে নীতিটি বিবর্তনবাদের বিচারপদ্ধতি হিসাবে ধরা হয়, তা বানর, গরিলা, শিম্পাঞ্জি, ওরাংওটাং ও মানুষের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করলে অনেকগুলি অনন্য সাদৃশ্য চোখে পড়ে৷ একটা হিসাবে দেখা যায়, ওরাংওটাং–এর ৫৬টি, উল্লুকের ৮৪টি, গরিলার ৮৭টি এবং শিম্পাঞ্জির ৯৮টি বৈশিষ্ট্য মানুষের সাথে মিলে যায়৷ আধুনিক অণুজীববিজ্ঞানের আলোকে দেখা যাচ্ছে, ডিএনএ–গত বিচারে গরিলা–শিম্পাঞ্জির সঙ্গে মানুষের প্রায় ৯৮ শতাংশ উপাদানেই সাদৃশ্য রয়েছে৷
(৩) মানুষের সাথে এই সব এপ বা বনমানুষের রক্তের গঠন ও গ্রুপ বৈচিত্র্য এবং অন্যান্য তুলনীয় অঙ্গ–প্রত্যঙ্গের বা পেশিগুলির কলার মধ্যে যে সমস্ত সাদৃশ্য পাওয়া যায় তাও উপেক্ষা করা যায় না৷
(৪) জীবনচক্র, প্রজনন, ঋতুচক্র, গর্ভধারণকাল, আয়ুষ্কাল, শাবক পালন, রোগবৈচিত্র্য ইত্যাদিতেও মানুষের সাথে এদের প্রভূত সাদৃশ্য রয়েছে৷
(৫) ভ্রূণাবস্থার প্রথমদিকে এদের মধ্যে পার্থক্য ধরতে পারা কঠিন৷ সদ্যোজাত বানর বা বন মানুষের শাবকের ও মানব শিশুর সাথে অনেক মিল রয়েছে৷
এই সমস্ত ঘটনা থেকে বিবর্তনবাদীরা বলেছিলেন, এই সাদৃশ্যগুলি থেকে এ কথা সহজেই বলা যায় যে, এটা এদের জৈব পরম্পরাগতভাবে কোনও এক সাধারণ আদি পূর্বপুরুষ থেকে ভিন্ন ভিন্ন ধারায় বিবর্তিত হওয়ার প্রমাণ৷ এ ছাড়া অন্যভাবে এগুলির ব্যাখ্যা হয় না৷ ঠিকমতো অনুসন্ধান চালাতে পারলে এমন কিছু জীবাশ্মের সন্ধান নিশ্চয় পাওয়া যাবে যারা মানুষের নিকটতম এবং বর্তমান বনমানুষগুলোর তুলনায় উন্নততর কিন্তু আধুনিক মানুষের তুলনায় পশ্চাদপদ ছিল৷
অনুসন্ধান শুরুও হয়ে গেল৷ সত্যি সত্যিই পাওয়া গেল এই ধরনের হারিয়ে যাওয়া প্রাণীর জীবাশ্ম, যার ভিত্তিতে সঠিকভাবে বলে দেওয়া সম্ভব হল বানর–সদৃশ প্রাণী থেকে আধুনিক মানুষ, অর্থাৎ হোমো স্যাপিয়েন্স–এর বিবর্তনের বিভিন্ন পর্যায়৷ তাই মানুষের বিবর্তন সম্পর্কে আজ আর কোনও রকমের প্রহেলিকা নেই৷
কেন এই আক্রমণ?
সত্যপাল সিং–ই প্রথম ব্যক্তি নন৷ ‘অরিজিন অফ স্পিসিজ’ প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই এই আক্রমণ শুরু হয়েছে৷ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দিক থেকে আক্রমণ এসেছে৷ সূর্যের চারিদিকে পৃথিবীর আবর্তন সংক্রান্ত কোপার্নিকাসের তত্ত্ব বাদ দিলে আর কোনও তত্ত্ব এত জোরালো আক্রমণের শিকার হয়নি৷ বিশেষ করে আক্রমণ এসেছিল বাইবেলপন্থীদের পক্ষ থেকে৷ বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ঈশ্বর সৃষ্টি করেছেন এবং তাঁর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হল মানুষ– এই বিশ্বাস সমস্ত ধর্মগ্রন্থের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়৷ ডারউইনের বিবর্তনবাদ এই জায়গাতেই আঘাত হেনেছে৷
ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষের বাসস্থান এই পৃথিবীতে৷ তাই পৃথিবী ব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্র না হয়ে পারে না– শাসক শ্রেণি প্রচারিত এই ধারণার মূলে কোপার্নিকাস ও গ্যালিলিওর সৌরকেন্দ্রিক ব্রহ্মাণ্ডের ধারণা যেমন সজোরে আঘাত করেছিল, তেমনি ডারউইনের বিবর্তনবাদ জৈব বিবর্তনের প্রাকৃতিক নিয়ম আবিষ্কার করে মানুষের সৃষ্টির পিছনে অতিপ্রাকৃত শক্তির ভূমিকা নস্যাৎ করেছে৷
এতদিন যা ছিল প্রহেলিকা, ডারউইন তাকে বৈজ্ঞানিক ভিত্তি দিলেন৷ প্রমাণ করলেন, জড় বস্তুর মতো জীব জগতের পরিবর্তনও সুনির্দিষ্ট প্রাকৃতিক নিয়মে ঘটে৷ বস্তুবহির্ভূত কোনও শক্তির উপর নির্ভর না করে তিনি সম্পূর্ণরূপে প্রকৃতির নিজস্ব নিয়মের উপরই নির্ভর করেছিলেন৷
পৃথিবী এই ব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্রচ্যুত হলেও সনাতনপন্থীদের একটা সাত্বনা ছিল– অন্তত মানুষ বিধাতার অনন্য সৃষ্টি৷ ডারউইনের আবিষ্কার সেখানেও আঘাত হানল৷ এই আঘাতে বরবাদ হয়ে গেল ধর্মতত্ত্বের অনেক কিছুই৷ প্রজাতির স্থায়িত্ব এবং বাইবেলের সৃষ্টিতত্ত্ব সৃষ্টির ঘোষিত কারণসমূহ বাতিল হয়ে গেল৷ এটা গোঁড়া ধর্মবিশ্বাসীদের কাছে ছিল একটা শোকাবহ ব্যাপার৷ কারণ বাতিল করার প্রয়োজন হয়ে পড়ল বিধাতার বদান্যতার শত যুক্তি৷ কিন্তু ধর্মতাত্ত্বিকদের কাছে সবচেয়ে বিপর্যয়কারী কথা হল ডারউইনের এই সোচ্চার ঘোষণা– নিম্নতর প্রাণী থেকে মানুষের আবির্ভাব ঘটেছে৷ ধর্মতত্ত্ববিদরা এই তত্ত্বের একটা দিকের উপর জোর দিয়ে প্রচার করলেন৷ সেটা হল, ‘ডারউইন বলেছেন, মানুষের আবির্ভাব ঘটেছে বাঁদর থেকে৷’ এই কথায় সারা বিশ্ব আতঙ্কে সচকিত হয়ে উঠল৷ বিদ্রুপ করে বলা শুরু হল, ডারউইন এটা বিশ্বাস করেন, কারণ তিনি নিজে দেখতে বাঁদরের মতো৷ অরিজিন অফ স্পিসিজ বইটি প্রকাশের এক বছর পরে ১৮৬০ সালে ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশনে বিশপ উইলবারফোর্স এক বিতর্ক সভায় ডারউইনপন্থী হাক্সলেকে আক্রমণ করে বললেন, ‘‘কোন দিক দিয়ে বাঁদর থেকে আপনার জন্ম– বাবার দিক থেকে না মায়ের দিক থেকে?’’ ডারউইন বিরোধিতায় সামিল হলেন শুধু ক্যাথলিকরাই নয়, প্রোটেস্টান্টরাও৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কিছু রাজ্যে ডারউইনের বিবর্তনবাদ পড়ানো এখনও নিষিদ্ধ৷ সে দেশে টেনেসি রাজ্যের কিছু লোকের মর্যাদায় এতটাই লেগেছিল যে, তারা একটি স্কুলে একজন জীববিজ্ঞান শিক্ষকের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করে, কারণ তিনি বাইবেলের মতবাদের পরিবর্তে ডারউইনের তত্ত্ব পড়িয়েছিলেন৷ তাতে তাঁর ১০০ ডলার জরিমানা হয়৷ ধর্মীয় কূপমণ্ডুকতার আধুনিক ধ্বজাধারীরা ও তাদের প্রতিনিধি বিজেপির মাননীয় মন্ত্রী মহোদয় এঁদেরই দোসর৷ কারণ ধর্মীয় চিন্তা ও ধর্মীয় উন্মাদনা না হলে এঁদের চলে না৷ তাই শুধু ডারউইন নয়, আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুও এঁদের আক্রমণের লক্ষ্য৷
আধুনিক বিজ্ঞানের গবেষণায় নয়, তাঁদের চিন্তা আটকে রয়েছে যতসব বস্তাপচা মান্ধাতা আমলের কূপমণ্ডুকতার মধ্যে৷ চিরকাল শাসক শ্রেণি চেয়েছে মানুষের চিন্তাকে অন্ধতায় আচ্ছন্ন করে দিতে৷ আমাদের দেশের শাসকরাও তার ব্যতিক্রম নয়৷ আমাদের এখনই সজাগ হতে হবে, প্রতিবাদে মুখর হতে হবে, না হলে দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা যা অর্জন করেছি তা হারিয়ে ফেলব৷ এবারের ঘটনায় আমরা তা প্রত্যক্ষ করলাম৷ সত্যপাল সিং–এর মন্তব্যের বিরুদ্ধে সারা দেশজুড়ে বিজ্ঞানী মহলে এবং সাধারণ মানুষের মধ্য থেকে যে প্রবল জনমত তৈরি হয়েছে তার চাপে কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী প্রকাশ জাভরেকর তাঁর ডেপুটির মন্তব্য যে ভুল তা প্রকাশ্যে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন৷ বলেছেন, তাঁর মন্ত্রক এ ব্যাপারে কোনও জাতীয় বা আন্তর্জাতিক সম্মেলনের কথা ভাবছে না৷ এটা আন্দোলনের একটা জয়৷ প্রতিবাদের চাপে সরকার এখন পিছু হটলেও ভবিষ্যতে যে তারা অনুরূপ আক্রমণ করবে না, তার কোনও গ্যারান্টি নেই৷ তাই বিজেপি ও সংঘ পরিবারের এই ধরনের বিজ্ঞানবিরোধী পদক্ষেপের বিরুদ্ধে জনসাধারণকে সদাসতর্ক থাকতে হবে৷ (শেষ)
তথ্যসূত্র :
১) জীব বিবর্তনের ইতিহাস, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ, কলকাতা, ১৯৮৯৷ ২) বিবর্তন যুগে যুগে, ব্রেকথ্রু প্রকাশনা, ২০০৯৷ ৩) জ্ঞান ও বিজ্ঞান, বিবর্তনবাদ বিশেষ সংখ্যা, বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ,১৯৯৩।৪) The descent of Man, Charles Darwin, London, 1871, ৫) The Evolution of Man, Earnest Haekel, 1874, ৬) Man The Toolmaker, KP Oakley, London, 1975, ৭) Fossil Man, Michael H. Day. London, 1969, ৮) ধর্ম ও বিজ্ঞান, বার্ট্রান্ড রাসেল, কলকাতা, ২০০৭, ৯)Proletarian Era, Vol 42, No 9-10৷