দেশের সমস্ত ভাষাভাষী মানুষের ওপর হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের ভাষা নীতির বিরুদ্ধে চেন্নাই শহরে দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলির সম্মেলন অনুষ্ঠিত হল ১৭ ফেব্রুয়ারি। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের নেতৃত্বে সরকারি ভাষা সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি হিন্দিকে একমাত্র সরকারি ভাষা ও কেন্দ্রীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে হিন্দিকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ঘোষণা করা এবং ইংরেজি শিক্ষার গুরুত্ব হ্রাস করা সহ কিছু সুপারিশ করেছে। এই সুপারিশগুলি জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০-র অনুসারী। এর বিরুদ্ধে সারা ভারত সেভ এডুকেশন কমিটির দক্ষিণ ভারতীয় রাজ্যগুলির যৌথ উদ্যোগে চেন্নাই শহরের ত্যাগরাজ হলে ‘ভাষা বাঁচাও কনভেনশন’-এ সভাপতিত্ব করেন প্রাক্তন উপাচার্য এবং বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ এল জহর নেশান। কনভেনশন শুরুর আগে শহিদ বেদিতে মাল্যদান করেন সভাপতি জহর নেশান, সারা ভারত সেভ এডুকেশন কমিটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য বিশিষ্ট ভূবিজ্ঞানী অধ্যাপক ধ্রুবজ্যোতি মুখোপাধ্যায় এবং সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক তরুণকান্তি নস্কর। শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বক্তব্য রাখেন তামিলনাড়ুর বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ উমা মাহেশ্বরী সহ আরও কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। উপস্থিত সহস্রাধিক ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবক-শিক্ষাবিদ-বুদ্ধিজীবী সরকারের এই ভাষানীতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখান। কনভেনশনে মূল প্রস্তাব পেশ করেন অধ্যাপক যোগরাজন। সভাপতির ভাষণে অধ্যাপক জহর নেশন বলেন, আমরা কোনও একটি বিশেষ ভাষার বিরোধিতা করার জন্য আন্দোলন করছি না। ভারতের সমস্ত ভাষার সমান গুরুত্ব আমরা দাবি করছি। কেন্দ্রীয় সরকারের হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান, তথাকথিত দেশভক্তি, উগ্র জাতীয়তাবাদ ইত্যাদির তীব্র সমালোচনা করে তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের হিন্দিনীতি হিটলারের ইতিহাসকে মনে করিয়ে দিচ্ছে।
দিল্লির জে এন ইউ-এর প্রাক্তন অধ্যাপক সচ্চিদানন্দ সিনহা লিখিত বক্তব্যে জানান, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে সরকারি ভাষা সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির হিন্দিকে একমাত্র সরকারি ভাষা করার সিদ্ধান্ত ভারতের বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের সংস্কৃতিকে বিনষ্ট করবে। হিন্দিকে উচ্চশিক্ষা, কারিগরি, মেডিকেল ও অন্যান্য পেশাগত শিক্ষার মাধ্যম করার ফরমান শিক্ষাক্ষেত্রে সমূহ বিপদ ডেকে আনবে। অধ্যাপক ধ্রুবজ্যোতি মুখোপাধ্যায় উদ্বোধনী ভাষণে বলেন, উন্নত ভাষা উন্নত চিন্তার বাহন। সরকারের এই পদক্ষেপ হিন্দি সমেত দেশের সকল ভাষার বিকাশে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। বিশ্বের জ্ঞানভাণ্ডার থেকে তা ভারতকে বিচ্ছিন্ন করবে এবং দেশের নানা ভাষাভাষী মানুষের মধ্যে অনৈক্য ডেকে আনবে। প্রাথমিক স্তর থেকে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা দিতে হলে প্রতিটি ভাষার অতি দ্রুত উন্নতির ব্যবস্থা কেন্দ্রীয় সরকারকে করতে হবে। ইতিহাসবিদ অধ্যাপক এ করুণানন্দন বলেন, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ আমাদের দেশ দখল করলেও ইংরেজি ভাষা আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করেছে। বিদ্যাসাগর বুঝেছিলেন এদেশের মুক্তির জন্য ইংরেজি ভাষা পাশ্চাত্য জ্ঞান বিজ্ঞানের গুরুত্ব। স্বাধীনতা এসেছে ইংরেজি ভাষার জন্য, হিন্দি ভাষার জন্য নয়। ইংরেজরাই এক সময় হিন্দি চাপিয়ে দেশের মানুষকে বিভক্ত করার ব্যবস্থা করেছিল। ডঃ মারিয়া জোসেফ (লায়েলা গ্রুপ অফ ইনস্টিটিউশনের সম্পাদক)-এর মতে কেন্দ্রীয় সরকারের এই ভাষানীতি বহু বিতর্কিত প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। একে প্রতিরোধ করা প্রয়োজন। সারা ভারত সেভ এডুকেশন কমিটির সম্পাদক তরুণকান্তি নস্কর বলেন, সেভ এডুকেশন কমিটি হিন্দির বিরুদ্ধে নয়, হিন্দি সমেত সমস্ত ভারতীয় ভাষার বিকাশের পক্ষে। সংবিধানের অষ্টম তফসিলে অন্তর্ভুক্ত ভাষাগুলির মধ্যে সংস্কৃত থাকলেও ইংরেজি সেই তালিকায় কেন নেই তা বিস্ময়ের বিষয়। কেন্দ্রীয় সরকার হিন্দি সমেত কোনও ভারতীয় ভাষার উন্নতি চায় না বলেই ইংরেজির গুরুত্ব কমিয়ে হিন্দিকে চাপাতে চাইছে। তিনি দাবি করেন, হিন্দিকে কোনওভাবেই একমাত্র সরকারি ভাষা, শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে চাপিয়ে দেওয়া চলবে না, মাতৃভাষার মাধ্যমে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে এবং হিন্দি সহ সমস্ত রাজ্যের ভাষাগুলি যাতে অত্যন্ত দ্রুত সেই অবস্থায় পৌঁছাতে পারে তার দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে। শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকে ইংরেজিকে প্রয়োজনীয় গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে, ইংরেজিকে যেমন সরকারি ভাষা হিসাবে বজায় রাখতে হবে এবং তাকে সংবিধানের অষ্টম তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে দেশজুড়ে জেলায় জেলায় এর বিরুদ্ধে তিনি বিক্ষোভ সংগঠিত করার আহ্বান জানান।
অন্য বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন অধ্যাপক আর মুরলি (তেলেঙ্গানা), প্রবীণ সাংবাদিক বি ভাস্কর (কেরালা), অধ্যাপক এ চন্দ্রশেখর (অন্ধ্রপ্রদেশ), ডঃ মারিয়া জোসেফ (তামিলনাড়ু), অধ্যাপক আল্লামপ্রভু বেত্তাদুরু (কর্ণাটক) প্রমুখ। দক্ষিণ ভারতের ছয় রাজ্য অর্থাৎ কেরালা, কর্ণাটক, তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা এবং পণ্ডিচেরির প্রতিনিধিরা এই কনভেনশনে অংশ নিয়েছিলেন। দিল্লি, মধ্যপ্রদেশ, ওড়িশা, পাঞ্জাব, পশ্চিমবঙ্গ সহ অন্যান্য রাজ্যের সেভ এডুকেশন আন্দোলনের নেতৃবৃন্দও উপস্থিত ছিলেন। চেন্নাই শহরের বহু কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক গবেষক এবং ছাত্রছাত্রীদের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। মানুষের উপস্থিতি এত বেশি ছিল যে হলের বাইরে বড় টিভি স্ক্রিনে অনুষ্ঠান দেখানোর ব্যবস্থা করতে হয়েছিল। চেন্নাই শহরের প্রতিষ্ঠিত কলেজ ও স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা তাঁদের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে এমনকি স্কুল-কলেজের বাসে করে এই কনভেনশনে যোগ দেন। সন্তানদের শিক্ষার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত বহু অভিভাবকও তাঁদের সন্তানদের নিয়ে এই কনভেনশনে উপস্থিত হয়েছিলেন।