‘‘আমরা গরিব মানুষ, পড়াশোনা জানি না। গ্রামের লোকেরা কেউ দিনমজুরি, কেউ রাজমিস্ত্রির জোগাড়ে, কেউ বা রং মিস্ত্রির কাজ করে। এখানে পুরুষরা কষ্ট ভুলতে মদের নেশায় ডুব দেয়, আর মহিলারা একটু শান্তির খোঁজে এই সব ধর্মীয় সমাবেশে যায়’’– বলছিলেন অঞ্জলি দেবী, যাঁর দুই পড়শি আশা দেবী ও মুন্নি দেবী ২ জুলাই হাথরসে ‘ভোলে বাবা’র ধর্মীয় সমাবেশে পদপিষ্ট হয়ে মারা গেছেন। এ দিনের ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনায় আবার খবরে উঠে এসেছে উত্তরপ্রদেশের হাথরস। সেখানকার ফুলেরিয়া গ্রামে ২ জুলাই স্বঘোষিত ধর্মগুরু সুরজ পাল ওরফে ভোলে বাবা ওরফে নারায়ণ সাকার হরির ধর্মসভায় পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যু হয়েছে ১২৬ জনের, যাঁদের বেশিরভাগই মহিলা। আহতদের সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি। বহু মানুষ এখনও নিখোঁজ। এর আগে ২০২০ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর এই হাথরসেই উচ্চবর্ণের দুষ্কৃতীদের দ্বারা ধর্ষিতা এক দলিত-কন্যার মৃতদেহ পরিজনদের না জানিয়েই পুড়িয়ে দিয়েছিল শাসক বিজেপির আজ্ঞাবাহী পুলিশ, যা নিয়ে দেশ জুড়ে ব্যাপক শোরগোল হয়েছিল।
জানা গেছে হাথরসে সেদিনের সমাবেশে হাজির হয়েছিলেন শিশু-মহিলা সহ আড়াই লাখ মানুষ। ৮০ হাজারের অনুমতি থাকা সত্ত্বেও তার কয়েক গুণ বেশি মানুষ যে সেখানে জমায়েত হচ্ছে, ‘আইনশৃঙ্খলার স্বর্গরাজ্যে’র প্রশাসনের নাকি তা জানা ছিল না। ফলে উপযুক্ত সংখ্যায় পুলিশ সেখানে উপস্থিত ছিল না। সভা শেষে ধর্মগুরু সুরজ পাল মণ্ডপ থেকে বেরোতেই তাঁর পদধূলি নেওয়ার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। ভক্তরা কাণ্ডজ্ঞানরহিত হয়ে গুরুর গাড়ির দিকে দৌড়তে থাকেন। গুরুর রক্ষীরা ভিড় সামলাতে লাঠি চালালে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি তৈরি হয়। অনেকে পিছনের মাঠের দিকে যেতে চাইলে বৃষ্টির জলে ভেজা মাটিতে পিছলে পড়েন। তাঁদের শরীরের উপর দিয়েই দৌড়তে থাকেন অন্যরা। এই মারাত্মক বিশৃঙ্খলায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে, প্রবল আঘাতে শরীরের ভিতরের দেহাংশ বিকল হয়ে কিংবা অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণে ১২৬ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে। রাজ্য জুড়ে এখন শোকের ছায়া।
প্রশ্ন হল, স্থানীয় প্রশাসন কেন জানতে পারল না যে, এই ধর্মসভায় এমন বিপুল সংখ্যায় জমায়েত হচ্ছে? কেন তার জন্য প্রয়োজনীয় পুলিশি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হল না? কেন সমাবেশ শুরুর আগে প্রশাসনিক প্রধানরা সরেজমিনে পরিস্থিতি বুঝে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলেন না? বিজেপি শাসনে উত্তরপ্রদেশে আইনশৃঙখলার প্রবল উন্নতি হয়েছে বলে অবিরাম ঢাক পেটানো চলে। মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের কঠোর নজরদারিতে সে রাজ্যে দুষ্কতীদের নাকি পার পাওয়ার উপায় নেই! শাসক দলের নির্দেশে উত্তরপ্রদেশ পুলিশ-প্রশাসন আইনের বিচার বা অভিযুক্তের বক্তব্যের তোয়াক্কা না করেই কী ভাবে স্রেফ বুলডোজার চালিয়ে দুষ্কৃতীদের শাস্তি দিয়ে থাকে, তা-ও সকলের জানা। আইনশৃঙ্খলার এ হেন ‘স্বর্গরাজ্যে’ জনসমাবেশ সীমা ছাপিয়ে যাচ্ছে দেখেও পুলিশ-প্রশাসন তা আটকায়নি কেন? কেন সেদিন ঘটনাস্থলে যথেষ্ট সংখ্যায় পুলিশ পাঠানো হয়নি? এত বড় একটা সমাবেশ সত্ত্বেও কোনও মেডিকেল টিম তৈরি ছিল না কেন? জানা গেছে দুর্ঘটনার অনেক পরে প্রথম অ্যাম্বুলেন্সটি ঘটনাস্থলে আসে। তারও পরে আসে পুলিশ ও দমকলের লোকজন। কার্যত গ্রামবাসীরাই বহুক্ষণ পর্যন্ত মৃতদেহ ও আহতদের উদ্ধারের কাজ চালান।
হাথরসের এই মর্মান্তিক ঘটনা যে উত্তরপ্রদেশ পুলিশ-প্রশাসনের ব্যর্থতার এক জ্বলন্ত নজির এ কথা মানতে রাজি নন মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ ও তাঁর দোসররা। একটি সাংবাদিক সম্মেলনে ঘটনার বিচারবিভাগীয় তদন্তের কথা ঘোষণা করে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী এর পিছনে ষড়যন্ত্রের সন্দেহের কথা তোলার চেষ্টা করেছেন। এলাকাবাসীদের অনেকের অভিযোগ, দুর্ঘটনার দায় ঝেড়ে ফেলতেই আসলে বিজেপি সরকার ষড়যন্ত্রের গল্প সাজাতে চাইছে। তাঁদের একজন বিন্ধ্যেশ্বর সিং জানান, তদন্তের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও প্রশাসন ঘটনার দিনই গোটা দুর্ঘটনাস্থল পরিষ্কার করে ফেলার অনুমতি দেয়। পরদিন তদন্তকারী টিম ও গোয়েন্দা কুকুর যখন আসে, তার আগেই সমস্ত প্রমাণ লোপাট করে ফেলা হয়েছে। শুধু তাই নয়, দুর্ঘটনার পর পুলিশ যে অভিযোগ দায়ের করে, সেখানে উদ্যোক্তাদের কয়েকজনের নাম থাকলেও খোদ সুরজ পাল নামটিরই কোনও অস্তিত্ব নেই। ফলে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে এই ভুয়ো ধর্মগুরু ও তাঁর দলবলের সঙ্গে উত্তরপ্রদেশের বিজেপি সরকারের নেতা-মন্ত্রীদের যথেষ্ট ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। বাস্তবে কোনও ভোটবাজ রাজনৈতিক দলই এইসব ধর্মগুরুদের চটাতে চায় না, বরং তোয়াজ করে চলে। কারণ এদের পিছনে যে বিপুল ভক্তসমাবেশ, তা থেকে বিজেপি, কংগ্রেস সহ সমস্ত ভোটসর্বস্ব দলেরই নির্বাচনে ফয়দা তোলার মতলব থাকে। সেই কারণেই হাথরস দুর্ঘটনায় দুর্গতদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হলে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীকে সুরজ পাল সংক্রান্ত প্রশ্নগুলি সযত্নে এড়িয়ে যেতে দেখা যায়। একই ভাবে, কেন সুরজ পাল এখনও গ্রেফতার হননি, কিংবা কেন তাঁর নাম পুলিশের এফআইআর-এ নেই, সাংবাদিকদের এই সব প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে গেছেন উত্তরপ্রদেশেরই সমাজবাদী পার্টির নেতা অখিলেশ যাদবও। ওই একই কারণে এত বড় মাপের দুর্ঘটনা ও এতগুলি মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যুর পরেও বিজেপি শাসিত উত্তরপ্রদেশে এই সমাবেশের কেন্দ্রবিন্দু এই ভুয়ো ধর্মগুরুর নামেই কোনও অভিযোগ দায়ের হয় না! এতগুলি দিন পার হয়ে যাওয়ার পরেও যোগী আদিত্যনাথ সরকারের কুখ্যাত পুলিশ-প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে তিনি বহাল তবিয়তে গা-ঢাকা দিয়ে থেকে যেতে পারেন।
বুঝতে অসুবিধা হয় না, শাসক দল, পুলিশ ও প্রশাসনের সঙ্গে দহরম-মহরম না থাকলে সুরজ পালের মতো ভুয়ো ধর্মগুরুদের এমন রমরমা হতে পারে না। সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, স্বঘোষিত এই ধর্মগুরু প্রথম জীবনে উত্তরপ্রদেশ পুলিশের কনস্টেবল ছিলেন। ১৮ বছর আগে এটাওয়াতে এক মহিলাকে যৌন হেনস্থা করার অভিযোগে তাঁকে সাসপেন্ড করা হয়। এর পর তিনি ধর্মগুরু বনে যান। নিজে দলিত জাটভ সম্প্রদায়ের মানুষ হওয়ায় ক্রমে এই সম্প্রদায়েরই বিপুল সংখ্যক মানুষ তাঁর ভক্ত বনে যায়। উত্তরপ্রদেশে সমস্ত দিক থেকে পিছিয়ে পড়া এই জাটভরাই তফসিলি সম্প্রদায়গুলির মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ। ফলে ভোটের স্বার্থে উত্তরপ্রদেশে বিজেপির মতো ক্ষমতালোভী শাসক দল যে সুরজ পালকে আড়াল করার চেষ্টা করবে, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ থাকতে পারে কি?
শুধু সুরজ পাল নয়, এর আগে রামরহিম, আশারাম বাপুদের মতো ভুয়ো ধর্মগুরুদের নাম বার বার সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে। ধর্ষণ, খুন সহ নানা ঘটনায় ফাঁস হয়ে গেছে, অন্ধভক্ত গরিব মানুষ, ক্ষমতাপিপাসু রাজনীতিক ও কালোবাজারের কারবারিদের জোগানো টাকায় এইসব গুরুদের অসম্ভব বিলাসবহুল জীবনযাত্রা, জঘন্য লাম্পট্য ও বিপুল সম্পদের মালিকানার জোরে পুলিশ-প্রশাসনের নাকের ডগায় বসে অবাধে নানা অনৈতিক কার্যকলাপ চালিয়ে যাওয়ার কথা। তা সত্ত্বেও প্রতিদিনের জীবনযন্ত্রণায় জর্জরিত, শিক্ষা ও চিকিৎসার অধিকারবঞ্চিত দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সহজ-সরল মানুষ একটু শান্তি, একটু আশ্বাসের খোঁজে বার বার ছুটে যায় মতলববাজ এইসব প্রতারক ‘বাবা’দের কাছে। বার বার তাদের প্রতারণার শিকার হয়। আর হাথরসের এই ঘটনায় তো জীবনই চলে গেল ১২৬ জন নিরুপায় মানুষের, যে জীবনটাকেই একটু সুসহ করার আশায় তাঁরা ছুটে গিয়েছিলেন ‘ভোলেবাবা’র চরণধূলি সংগ্রহ করতে! কেউ গিয়েছিলেন বেকার ছেলের চাকরির আশায়, কেউ মদ্যপ স্বামীর অত্যাচার থেকে রেহাই পেতে, কেউ বা মেয়ের বিয়ে বা গরিবির অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজতে।
স্বাধীনতার ৭৫ বছর পার হয়ে গেলেও পুঁজিবাদী ভারত রাষ্ট্রের শাসক পুঁজিপতি শ্রেণি ও তাদের তল্পিবাহক বুর্জোয়া সরকারগুলি নিজেদের কায়েমি স্বার্থে কেউই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ লাচার মানুষকে ধর্মীয় কুসংস্কার আর অন্ধবিশ্বাসের জাল থেকে বের করে আনার চেষ্টা করেনি। বরং শোষণের মাত্রা বাড়িয়ে তুলতে জিইয়ে রাখতে চেয়েছে সাধারণ মানুষের চেতনাহীনতাকে। বিজেপি সরকারের শাসনে ধর্মীয় অন্ধতা ও কুসংস্কারের আরও রমরমা ঘটিয়ে সমাজকে গভীর অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেওয়ার প্রবল অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে। পাশাপাশি শাসক দলগুলিরই প্রশ্রয়ে ভেকধারী ধর্মগুরুদের বাড়বাড়ন্ত হয়ে চলেছে। প্রাণ দিয়ে এরই মাশুল দিতে হল দরিদ্র, অসহায় ১২৬ জন সাধারণ মানুষকে। এমন ভয়ঙ্কর ঘটনার পরে এই অন্ধকার গোলকধাঁধা থেকে বেরিয়ে আসার পথ কি জনসাধারণ খুঁজবে না!