হায়দরাবাদে তরুণী চিকিৎসকের নৃশংস ধর্ষণ ও হত্যার অপরাধীদের পুলিশি এনকাউন্টারে মৃত্যুর খবরে নির্যাতিতার বাড়ির লোকসহ দেশজুড়ে বিভিন্ন স্তরের বহু মানুষের বিশেষত মহিলাদের মধ্যে প্রাথমিকভাবে একটা স্বস্তি ও আনন্দের উচ্ছ্বাস দেখা গিয়েছিল৷ ক্রমাগত ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের ঘটনা বেড়ে যাওয়া, বছরের পর বছর তার বিচার না–পাওয়া, বহুক্ষেত্রে অপরাধীদের দোষ থেকে ছাড়া পেয়ে যাওয়ার ফলে যে হতাশা ও বিচারের প্রতি অনাস্থা মনের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে পুঞ্জীভূত হচ্ছিল, সেই ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল এই তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায়৷
কিন্তু বিচারের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় এই কাঙিক্ষত স্বস্তি ও আনন্দ মিলছে না কেন? অপরাধীর যথাযথ শাস্তি পাওয়া সমাজ অভ্যন্তরে অপরাধ মানসিকতায় কোনও রাশ টানতে পারে তখনই, যখন সঠিক বিচার প্রক্রিয়ায় দ্রুত রায় ঘোষণার মধ্য দিয়ে সেই শাস্তি আসে৷ দিল্লির ‘নির্ভয়া’ কাণ্ডের পর দেশজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় বয়ে গেলেও এবং দীর্ঘ সাত বছর পর রায় ঘোষণা হলেও, এখনও অপরাধীরা সাজা পেল না৷ উন্নাওয়ের নির্যাতিতা প্রভাবশালী বিজেপি বিধায়কের বিরুদ্ধে মামলা করার দাম দিয়ে চলেছে দু’বছরেরও বেশি সময় ধরে৷ দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকা মামলায় সাক্ষীর মৃত্যু, অভিযুক্তদের হুমকি, প্রভাবশালীদের মদত, প্রশাসনের প্রয়োজনীয় তৎপরতা ও সদিচ্ছার অভাবে মাঝপথেই তথ্য প্রমাণাদির অভাবে অভিযুক্ত খালাস পেয়ে যায়৷ হতাশা গ্রাস করে নারী সমাজকে৷
ব্যক্তি ও সমাজজীবনে অধিকারগুলি সুরক্ষিত রাখতে বিচার পক্রিয়ার গুরুত্ব অপরিসীম৷ ১৯৮৬ সালে সুপ্রিম কোর্ট দ্রুত বিচারকে নাগরিকদের একটা মৌলিক অধিকার বলে ঘোষণা করে৷ অথচ সারা দেশে ৪৩.২ লক্ষ মামলা হাইকোর্টগুলিতে এবং ২ কোটি ৬৯ লক্ষ মামলা জেলা কোর্টে বিচারাধীন হয়ে পড়ে আছে৷ দশ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিচারাধীন রয়েছে এমন মামলার সংখ্যা ২২ লক্ষ ৫৭ হাজার৷ কবে তার নিষ্পত্তি হবে কেউ জানে না৷ এই পাহাড়–প্রমাণ মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য সুপ্রিম কোর্ট পাঁচ বছরের জন্য দেশের প্রতিটি জেলায় পাঁচটি করে ‘ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট’ গঠন করার নির্দেশ দেয় কেন্দ্রীয় সরকারকে৷ কেন্দ্রীয় বিচারমন্ত্রক সারা দেশে ১৭৩৪টি অতিরিক্ত কোর্ট গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়৷ এর জন্য একাদশ অর্থ কমিশন ৫০২.৯ কোটি টাকা মঞ্জুর করে৷ মোট ১৫২৬টি ‘ফাস্ট–ট্র্যাক কোর্ট’ দু’দফায় ২০০১ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত কাজ করে৷ এর পর রাজ্য সরকারগুলিকে এগুলির জন্য অর্থবরাদ্দ করতে বলা হয়৷
কিন্তু মূল বিচার ব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিচারক না–থাকার ফলে বিচার আটকে থাকার সমস্যাটা থেকেই যায়৷ বর্তমানে সারা দেশে হাইকোর্টে বিচারপতির অনুমোদিত ১০৭৯টি পদের মধ্যে বিচারপতি আছেন ৬৬৯ জন৷ ৪১০টি পদ শূন্য হয়ে পড়ে আছে৷ একইভাবে নিম্নআদালতে ১২ ডিসেম্বর ২০১৮ সালে পার্লামেন্টে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী সারা দেশে অনুমোদিত ২২,৬৭১টি বিচারপতিপদের মধ্যে শূন্যপদের সংখ্যা ৫,১৩৫টি৷
হাইকোর্টের বিচারপতি নিয়োগের জন্য হাইকোর্ট কলেজিয়ামের পাঠানো তালিকা সুপ্রিম কোর্টের অনুমোদনের পর কেন্দ্রের আইনমন্ত্রকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে পাঠানো হয়৷ তারপর রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের পর নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হয়৷ কিন্তু পর্যাপ্ত সংখ্যক বিচারপতি নিয়োগে সরকারের সদিচ্ছার অভাব বিচারপ্রক্রিয়াকে ক্রমাগত দীর্ঘায়িত করছে৷
২০১৭ ও ২০১৮ সালে হাইকোর্টে বিচারপতি নিয়োগ হয়েছিল যথাক্রমে ১১৫ এবং ১০৮৷ ২০১৯ সালে নিয়োগ হয়েছে মাত্র ৬৫ জন৷ ক্রমশই বিচারপতির সংখ্যা কমছে৷ বছরখানেক আগে এক বিচারপতি তার রায় দিতে গিয়ে এজলাসে বসেই কেঁদে ফেলেছিলেন৷ বিচারপ্রক্রিয়া দীর্ঘসূত্রী হলে প্রকৃত ও ন্যায় বিচারকে আড়াল করা সুবিধাজনক হয়৷ প্রশাসনকে প্রভাবিত করে তথ্য গোপন করা, সময় মতো তথ্য জমা না দিয়ে বিচারপ্রক্রিয়াকে সঠিক লক্ষ্যে পৌঁছতে বাধা সৃষ্টি করা ইত্যাদি চলে এবং মূলত অর্থবান ও প্রভাবশালীরা তা করে থাকে৷ মানুষের সচেতন সংঘবদ্ধ প্রতিবাদ ছাড়া প্রশাসনকে তৎপর করা এবং বিচারপ্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করা সম্ভব নয়৷