হাঙ্গেরিতে চরম শ্রমিকস্বার্থবিরোধী এক আইন এনেছেন সেখানকার দক্ষিণপন্থী প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর ওরবান৷ এর বিরুদ্ধে দেশ জুড়ে বিক্ষোভের ঢেউ উঠেছে৷ নতুন আইনটিতে শ্রমিক–কর্মচারীদের কাজের নির্দিষ্ট সময়ের বাইরে বছরে ২৫০ থেকে ৪০০ ঘন্টা বেশি খাটিয়ে নেওয়ার অধিকার দেওয়া হয়েছে মালিকদের৷ বলা হয়েছে, বাড়তি পরিশ্রমের জন্য পাওনা বাড়তি টাকা সঙ্গে সঙ্গে মিটিয়ে দেওয়ারও দরকার নেই৷ তার জন্য মালিকরা তিন বছর পর্যন্ত সময় পাবেন৷ খুব স্বাভাবিক কারণেই এই কালা আইনের বিরুদ্ধে দেশের সাধারণ মানুষের ক্ষোভ তুঙ্গে উঠেছে৷ তারা আইনটির নাম দিয়েছে ‘স্লেভ ল’ অর্থাৎ ‘দাসত্বের আইন’৷
আইনটি পাশ হওয়ার আগে থেকেই এর বিরুদ্ধে পার্লামেন্টের সামনে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন শ্রমিকরা, চলতি মজুরির হার বৃদ্ধির দাবিও উঠেছিল সেখানে৷ বিক্ষোভের তীব্রতা ক্রমেই বাড়ছিল৷ ইতিমধ্যে এই আইন পাশ হয়ে যাওয়ায় ক্ষোভ চরমে ওঠে৷ গত ১৬ ডিসেম্বর রাজধানী বুদাপেস্টে ১৫ হাজারেরও বেশি শ্রমিক ও সাধারণ মানুষ প্রবল ঠাণ্ডা উপেক্ষা করে মিছিল করে টেলিভিশন সম্প্রচারের সদর দপ্তরের সামনে গিয়ে প্রবল বিক্ষোভ দেখান৷ দাবি তোলেন সরকারের বিরুদ্ধে তাঁদের বক্তব্য টেলিভিশনে প্রচার করতে হবে, জুলুমকারী সরকারের লেজুড় হয়ে না থেকে সম্প্রচার দপ্তরকে নিরপেক্ষ ভাবে কাজ করতে হবে৷ স্লোগান ওঠে ‘ওরবান, গদি ছাড়ো’৷ বিক্ষোভকারীদের উপর পুলিশ নির্বিচারে কাঁদানে গ্যাস চালায়৷ বোঝাই যায় বিক্ষোভের তীব্রতায় ওরবান সরকার যথেষ্ট ভীত৷ বিশেষ করে ফ্রান্সের সাম্প্রতিক ইয়েলো ভেস্ট আন্দোলন শাসকদের হাড়ে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছে৷
দেশের মানুষের এত বিরোধিতা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী ওরবান এই দাসত্ব আইনটি পাশ করাতে পারলেন কী করে? এটা সম্ভব হল শুধুমাত্র পার্লামেন্টে তাঁদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে৷ হাঙ্গেরিতে বর্তমান দক্ষিণপন্থী শাসক দলগুলির জোট ২০০৬ সাল থেকে একসঙ্গে নির্বাচনে লড়ছে৷ ২০১০ সালে প্রথম তারা সংসদের দুই–তৃতীয়াংশ আসন দখল করে জয়লাভ করে৷ পরের নির্বাচনগুলিতে নানা কারচুপি করে এবং সুবিধামতো নিয়ম–কানুন পাল্টে জয় ধরে রাখে তারা৷ এখনও ওরবানের নেতৃত্বে এই দক্ষিণপন্থী জোটের হাতেই রয়েছে সংসদের দুই–তৃতীয়াংশ আসন৷
ক্ষমতায় বসার পর থেকেই ওরবান তাঁর দক্ষিণপন্থী সহযোগীদের সঙ্গে নিয়ে দেশের ধনকুবের একচেটিয়া পুঁজিপতিদের মদতে তাদের স্বার্থে একের পর এক জনবিরোধী পদক্ষেপ নিয়ে চলেছেন৷ দেদার টাকা ঢেলে বিরোধী প্রচারমাধ্যমগুলিকে কিনে নিয়েছেন তাঁরা, নয়তো ভয় দেখিয়ে মুখ বন্ধ করে রাখা হয়েছে৷ নিয়ন্ত্রণ নিরঙ্কুশ করতে সমস্ত রাজনৈতিক ও বিচারবিভাগীয় উচ্চ পদগুলিতে বসানো হয়েছে ধনকুবেরদের অথবা সরকারের অনুগত লোকদের৷ ভূমিসংস্কার থেকে শুরু করে ব্যাঙ্কিং সংস্কারের নামে সমস্ত ক্ষেত্রেই নতুন নিয়মকানুন চালু করেছে সরকার৷ নিজেদের পছন্দের লোকজনকে নিয়ে ওরবান তৈরি করেছেন একটি কাউন্সিল যেটি সরকারের মুখপাত্র হিসাবে কাজ করে এবং যাদের কোথাও জবাবদিহি করার দায় নেই৷ ওরবান চরম প্রতিক্রিয়াশীল একটি সংবিধানও প্রণয়ন করেছেন এবং নতুন আইন কানুন চালু করে গোটা দেশের ওপর নিজের কর্তৃত্ব কায়েম করেছেন৷ এই অবস্থায় দেশের মানুষের ক্ষোভের আগুনে নতুন করে জ্বালানির জোগান দিয়েছে এই স্লেভ ল৷
আইনটি পাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শুধু রাজপথে নয়, সংসদের ভিতরেও প্রতিবাদ উঠেছে৷ সাইরেন ও হুইসল বাজিয়ে প্রতিবাদ জানান বিরোধীরা৷ হাঙ্গেরি আগে ছিল সমাজতান্ত্রিক দেশ৷ ব্যক্তিস্বাধীনতা ও গণতন্ত্র নেই– এই অপপ্রচারে বিভ্রান্ত মানুষ প্রতিক্রিয়াশীলদের ফাঁদে পা দিয়ে ’৯০–এর দশকে সমাজতন্ত্র উচ্ছেদ করেন৷ পুঁজিবাদী নতুন হাঙ্গেরি কী বিপুল স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক অধিকার তাঁদের জন্য নিয়ে এসেছে, দেশের মানুষ এখন তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে৷
শাসকের চেনা ঢঙে স্লেভ ল–এর বিরুদ্ধে জনবিক্ষোভকে এক ফুঁয়ে উড়িয়ে দিয়েছেন ওরবান৷ বলেছেন, এ সবই নাকি বিরোধীদের ষড়যন্ত্র৷ একটি টেলিভিশন চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে হাঙ্গেরি সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, স্লেভ ল নাকি তৈরি হয়েছে শ্রমিক–কর্মচারীদের্ স্বার্থ রক্ষা করতেই৷ এভাবেই মিথ্যা প্রচার করে এবং দরিদ্র পরিবারগুলিকে দেওয়া ভরতুকি বন্ধের ভয় দেখিয়ে, কিংবা দেশের অর্থনীতিতে ধস নামার আতঙ্ক ছড়িয়ে বিক্ষোভ দমন করতেই অভ্যস্ত ওরবান সরকার৷ কিন্তু এবারের বিক্ষোভের তীব্রতা অনেক বেশি৷
বুদাপেস্টের পাশাপাশি ১৬ ডিসেম্বর দেশের অন্য শহরগুলিতেও পথে নেমেছিলেন হাঙ্গেরির সাধারণ মানুষ৷ শ্রমিক–কর্মচারীদের সাথে যোগ দিয়েছিলেন ছাত্রছাত্রীরাও৷ স্লেভ ল প্রত্যাহার করা না হলে আগামী দিনে ধর্মঘট ডাকার হুঁশিয়ারি দিয়েছে হাঙ্গেরির ট্রেড ইউনিয়নগুলি৷ এই আন্দোলনকে সফল করার জন্য হাঙ্গেরিতে এখন দরকার শ্রমিক শ্রেণির একটি যথার্থ নেতৃত্বের, যারা শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থরক্ষার বিষয়টি নিয়ে কোনও আপস করবে না৷