স্যার, স্কুল খুলবে না? (পাঠকের মতামত)

বারাসাত, উত্তর ২৪ পরগণা

স্বাধীনতা দিবসের আগের দিন আমার এক ছাত্রী বলেছিল,কালকে আমিও যাবো স্কুলে। ১৫ আগস্ট সকাল ৮টায় স্কুলে রওনা হবার আগে ভাবছিলাম নিয়ে যাবো কিনা। কিন্তু শিক্ষা দপ্তরের নির্দেশ পড়ুয়াদের স্কুলে যাওয়া যাবে না।

আমাদের স্কুলের এক ছাত্রীর বাড়ি আমার বাড়ির পাশেই। আগে সে একটি বেসরকারি বিদ্যালয়ে পড়ত। তারপর আমাদের স্কুলে ২০২০তে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হয়। মাস দুয়েক স্কুল যাওয়ার পর লকডাউন। এখন সে চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী। আমাদের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলি যে বন্ধ এ কথা বলা যাবে না। বলা ভালো পঠনপাঠন বন্ধ। প্রতি মাসে দু-তিন দিন ধরে মিড ডে মিলের খাদ্যসামগ্রী বাবদ চাল-ডাল-আলু দিতে হয়। অভিভাবকরা এসে নিয়ে যান। পড়ুয়াদের আসা নিষেধ।

আমার বাড়ির পাশের ছাত্রীটি প্রতি মাসেই বায়না ধরে। বায়না ধরে ওকেও যেন একটা দিন স্কুলে নিয়ে যাই। আমি নির্মম হয়ে বলি, না, নিয়ে যাওয়া যাবে না। একদিন ওর কথা শুনে নিজেই আঁতকে উঠি। ‘ও জী, আমাকেও স্কুলে নিয়ে যা না। আমার স্কুলের বন্ধুদের অনেকদিন দেখিনি।’

আমাকে ‘জী ‘বলেই ডাকে ছাত্রীটি। আমি ওর কথা শুনে একটা কষ্টমাখা হাসি ছাড়া আর কিছুই দিতে পারিনি। বিগত প্রায় ১৮ মাস ধরে রাজ্যের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ। মাঝে শুধু অল্প কিছুদিন নবম-দ্বাদশের ক্লাস হয়েছে। কেমন আছে শিক্ষাব্যবস্থার প্রাণ পড়ুয়ারা? একদম ভালো নেই। কেউ ভালো নেই। ছোট্ট ছোট্ট মনগুলোর ভেতরে বাসা বেধেছে অবসাদ। পড়াশোনা থেকে পুরো বিচ্ছিন্ন। হ্যাঁ, কিছু বেসরকারি বিদ্যালয়ে অনলাইনে পড়াশোনা চলছে। কিন্তু সেটাও তো ক্লাসরুম শিক্ষার বিকল্প হতে পারে না। সাময়িক জরুরি পরিষেবা হতে পারে। কিন্তু গ্রামাঞ্চলের সরকারি বিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের যে ক্ষতি হয়েছে তা অপূরণীয়।

একটা বড় অংশের পড়ুয়াদের পড়াশোনা সম্পূর্ণ বিদ্যালয়কেন্দ্রিক। বাড়িতে পড়িয়ে দেওয়ার মতো কেউ থাকে না। থাকলেও সংসার চালাতে সন্তানকে নিয়ে সকাল সন্ধ্যা বসা হয় না। পড়িয়ে দেওয়া হয় না।

কিছু সংখ্যক পড়ুয়া গৃহ শিক্ষকের কাছে শিখছে। কিন্তু স্কুল নেই, পড়া নেই, বাড়ির কাজ নেই, পরীক্ষা নেই। পড়ার আগ্রহটাই হারিয়ে ফেলছে এই গৃহশিক্ষকদের কাছে পড়া পড়ুয়ারাও।

ছাত্রছাত্রীদের বাবা মা হাটে বাজারে ঘুরছে। মিটিং মিছিল জনজোয়ারে ভাসছে। স্কুল বন্ধ রাখলেই আমাদের ছাত্রছাত্রীরা নিরাপদ এই কথাটা ঠান্ডা ঘরেকোন বিশেষজ্ঞ ভাবলেন?

অভিভাবকদের সঙ্গে আমার কথা হয়। এমন একজনওনেই যিনি চান না স্কুল খুলুক। ছাত্রছাত্রীরা চায় স্কুল খুলুক। শুধু সরকার চায় না।

অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থাকে বিকল্প ব্যবস্থা হিসাবে তুলে ধরার একটা প্রাণপণচেষ্টা চালানো হচ্ছে । যাতে ক্লাসরুম শিক্ষা ব্যবস্থাটাকেই তুলে দিয়ে শিক্ষার দায় ঝেড়ে স্যানিটাইজারে হাত ধুয়ে ফেলতে পারে শাসক শ্রেণি। তাই যত দেরি করা যায় স্কুল খুলতে।

আইসিএমআর, এইমস, ইউনিস্কো, ইউনিসেফের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো করোনাবিধি মেনে স্কুল খোলার কথা বলেছে। ভারতের কয়েকটি রাজ্য স্কুল খোলার প্রক্রিয়াও শুরু করেছে। কিন্ত়ু পশ্চিমবঙ্গে? মুখ্যমন্ত্রীর কথায়– পুজোর পর ভাববেন। মানুষ মুখ খুলছে। অভিভাবকরা হাটে বাজারে, চায়ের দোকানের আলোচনায় স্কুল খোলার কথা বলছে। ছাত্রছাত্রীরা আন্দোলন করছে। একটি ছাত্র সংগঠন স্কুল খোলার দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে গ্রেফতার হয়ে কারাবরণও করেছে। শিক্ষকদের সংগঠনও আন্দোলন করছে ।

আমার এক ছাত্রের দেখা রাস্তায়। সে জানতে চাইলো, ও স্যার স্কুল খুলবে না?

বললাম, জানা নেই রে।

সে বলল, ‘দুয়ারে সরকার’ যে হচ্ছে! ওখানে করোনা নাই ? এ প্রশ্নের উত্তর কে দেবে? পানশালা খোলা, পাঠশালা বন্ধ। দ্রুত খুলুক পাঠশালা।

আব্দুল জলিল সরকার, শিক্ষক

হলদিবাড়ি, কোচবিহার

গণদাবী ৭৪ বর্ষ ৫ সংখ্যা (২৭ আগস্ট ২০২১)