বৃহৎ অর্থনীতির দেশ দক্ষিণ কোরিয়া। বিশ্বে ইলেকট্রনিক্সের জগতে শীর্ষে থাকা কোম্পানি স্যামসাং-এর বিশেষ অবদান রয়েছে সে দেশের অর্থনীতির সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে, এমনটাই দাবি করে থাকেন অনেকে। ভারতেও ইলেকট্রনিক্স জগতে প্রায় এক নম্বর স্থানে রয়েছে স্যামসাং।
সেই কোম্পানির শ্রমিকরা আজ ধর্মঘটের পথে। ৭ জুন সিওলে স্যামসাংয়ের সদর দপ্তরের সামনে কর্মীরা প্রতিবাদস্বরূপ কালো গেঞ্জি পরে বিক্ষোভ দেখান (ছবি)। ‘শ্রমিক শোষণ মানব না’ ব্যানার নিয়ে উপযুক্ত বেতন ও কাজের নিরাপত্তার দাবি জানিয়ে ধর্মঘট পালন করেন তাঁরা। বোনাস কেটে নেওয়ারও প্রতিবাদ করেন (নিউ ইয়র্ক টাইমস- ৭ জুন, ২০২৪)।
ইলেক্ট্রনিক্স নানা জিনিসের মেমরি চিপ, সেমিকন্ডাকটর সিস্টেম ইত্যাদিতে স্যামসাং দীর্ঘদিন রয়েছে শীর্ষে। বর্তমানে এই কোম্পানির সাথে প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানির মধ্যে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স-এর জন্য আধুনিক মেমরি চিপের উৎপাদন বাড়ানোকে কেন্দ্র করে প্রতিযোগিতা চলছে। দক্ষিণ কোরিয়ার আর একটি সংস্থা এস কে হাইনিক্স আধুনিক প্রজন্মের মধ্যে আকর্ষণ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে উচ্চপ্রযুক্তির মেমরি চিপ তৈরিতে স্যামসাং-এর সাথে পাল্লা দেওয়ার় চেষ্টা করছে।
আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ব্যবহার বহু ক্ষেত্রে চালু হওয়ায় স্যামসাং বাজার ধরতে উচ্চমানের মেমারি চিপের উৎপাদন বাড়াতে তৎপর হয়েছে। তাতে কর্মীদের উপর চাপানো হয়েছে কাজের বোঝা। ইলেকট্রনিক্স দুনিয়ার একচ্ছত্র দখলদারি রাখতে স্যামসাং কর্তৃপক্ষ বেশ কিছুদিন থেকে কর্মীদের বোনাস বন্ধ করে দিয়েছে। কর্মীদের বঞ্চিত করেই মুনাফা বাড়াচ্ছে কোম্পানি। এ বছরের প্রথম ত্রৈমাসিকে শুধু চিপ উৎপাদনেই ১.৪ বিলিয়ন ডলার মুনাফা করেছে তারা। তা সত্তে্বও এক দশকের বেশি সময়ের মধ্যে গত বছরে কোম্পানি সবচেয়ে কম লাভ করেছে এই অজুহাতে কর্মীদের বেতন ছাঁটাই করছে। যদিও কোম্পানির আয় ও মার্কেট শেয়ারের তথ্য বলছে, এখনও স্যামসাং বিশ্বের সর্ববৃহৎ মেমরি চিপ প্রস্তুতকারক সংস্থা। জানিয়েছে রিসার্চ সংস্থা ‘ট্রেন্ডফোর্স’।
সর্বোচ্চ মুনাফার উদ্দেশ্যে পরিচালিত এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় কোনও কোম্পানির লাভ বা ক্ষতির উপর কর্মচারীদের বেতন, বোনাস বা কাজের নিরাপত্তা নির্ভর করে না। কোম্পানির ক্ষতি হলে তো বটেই, লাভ হলেও আরও লাভের উদ্দেশ্যে শ্রমিকের উপর আক্রমণের খড়গ নামিয়ে আনে মালিক, নির্বিচারে ছাঁটাই করতেও দ্বিধা করে না।
ভারতেও বিভিন্ন কলে-কারখানায় কিংবা কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদনের ক্ষেত্রে দেখা যায়– বেশি উৎপাদন হলেও কারখানায় শ্রমিক ছাঁটাই হয়, চাষি ফসলের দাম পায় না, খেতমজুরের কাজ চলে যায়। কম উৎপাদন হলে তো কথাই নেই, এক ধাক্কায় শ্রমিক-কৃষকের জীবনে অন্ধকার নেমে আসে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার আভ্যন্তরীণ সংকট যত তীব্র হয়, তত বাজার সংকুচিত হয়। এই ব্যবস্থায় মালিক শ্রেণি শ্রমিকের শ্রমকে নিংড়ে নিয়ে তাদের ন্যায্য প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করে আকাশচুম্বী মুনাফা করে। বাজার সংকটের কারণে শোষণ-বঞ্চনা যত বাড়ে, কৃষিজীবী মানুষ ও মজুরের ক্রয়ক্ষমতা কমে। কলে-কারখানায় হোক, কিংবা খেত-খামারে উৎপাদিত দ্রব্য প্রয়োজন থাকলেও সাধারণ মানুষ কিনতে পারে না। ফলে উৎপাদিত দ্রব্য গুদামজাত হয়। বাজার নেই এই অজুহাতে মজুর ছাঁটাই করে মালিকরা। সে ঘটনাই ঘটে চলেছে বিশ্বজুড়ে দেশে দেশে।
শুধু স্যামসাং-এর কর্মীরাই নয়, গত বছরের শেষে দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রেসিডেন্টের শ্রমিক বিরোধী শ্রম-নীতির বিরুদ্ধে হাজার হাজার নির্মাণ শ্রমিক বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিলেন। স্যামসাং কর্মীরাও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন– কর্তৃপক্ষ দাবি না মানলে এবং সরকার তাদের সমস্যাগুলির সমাধানে এগিয়ে না এলে লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে যাবেন।
বিশ্বের শ্রমিকশ্রেণির অংশ হিসাবে সেখানকার শ্রমিকদের বুঝতে হবে, বেতন বা বোনাসের আশু দাবি নিয়ে শুধু নয়, জীবনের সামগ্রিক সংকট থেকে মুক্তি পেতে হলে বর্তমানের এই ঘুণধরা পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটা– যা সাধারণ মানুষের অগ্রগতির পথে বাধা, তাকে উচ্ছেদ করতে হবে। সেই কাজে অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে শ্রমিকদেরই। না হলে সাময়িক কিছু দাবি আদায় হলেও শ্রমিক-জীবনের সংকট-মুক্তি অধরাই থেকে যাবে।