স্মার্ট মিটার প্রত্যাহারঃ জনমতের কাছে মাথা নত করতে বাধ্য হল সরকার

লাগাতার আন্দোলনের চাপে অবশেষে রাজ্য সরকার স্মার্ট প্রি-পেইড মিটার বন্ধ করার নির্দেশ দিতে বাধ্য হল। দীর্ঘ প্রায় চার বছর ধরে লাগাতার স্মার্ট মিটার বিরোধী বিদ্যুৎ গ্রাহক আন্দোলন এই বিরাট জয় ছিনিয়ে নিতে পারল। এ জয় গণআন্দোলনের জয়। কী ছিল সরকারের উদ্দেশ্য? কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যগুলোর বিদ্যুৎ বন্টন ব্যবস্থাকে গোয়েঙ্কা, টাটা, আদানি, জিন্দাল, আম্বানিদের হাতে তুলে দেওয়ার উদ্দেশ্যে চূড়ান্ত গ্রাহক স্বার্থবিরোধী, প্রি-পেইড স্মার্ট মিটার লাগানোর পরিকল্পনা এনেছে। রাজ্য সরকার বিজেপির বিরুদ্ধে যতই প্রচার করুক না কেন, তারা বিদ্যুৎ ব্যবসায়ী ধনকুবেরদের স্বার্থে কেন্দ্রের এই পরিকল্পনা স্মার্ট মিটার লাগানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ২০২১ সালের ৯ জুলাই নবান্নে উচ্চ পর্যায়ের মিটিং করে। শুরুতে বলা হয়েছিল সরকারি দপ্তরের বিশাল অঙ্কের বকেয়ার হাত থেকে বিদ্যুৎ বন্টন কোম্পানিকে বাঁচাতে প্রি-পেইড স্মার্ট মিটার লাগানো হবে। আসলে এটা ছিল একটা বাহানা। বাস্তবে সমস্ত স্তরের গ্রাহকদেরই স্মার্ট মিটার লাগাতে বাধ্য করাই ছিল সরকারের লক্ষ্য।

এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) শুরু থেকেই স্মার্ট মিটারের বিরোধিতা করে গ্রাহকদের মধ্যে প্রচার চালিয়েছে এবং সর্বত্র গ্রাহক কমিটি গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে গ্রাহকদের সংগঠিত করে প্রশাসনিক দফতরগুলিতে বিক্ষোভ সংগঠিত হয়েছে। বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি সহ নানা সমস্যা নিয়ে দলের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দলের প্রতি যে আস্থা জনমনে তৈরি হয়েছে, তা থেকেই দলের ডাকে সব স্তরের গ্রাহক প্রতিবাদে মুখর হয়েছেন।

পশ্চিমবঙ্গে দলমত নির্বিশেষে বিদ্যুৎ গ্রাহকদের একমাত্র সংগঠন অল বেঙ্গল ইলেকট্রিসিটি কনজিউমার্স অ্যাসোসিয়েশন (অ্যাবেকা) স্মার্ট মিটারের কুফল তুলে ধরে চার বছর একটানা জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা চালিয়ে গেছে। স্বাক্ষর সংগ্রহ, গ্রাহক বৈঠক, সভা, বিদ্যুতের অফিসে ডেপুটেশনের লাগাতার কর্মসূচি পালন করেছে তারা। ‘আমার প্রেমিসেসে স্মার্ট মিটার লাগাতে চাই না’– এই মর্মে লক্ষ লক্ষ আবেদনপত্র রাজ্যের বিভিন্ন কাস্টমার কেয়ার সেন্টারে জমা দেওয়ার জন্য গ্রাহকদের সংগঠিত করেছে অ্যাবেকা। গ্রামে-গঞ্জে, শহর়ে ‘স্মার্ট মিটার প্রতিরোধ কমিটি’ গড়ে বহু জায়গায় স্মার্ট মিটার রুখে দেওয়া হয়েছে। লাইন কেটে দেওয়ার হুমকি, পুলিশের ভয় দেখানো, সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার ফল ভাল হবে না– এ রকম বহু আক্রমণ অসংখ্য গ্রাহক মোকাবিলা করেছেন। অ্যাবেকা তাদের পাশে থেকেছে সর্বদা। এখনও বেশ কিছু মিথ্যা মামলা চালাচ্ছে পুলিশ। এর মধ্যেও অনেক গ্রাহকের কাছে ‘পরে বেশি পয়সা দিয়ে লাগাতে হবে’– বলে ভয় দেখিয়ে স্মার্ট মিটার লাগিয়ে ১০০/২০০ টাকা অন্যায়ভাবে আদায় করেছে কোম্পানির নিযুক্ত এজেন্সির লোকেরা। কোথাও বা ঘরের বাইরে থাকা মিটার ঘরে কাউকে না জানিয়ে চালু মিটার খুলে স্মার্ট মিটার লাগিয়ে দিয়েছে। যে সমস্ত গ্রাহকের বাড়িতে এইভাবে স্মার্ট মিটার লাগানো হয়েছে স্বাভাবিকভাবেই বাড়তি বিলের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ, অবরোধে ফেটে পড়েছেন তাঁরা। হাজার হাজার গ্রাহক বিদ্যুৎ দপ্তরে সমবেত হয়ে লিখিত ভাবে দাবি জানিয়েছেন, ‘বেআইনি ভাবে লাগানো স্মার্ট মিটার খুলে নাও’। ফলে সরকার গ্রাহক বিক্ষোভ টের পাচ্ছিল।

এই উন্নত প্রযুক্তির স্মার্ট মিটার দূরের থেকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। পোস্ট পেইড, প্রিপেইড, ডাইনামিক প্রাইসিং, টিওডি, রিয়েল টাইম মনিটরিং– এই সব সিস্টেম বাইরে থেকেই প্রোগ্রামিং করা যায়, কৃত্রিম মেধার নিয়ন্ত্রণে। গ্রাহক আন্দোলনের চাপে রাজ্যের বিদ্যুৎমন্ত্রী এখন বলছেন, লাগিয়ে দেওয়া স্মার্ট মিটারগুলোকে পোস্ট পেইড মোডে কাজ করবে কিন্তু বেআইনি ভাবে লাগানো মিটারগুলো খুলে নেওয়ার বিষয়ে কিছু বলেননি। ফলে যাদের বাড়িতে স্মার্ট মিটার লাগানো হয়েছে সে ক্ষেত্রে আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে তাদের বিলের বোঝা নিয়ে। দ্বিতীয়ত, স্মার্ট মিটারের আয়ুষ্কাল ৫-৭ বছর। ফলে প্রতি ৫-৭ বছর পর পর অনেক দামি এই স্মার্ট মিটার কেনার বোঝা গ্রাহকের ঘাড়েই চাপবে।

স্মার্ট মিটার লাগানোর প্রকল্প, কেন্দ্রীয় সরকার এনেছে রিভ্যাম্পড ডিস্ট্রিবিউশন সেক্টর স্কিম (RDSS) অনুযায়ী। এই স্কিমের আসল উদ্দেশ্য সমস্ত বিদ্যুৎ বন্টন কোম্পানির বেসরকারিকরণ বিদ্যুৎকে পরিষেবার চোখে না দেখে দেশি-বিদেশি মালিকদের বিপুল মুনাফার ক্ষেত্রে পরিণত করতে চাইছে কেন্দ্রীয় সরকার। এর বিরুদ্ধে সারা দেশেই গড়ে উঠছে বিদ্যুৎ গ্রাহক আন্দোলন। বহু রাজ্যে ইতিমধ্যে বিদ্যুৎগ্রাহক সমিতি গড়ে উঠছে। গড়ে উঠেছে সর্বভারতীয় বিদ্যুৎ গ্রাহক সংগঠন এআইইসিএ। অল ইন্ডিয়া ইলেকট্রিসিটি কনজিউমার্স অ্যাসোসিয়েশন (এআইইসিএ) ডাক দিয়েছে বিদ্যুতের বেসরকারিকরণ ও স্মার্ট মিটার বাতিলের দাবিতে সারা দেশব্যাপী স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযানের। এ রাজ্যেও সেই স্বাক্ষর সংগ্রহ চলবে যাতে কেন্দ্রীয় সরকার স্মার্ট মিটার বাতিল করতে বাধ্য হয়। স্মার্ট মিটার বাতিল হলেও রাজ্যের বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে বর্ধিত ফিক্সড চার্জ, মিনিমাম চার্জ, সিইএসসি-র এফপিপিএএস প্রত্যাহারের দাবিতে গ্রাহকদের আন্দোলন চলবে বলে জানান অ্যাবেকার নেতৃত্ব। তাঁরা আন্দোলনের জয়ে অভিনন্দন জানিয়েছেন গ্রাহকদের।

এই আন্দোলন দেখিয়ে দিল, ন্যায্য দাবিতে আন্দোলন যদি সঠিক নেতৃত্বে সংগঠিত হয় তবে জয় অনিবার্য। এই আন্দোলন থেকে শিক্ষা নিয়ে জনজীবনের অন্যান্য জ্বলন্ত সমস্যাগুলি নিয়ে আপসহীন লড়াই গড়ে তুলে বাধ্য করতে হবে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারকে দাবি মানার জন্য। সে ক্ষেত্রেও গ্রাহক কমিটির মতোই সর্বত্র অসংখ্য গণকমিটি গড়ে তুলে জনগণকে সংগঠিত হতে হবে।

এই লেখাটি গণদাবী ৭৭ বর্ষ ৪৫ সংখ্যা  ২০ – ২৬ জুন ২০২৫ এ প্রকাশিত