স্মার্টফোনে আসক্তিঃ প্রযুক্তি নয়, অপরাধী এই মুনাফাসর্বস্ব ব্যবস্থা

স্কুলে স্মার্টফোন কেড়ে নেওয়ায় ক্ষিপ্ত ছাত্রদের আক্রমণে অশিক্ষক কর্মীর মৃত্যু, রক্ত বিক্রি করে স্মার্টফোন কেনার চেষ্টা, ফোন না পেয়ে আত্মহত্যা, এমনকি দুধের সন্তানকে বিক্রি করে ফোন কেনার টাকা জোগাড়ের মতো ঘটনা এখন খবরে আসছে। এর সাথে আছে চলন্ত ট্রেনের সাথে সেলফি তুলতে গিয়ে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ঘটনাও।

শিউরে ওঠার মতো এসব ঘটনাকে আজ আর ‘বিরলতম’ বলা যাচ্ছে না। বরং শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে স্মার্টফোন নামক হাতের মুঠোয় থাকা যন্ত্রটির প্রতি আসক্তি যে ক্রমশ বিপজ্জনক হয়ে উঠছে কমবেশি সকলেই তা জানেন। এবং আজ তা অল্প কিছু পরিবারে বা সমাজের কোনও নির্দিষ্ট স্তরের মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। বাড়ি, স্কুল-কলেজ, কর্মক্ষেত্র, রাস্তাঘাট সর্বত্র চোখ মেলে তাকালেই দেখা যাবে এই আসক্তির ভয়ঙ্কর রূপ, যা ড্রাগ-মদের নেশার চেয়ে কোনও অংশে কম ভয়ানক নয়। ভালো করে বসতে পর্যন্ত শেখেনি, এমন শিশুকে শান্ত রাখতে মা-বাবা ধরিয়ে দিচ্ছেন স্মার্টফোন। এক থেকে ছয়-সাত বছরের বাচ্চাদের একটা বড় অংশ খাওয়ার সময় ফোনের পর্দায় চোখ রেখে খেতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে এবং পরে স্বভাবতই ফোন না দিলে তাদের খাওয়ানো যাচ্ছে না। জেদ, চিৎকার, জিনিস ছুঁড়ে ফেলা থেকে শুরু করে তৈরি হচ্ছে নানা ধরনের মানসিক অসুখ, ছুটতে হচ্ছে মনোচিকিৎসকের দরজায়।

এই মুহূর্তে ঠিক কতটা ভয়ানক আকার ধারণ করেছে এই স্মার্টফোনের নেশা, তার আন্দাজ পাওয়া যাবে অ্যানুয়াল স্ট্যাটাস অফ এডুকেশন রিপোর্টে উঠে আসা সাম্প্রতিক তথ্য থেকে। দেশের ২৬টি রাজ্যের ২৮টি জেলায় চালানো সমীক্ষায় দেখা গেছে, দেশের ৯০.৫ শতাংশ কিশোর এবং ৮৭.৮ শতাংশ কিশোরী স্মার্টফোন ও সামাজিক মাধ্যমে সক্রিয়। এই বয়সিদের ৯০ শতাংশের বাড়িতে স্মার্টফোন আছে, তার মধ্যে ৪৩.৭ শতাংশ কিশোর ও ১৯.৭ শতাংশ কিশোরীর আছে নিজস্ব ফোন। দৈনন্দিন জীবনে এবং পড়াশুনার ক্ষেত্রেও কিছু কিছু কাজের জন্য এখন স্মার্টফোন অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। এই কিশোররা কি সেই কাজের জন্যই ফোনের দ্বারস্থ হচ্ছে? সমীক্ষা বলছে, না। এদের মাত্র ২৫ শতাংশ অনলাইনে জিনিস কেনা বা ফর্ম ফিল আপের মতো কাজে স্মার্টফোন ব্যবহার করে, ৮০ শতাংশই ফোন নিয়ে সিনেমা দেখা, গান শোনা বা অন্যান্য বিনোদনের জন্য ফোনে সময় কাটাচ্ছে। বিগত পনেরো-কুড়ি বছরে প্রযুক্তির বিস্ফোরণ এবং সমাজ কাঠামোয়, পরিবারের সমাজের বাঁধুনিতে, মানবিক সম্পর্কে যে পরিবর্তন এসেছে তার প্রভাবে আজ ছোটদের টিভি কিংবা মোবাইল দেখার নিয়ন্ত্রণ উঠে গেছে বললেই হয়। সুতরাং কোন সিনেমা, কোন গান তাদের দেখা বা শোনা উচিত এ সবের কোনও বালাই ছাড়াই ঘণ্টার পর ঘণ্টা মুঠোফোনে ডুবে থাকছে নবীন প্রজন্ম। সাইবার সুরক্ষার নিয়মবিধি না জেনে যথেচ্ছ ইন্টারনেট ব্যবহারের ফলে নানা প্রতারণা, ভয়ঙ্কর বিপদের ফাঁদেও পড়ছে অনেকে।

২০২৩-এর অন্য একটি সমীক্ষা দেখাচ্ছে, যেসব কিশোর-কিশোরী দিনে এক ঘণ্টা স্মার্টফোন ব্যবহার করে, তাদের তুলনায় যারা দিনে ৫ ঘণ্টা বা তার বেশি স্মার্টফোন ব্যবহার করে, তাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা ৭১ শতাংশ বেশি। ১৮ থেকে ২৯ বছর বয়সিদের ২২ শতাংশ বলে, তারা কয়েক মিনিট পরপর ফোন না দেখে থাকতে পারে না। উঠে এসেছে অভিভাবকদের নিজেদের আসক্তির বিষয়টিও। ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যের ৪৬ শতাংশ কিশোর-কিশোরী মনে করে, তারা স্মার্টফোনে আসক্ত এবং ৭১ শতাংশ মা-বাবা সন্তানের ডিজিটাল আসক্তির জন্য নিজেদের দায়ী মনে করছেন। নবীন প্রজন্মের একটা বড় অংশ বন্ধুদের সাথে গল্প করা, কারও সাথে দেখা করে সময় কাটানোর চেয়ে বেশি সময় কাটায় ফোনের পর্দায় বিভিন্ন ডিজিটাল মাধ্যমে চোখ রেখে, এখন যাকে বলা হয় ‘স্ক্রিন টাইম’। বিজ্ঞানসম্মত পরীক্ষা-নিরীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, এই স্ক্রিন টাইম যত বাড়ছে, তত বাড়ছে দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়া, স্থূলতা, হজমের সমস্যা, মাথা যন্ত্রণা সহ নানা রোগ, অস্বাস্থ্যকর ফাস্ট ফুড খাওয়ার প্রবণতা এবং অবশ্যই মানসিক জটিলতা, অবসাদ, একাকীত্ব। ফেসবুক-ইউটিউব-টুইটার-ইন্সটাগ্রাম সহ নানা মাধ্যম চব্বিশ ঘণ্টা যে সমান্তরাল দুনিয়া তৈরি করে রাখছে, খুব সহজেই সেখানে ডুবে যাচ্ছে তরুণ মন। এই অভ্যাস ক্রমশ তার সামাজিক মনন, দিন-দুনিয়ার খবর রাখার ইচ্ছা, পাশের বাড়ির অসুস্থ মানুষটির খোঁজ নেওয়ার মনকে নষ্ট করে দিচ্ছে। এমনকি ব্লু-ফিল্ম, পর্নোগ্রাফির প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছে একটা অংশ। কাজেই, স্মার্টফোনের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষ হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ার যে সার্বিক ক্ষতি ডেকে আনছে, শুধু ‘সাইবার নিরাপত্তা’ শিখিয়ে তাকে আটকানো যাবে না।

বলা বাহুল্য, এ চিত্র শুধু আমাদের দেশের নয়। ‘আর ইওর প্যারেন্টস অ্যাডিক্টেড টু ফোনস’? শিরোনামে নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় একটি প্রতিবেদন ২০১৯ সালের মে মাসে প্রকাশিত হয়। সান ফ্রান্সিসকো ভিত্তিক একটি সংস্থা ১০০০ জন মা-বাবা এবং তাঁদের সন্তানের ওপর একটি গবেষণা পরিচালনা করে। এতে বলা হয় যেখানে প্রতি ১০ জনে ৬ জন মা-বাবা মনে করেন, তাঁদের সন্তান মোবাইলে আসক্ত, সেখানে প্রতি ১০ জনে ৪ জন সন্তান মনে করে যে তাদের মা-বাবা মোবাইলে আসক্ত। জরিপে অংশ নেওয়া ৩৮ শতাংশ কিশোর বয়সী মনে করে, তাদের মা-বাবা মোবাইলে আসক্ত। শুধু তাই নয়, তারা তাদের মা-বাবার মোবাইল আসক্তি থেকে মুক্তি কামনা করে। এমনকি ৪৫ শতাংশ মা-বাবা নিজেরাই মনে করেন যে তাঁরা মোবাইলে আসক্ত। ২০২০-র ডিসেম্বরে জার্মানির হামবুর্গে একদল শিশু মা-বাবার মোবাইল আসক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে এসেছিল। আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা সাত বছর বয়সী এমিল বলে, ‘তোমরা আমাদের সঙ্গে খেলো, স্মার্টফোনের সঙ্গে নয়।’ (সূত্রঃ প্রথম আলো)

করোনা অতিমারির সময় দীর্ঘকাল পঠন-পাঠন বন্ধ থাকার অজুহাতে শিক্ষাক্ষেত্রে অনলাইন ক্লাস শুরু করা হয়েছিল। দেশের একটা বিরাট অংশের ছাত্র-ছাত্রীর কাছে স্মার্টফোন ব্যবহারের সুযোগ না থাকা সত্ত্বেও এই ব্যবস্থা চালু হয় এবং বহু গরিব ছাত্রছাত্রী চিরকালের জন্য শিক্ষার অঙ্গন থেকে দূরে সরে যায়। বহু মা-বাবা কষ্ট করে ফোন কিনে দিতে বাধ্য হন। অতিমারির প্রকোপ একটু কমার সাথে সাথেই একটি দায়িত্বশীল সরকারের কাজ ছিল এই অনলাইন শিক্ষা বন্ধ করে যত দ্রুত সম্ভব ছাত্রছাত্রীদের ক্লাসমুখী করা, উপযুক্ত পরিকাঠামো গড়ে তুলে বেশি সংখ্যায় শিক্ষক নিযুক্ত করে পড়াশুনার এতদিনের ঘাটতি পূরণের ব্যবস্থা করা। অথচ সরকার সে পথে না গিয়ে এই অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থাকেই গুরুত্ব দিল, তার হাত ধরে বাইজু- বেদান্ত-টিউটোপিয়ার মতো সংস্থাগুলো বিরাট ব্যবসা ফেঁদে বসল। শুধু তাই নয়, মাধ্যমিক উত্তীর্ণ ছাত্রছাত্রীদের দশ হাজার টাকা দেওয়া হল বই কেনার জন্য নয়, স্মার্টফোন কেনার জন্য। রীতিমতো ফতোয়া জারি করে ফোনের বিল দেখানোর নিয়ম আনা হল, যাতে চাইলেও কেউ ওই টাকা অন্য খাতে খরচ করতে না পারে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ালো, চাইলেও মা-বাবা সন্তানকে ফোন না দিয়ে পারবেন না, তাতে তার যতই ক্ষতি হোক। বিজ্ঞানের আবিষ্কারের পথ ধরে যে ইন্টারনেট-স্মার্টফোন এসেছে, পড়াশুনার কাজে, নানা তথ্য সহজে জানার কাজে, গবেষণার জন্য তা নিশ্চয়ই সদর্থক ভাবে কাজে লাগানো যায়, কিন্তু তা কোনও দিন স্কুল-কলেজের ক্লাসরুমে শিক্ষকের কাছ থেকে নেওয়া জ্ঞানের বিকল্প হতে পারে না। রবীন্দ্রনাথ একটি চমৎকার কথা বলেছিলেন –‘ঘুরিয়া ফিরিয়া যেমন করিয়াই চলি না কেন শেষকালে এই অলঙ্ঘ্য সত্যে আসিয়া ঠেকিতেই হয় যে, শিক্ষকের দ্বারাই শিক্ষাবিধান হয়, প্রণালীর দ্বারা হয় না।’

মানুষের স্মার্টফোনে আসক্তি কমে গেলে, ভোগ্যপণ্যের বাজার পড়ে গেলে বড় বড় একচেটিয়া পুঁজিপতিদের লাভের অঙ্কেও টান পড়বে। গুগল-টুইটার-হোয়াটসঅ্যাপ ইত্যাদি সংস্থা লাভের অঙ্ক ক্রমাগত বাড়িয়ে যেতে পারবে না। বাজার তাই মানুষের এই আসক্তিতে ক্রমাগত ইন্ধন জোগায়। তাকে বোঝায়, খেতে পাও বা না পাও একটা দামি ফোন না থাকলে, নিয়মিত সমাজমাধ্যমে আপডেট না দিতে পারলে তোমার মানসম্মান রইল না। কাগজপত্রে এর ক্ষতি নিয়ে লেখালিখি হয় ঠিকই, কিন্তু সেখানে স্বভাবতই বিষয়টিকে দেখানো হয় ব্যক্তির অভ্যাস, অসচেতনতার নিরিখে। এই অভ্যাস বা আসক্তি গড়ে ওঠার আঁতুড়ঘর যে আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা, স্বভাবতই সেদিকটি সযত্নে এড়িয়ে যাওয়া হয়।

এই সর্বনাশা স্মার্টফোন-আসক্তি সম্পর্কে সর্বস্তরের মানুষের সচেতন চেষ্টা প্রয়োজন, খেলার মাঠ-গল্পের বই-পাড়া প্রতিবেশীর সাহচর্যের মতো হারিয়ে যাওয়া জিনিসগুলোও শিশু-কিশোরদের পৃথিবীতে যতটা সম্ভব ফিরিয়ে আনা দরকার। আবার মনে রাখা দরকার, এটি কোনও ব্যক্তির সমস্যা নয় বা প্রযুক্তির অগ্রগতি এর জন্য দায়ী নয়। মুনাফাসর্বস্ব যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা মানুষের সমস্ত বিকাশের পথ রুদ্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে, মানুষকে সমাজবিচ্ছিন্ন করতে, তরুণ প্রজন্মের মনুষ্যত্ব ধ্বংস করতে সে সদা সচেষ্ট। বিজ্ঞানের আবিষ্কার বা প্রযুক্তির অগ্রগতি মানুষের জীবনকে সুন্দর উন্নত করবে নাকি সে প্রযুক্তির দাসত্ব করবে, তা ঠিক করে এই ব্যবস্থাই।