কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কমরেড তপন রায়চৌধুরী ৪ আগস্ট শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদনের জন্য ১৯ আগস্ট কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে স্মরণসভা আয়োজন করা হয়। বক্তব্য রাখেন সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ। সভাপতিত্ব করেন পলিটবুরো সদস্য কমরেড সৌমেন বসু। সমগ্র স্মরণসভাটি অনলাইনে সম্প্রচারিত হয়।
আজ সকাল থেকেই একটা কথা আমি ভাবছি। আমার স্মরণসভার উদ্যোক্তার ভূমিকা নেওয়ার কথা কমরেড তপন রায়চৌধুরীর– আর আজ তাঁর স্মরণসভায় আমাকেই বলতে হচ্ছে! এ যে কত ব্যথা-বেদনার, তা আর কীভাবে বোঝাব! আমার সাথে দেখা হলে কমরেডরা বলেন, ‘আপনাকে আরও কিছুদিন বেঁচে থাকতে হবে।’ অর্থাৎ আমি যেন পার্টিকে আরও কিছুদিন সার্ভিস দিতে পারি, এটা তাঁরা চান। এটা যেমন একটা দিক, অন্য দিকে দীর্ঘদিন বেঁচে থেকে এত কমরেডের মৃত্যু, বিশেষত বয়:কনিষ্ঠদের মৃত্যু, কংগ্রেস-সিপিএম-তৃণমূল আমলে বহু কমরেডের শহিদ হওয়া– এসবের দুর্বিষহ ব্যথা-বেদনা-যন্ত্রণা বহন করা যে কতটা কষ্টকর সেটা অনেকেই হয়ত বুঝতে পারবেন না।
৫ আগস্টের সভায় বলেছি, আমাদের দলটা অন্য ধরনের– বৈপ্লবিক আদর্শভিত্তিক এক নতুন ধরনের বৃহৎ পরিবার। এর সম্পর্কের চরিত্রই আলাদা ধরনের। আমরা সকলেই মহান মার্কসবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষের ছাত্র। আমাদের সকলেরই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য তাঁর শিক্ষায় অনুপ্রাণিত হয়ে সুযোগ্য সর্বহারা বিপ্লবী হিসাবে নিজেদের গড়ে তোলা। আমাদের যার যতটুকু দক্ষতা, ক্ষমতা, যোগ্যতা, গুণাবলি, এর সবটাই অর্জিত হয়েছে তাঁর শিক্ষাকে জীবনে অনুশীলনের মাধ্যমেই। স্মরণসভা অনুষ্ঠানের একমাত্র লক্ষ্য, যে কমরেডকে আমরা হারাই, যাঁর সংগ্রামী জীবনের আজ অবসান ঘটেছে, সেই নেতা বা কর্মী তাঁর জীবনসংগ্রামে কতটা এবং কোন দিক থেকে কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষা আয়ত্ত করতে পেরেছেন, তা জানা। যাতে জীবিত নেতা-কর্মীরা সেই শিক্ষাগুলি অর্জন করতে এবং এই প্রয়াত নেতা বা কর্মীর গুণাবলি থেকে অনুপ্রেরণা লাভ করতে পারেন। সেইজন্য আমাদের কোনও স্মরণসভাই নিছক একটা অনুষ্ঠান মাত্র নয়। এই সব সভায় আমরা প্রয়াত কমরেডের সংগ্রামী জীবনের কিছু অধ্যায়, তাঁর গুণাবলির কিছু দিক স্মরণ করি এই উদ্দেশ্য নিয়েই।
মার্কসবাদের ছাত্র হিসাবে আমরা জানি, ব্যক্তিসত্তার সাথে একটা বিশেষ পরিবেশের দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মধ্য দিয়ে একজনের মনন ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য গড়ে ওঠে। ছোটবেলা থেকে আমরা প্রত্যেকেই এইভাবে গড়ে উঠি। যে কোনও সমাজেই যে মূল্যবোধের চর্চা চলে, আমরা যাকে সামাজিক মূল্যবোধ বলি, তাকে ভিত্তি করে সামাজিক বিবেক জন্ম নেয় এবং এই সামাজিক বিবেককে ভিত্তি করেই ব্যক্তিবিশেষের বিবেক গড়ে ওঠে। একটা যুগে ধর্মীয় মূল্যবোধের যখন প্রগতিশীল ভূমিকা ছিল তখন তাকে ভিত্তি করে বহু বলিষ্ঠ চরিত্র গড়ে উঠেছিল। পরবর্তীকালে ইতিহাসের নিয়মে যখন ধর্মীয় মূল্যবোধ কার্যকারিতা হারায়, নবজাগরণ এবং গণতান্ত্রিক বিপ্লবকে ভিত্তি করে যে মানবতাবাদী মূল্যবোধ গড়ে ওঠে, সেটাও নতুন ধরনের বিবেক-মনুষ্যত্ব জাগায়। কারও ক্ষেত্রে সে বিবেক-মনুষ্যত্ব উন্নত স্তরের হয়, আবার কারও ক্ষেত্রে হয় অনুন্নত স্তরের। রাশিয়া, চিন, ভিয়েতনামে কমিউনিজমের আদর্শে অনুপ্রাণিত যে বিপ্লব সংঘটিত হয়, তাকে ভিত্তি করে আর এক ধরনের মূল্যবোধের চর্চা, চরিত্রের সাধনা গড়ে ওঠে।
এখানে একটা কথা বলতে চাই। যখন একটি শিশুর মন গড়ে ওঠে, তখন পারিপার্শ্বিকের প্রভাব অনেক বেশি কাজ করে। কারণ তখনও সচেতন ভাবে বিচার করার ক্ষমতা তার আসে না। ফলে পারিপার্শ্বিকের প্রভাবটাই সবচেয়ে বেশি কার্যকরী হয়। কোনটা গ্রহণ করব, কোনটা করব না, কোনটা উচিত, কোনটা অনুচিত– এই বিচারবোধ তখন তার জন্মায় না। সেটা আসে আর একটু পরে। কমরেড তপন রায়চৌধুরীর সাথে আমার বয়সের ব্যবধান ৫-৬ বছরের। ফলে আমাদের সময়ের ব্যবধান বেশি নয়। আমি আমার সময়ের কথা বলছি, যেটা ছিল স্বাধীনতা আন্দোলনের শেষ অধ্যায়। তখন আমাদের সামনে ঘরে ঘরে আলোচ্য বিষয় হিসাবে ছিলেন বিদ্যাসাগর, বিবেকানন্দ, দেশবন্ধু, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, নজরুল, ক্ষুদিরাম, ভগৎ সিং, সূর্য সেন, সুভাষচন্দ্র। আমাদের শিক্ষক-অভিভাবকদের মধ্যে এই মনীষীদের চর্চা ছিল। আমাদের ঠাকুমা-দিদিমাদের মধ্যে ধর্মীয় মূল্যবোধের চর্চা ছিল। আমার গড়ে ওঠা ক্ষমতা হস্তান্তরের আগের পর্যায়ে, কমরেড তপন রায়চৌধুরীর গড়ে ওঠা ক্ষমতা হস্তান্তরের পরে পরেই। তখনও স্বাধীনতা সংগ্রামের এই উত্তাপের কিছু কিছু রেশ ছিল। তৎকালীন পশ্চিমবাংলায় সোভিয়েট ইউনিয়নের প্রভাব ছিল, মহান স্ট্যালিনের প্রভাব ছিল, শিক্ষিত মহলে কমিউনিজম এবং বামপন্থার প্রতি প্রবল আকর্ষণ ছিল। ফলে সেই সময়ে যারা গড়ে উঠেছিল, কম-বেশি সকলের মধ্যে এসবের কিছু প্রভাব ছিল। আজ আমরা দেখছি, সমাজে কোনও মূল্যবোধই নেই– সম্পূর্ণ শূন্যতা। একটা মূল্যবোধ থাকলে তাকে আর একটা নতুন মূল্যবোধের স্তরে উন্নীত করা সহজ। কিন্তু যেখানে কোনও মূল্যবোধই নেই, মূল্যবোধের প্রয়োজনবোধই নেই, প্রায় সম্পূর্ণ বিবেকবর্জিত মানসিকতা– তাকে পরিবর্তন করা অনেক কঠিন।
কমরেড তপনের সাথে আমার যোগাযোগ তাঁর দাদা স্বপন রায়চৌধুরীর মাধ্যমে। কমরেড স্বপনের সাথে আমার যোগাযোগ তাঁর কাকা কমরেড মাধব রায়চৌধুরীর মাধ্যমে। কমরেড মাধব রায়চৌধুরী একসময়ে আমাদের দলের খুবই শক্তিশালী সংগঠক ছিলেন। হকার আন্দোলনের নেতা ছিলেন। পরবর্তীকালে পার্টির মুর্শিদাবাদ জেলা সম্পাদক হন, তারপরে পার্টি তাঁকে বাঁকুড়া জেলার দায়িত্ব দেয়। কিন্তু শেষজীবনে খানিকটা সঙ্কটজর্জরিত হয়ে আগের মতো সক্রিয় থাকতে পারেননি, কিন্তু আমৃত্যু পার্টির ঝাণ্ডাটা বহন করে গেছেন। কমরেড মাধব রায়চৌধুরী পাঁচের দশকের মাঝামাঝি সময়ে কমরেড স্বপন রায়চৌধুরীর সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দেন। সেইসময় কমরেড স্বপন রায়চৌধুরী ছিলেন বিবেকানন্দের একনিষ্ঠ ভক্ত, অন্যদিকে সিপিআই-এর দ্বারা অনুপ্রাণিত। এই অবস্থায় তাঁর সাথে অনেক আলাপ আলোচনা হয়। তার দ্বারা তিনি আকৃষ্ট হন এবং কমরেড শিবদাস ঘোষের ক্লাস, মিটিংগুলিতে আসতে শুরু করেন। এর কিছুদিন পরেই পার্টির হোলটাইমার হিসাবে তিনি আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর প্রভাবটা ছোটো ভাই কমরেড তপন রায়চৌধুরীর ওপরে পড়ে। তাঁর সাথেও আমার যোগাযোগ হয়, কথাবার্তা হয়। আপনারা শোকপ্রস্তাবে শুনেছেন, আশুতোষ কলেজে আমাদের ছাত্র সংগঠন ডিএসও-র নিজস্ব শক্তিতে প্রথম যে ছাত্র ইউনিয়ন নির্বাচিত হয়, তার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন দলের বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটি ও পলিটব্যুরোর সদস্য কমরেড অসিত ভট্টাচার্য এবং সেই ইউনিয়নের স্টুডেন্ট এইড ফান্ড সেক্রেটারি ছিলেন কমরেড তপন রায়চৌধুরী। তখনই তাঁর যে দায়িত্ববোধ, কর্তব্যবোধ, ছাত্রদের প্রতি দরদবোধ পরিস্ফূট হয়, তা ছিল লক্ষণীয়। এখানে একটা জিনিস বলা ভাল, স্বপন রায়চৌধুরীর পার্টিকে গ্রহণ করা, আত্মনিয়োগ করা, আর তপন রায়চৌধুরীর পার্টিকে গ্রহণ করার মধ্যে কিছু পার্থক্য গোড়ার দিকে ছিল। স্বপন রায়চৌধুরী সম্পূর্ণভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। অন্য দিকে তপন রায়চৌধুরী পরিবারে থেকে পারিবারিক দায়িত্ব পালন করা, তার সাথে পার্টির দায়িত্ব পালন করা– প্রথম দিকে এভাবেই ছিলেন । আমি ৭০ বছর এই পার্টির সাথে যুক্ত। বহু কমরেডের অগ্রগতি, পিছিয়ে যাওয়া, অনেক কিছুই আমি লক্ষ করেছি। প্রথম জীবনে যাঁরা ঘরবাড়ি কেরিয়ার ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন, অনেকে অনেক কাজও করেছেন– আবার চলার পথে প্রেম-ভালোবাসা, বিবাহ, সন্তান, এইসব প্রশ্ন যখন এসেছে, একদল কমরেড নিজেদের অগ্রগতি রক্ষা করতে পারেননি। আবার সংসারজীবনে জড়িয়ে গেলেও পার্টির সাথে তাঁরা সম্পর্ক ছিন্ন করেননি। পার্টির দায়িত্ব পালন করেছেন অনেকেই, আবার কেউ কেউ পারেননি। তপন রায়চৌধুরীর ক্ষেত্রে ঘটেছে তার সম্পূর্ণ বিপরীত। প্রথম জীবনে তাঁর ছিল পারিবারিক দায়দায়িত্ব পালন, তার সাথে পার্টির কাজকর্ম করা। ধীরে ধীরে ক্রমাগত অগ্রগতির পথে পারিবারিক সম্পর্কের গ্রন্থিগুলি ছিন্ন করতে করতে পরিণত জীবনের শেষ অধ্যায়ে তিনি একেবারে মুক্ত হয়ে বেরিয়ে আসেন। এটা একেবারে অন্য ধরনের একটা দৃষ্টান্ত।
এখানে একটা ঘটনা বলা দরকার। কমরেড অসিত ভট্টাচার্যের পরিবার হয়তো সেইসময় আসাম চলে গিয়েছিল বা রাজনৈতিক বিরোধ থেকে তিনি পরিবার ছেড়ে দিয়েছিলেন– এই রকম একটা অবস্থায় তাঁকে নিয়ে চেতলাতে আমরা প্রথম ডিএসও-র একটা সেন্টার শুরু করি, সম্ভবত ১৯৫৯ সালের দিকে। কমরেড অসিত ভট্টাচার্যের সাথে আর একজন কর্মী ছিলেন। অসিতের একবার কঠিন টাইফয়েড হয়। আমি তখন সবে অখিল মিস্ত্রি লেনে পার্টি সেন্টারে স্থান পেয়েছি। এইসময় তাঁকে কোথায় রাখা হবে– এই নিয়ে আমরা খুবই দুশ্চিন্তায় পড়ে যাই। কমরেড স্বপন রায়চৌধুরী এগিয়ে আসেন। আলিপুরে তাঁদের বাবা চাকরি সূত্রে জেলের কোয়ার্টারে থাকতেন। সেখানেই তাঁরা সযত্নে কমরেড অসিত ভট্টাচার্যকে রাখেন। বিশেষত তাঁদের মা অসিতকে খুবই সেবাযত্ন করেছিলেন। অসিত সেখানে মাসাধিক সময় ছিলেন। কমরেড অসিত ভট্টাচার্যের প্রভাবও এই দু’জনের ওপর পড়েছিল।
এ কথা ঠিক যে, দক্ষিণ কলকাতায় আশুতোষ কলেজে তপন রায়চৌধুরীর কর্মজীবন অল্প দিনের ছিল। এরপর তাঁদের পরিবার দমদমে চলে যায়। সেখানে কমরেড কৃষ্ণ চক্রবর্তীর উদ্যোগে পার্টি সংগঠন গড়ে উঠছিল। তাঁর সহকারী হিসাবে কমরেড স্বপন রায়চৌধুরী বলিষ্ঠ ভূমিকা নেন। সেইসময় কমরেড তপন রায়চৌধুরীও ওখানকার রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক নানা কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেন। তারপর তিনি মাধ্যমিক স্কুলে শিক্ষকতার পেশা গ্রহণ করেন। ইতিমধ্যে কমরেড স্বপন রায়চৌধুরীকে কমরেড শিবদাস ঘোষ ছাত্রফ্রন্ট থেকে তুলে নিতে বলেন এবং পুরুলিয়া জেলায় পার্টির কাজের জন্য পাঠিয়ে দেন। পুরুলিয়ায় কমরেড স্বপন রায়চৌধুরী ছাত্র সংগঠন, যুব সংগঠন, শ্রমিক সংগঠন, কৃষক সংগঠন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভূমিকা নেন। তিনি খুবই শক্তিশালী সংগঠক ছিলেন।
আমি মনে করি এই সময়ের দুটি ঘটনা কমরেড তপন রায়চৌধুরীর আরও অগ্রগতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। আপনারা অনেকেই চেনেন কমরেড কৃষ্ণা সেনকে– তিনি যোগমায়া দেবী কলেজে ডিএসও-র ছাত্র ইউনিয়নের প্রথম জেনারেল সেক্রেটারি ছিলেন। তিনি ডিএসও কর্মী হিসাবেই কাজ করতেন। কমরেড বাদশা খানের দূরসম্পর্কের বোন ছিলেন কৃষ্ণা। তাঁর মাধ্যমেই দলের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হয়। ডিএসও-র কাজ করতে করতেই কমরেড শীতেশ দাশগুপ্তের ভাই সোমেশ দাশগুপ্তের সাথে কৃষ্ণার একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে ও বিবাহ হয়। সোমেশ দাশগুপ্ত পার্টির সাথে যুক্ত থাকলেও তাঁর স্ট্যান্ডার্ড ভাল ছিল না। তাঁদের দাম্পত্য জীবন খুবই দুঃখের এবং অশান্তিময় হতে থাকে। সোমেশ দাশগুপ্ত পার্টি থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যান এবং কমরেড কৃষ্ণা সেনের উপর মেন্টাল টর্চার চলতে থাকে। এভাবে তাঁদের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। তপন রায়চৌধুরীর সাথে কৃষ্ণা সেনের আগে থেকে পরিচয় ছিল। তপন আশুতোষ কলেজে, আর কৃষ্ণা যোগমায়া দেবী কলেজে সংগঠনের কাজ করতেন। কৃষ্ণা সেন যখন দাম্পত্য জীবনে দুর্বিষহ যন্ত্রণার মধ্যে রয়েছেন, তপন রায়চৌধুরী তাঁর প্রতি সহানুভূতিশীল হন এবং পরবর্তীকালে তার পরিণতিতেই উভয়ের মধ্যে একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কৃষ্ণা পূর্বের বিবাহিত জীবনে একটি পুত্রসন্তানও ছিল। সোমেশ দাশগুপ্তর সাথে কৃষ্ণা সেনের সম্পর্ক ছিন্ন হওয়া এবং তপন রায়চৌধুরীর সাথে তাঁর সম্পর্ক গড়ে ওঠা– এই সময়ে সন্তানটির পরিণতি কী হবে– এই সব প্রশ্নে তাঁরা কমরেড শিবদাস ঘোষের সাহায্য চান। কমরেড শিবদাস ঘোষ এ ক্ষেত্রে একটি বলিষ্ঠ ভূমিকা নেন। সেই সময়ে কমরেড শিবদাস ঘোষের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে এসে তাঁর সর্বোন্নত সর্বহারা সংস্কৃতি, চারিত্রিক দৃঢ়তা ও মহত্ব জানা-বোঝার প্রত্যক্ষ সুযোগ পান কমরেড তপন রায়চৌধুরী। কমরেড শিবদাস ঘোষ এর একটা সমাধান করেন এবং তিনিই এই সন্তানের দায়িত্ব নেন। কৃষ্ণা সেন ও তপন রায়চৌধুরীর বিবাহ হয়। এই বিবাহকে তপন রায়চৌধুরীর পরিবার কনভেনশনাল মাইন্ড থেকে খুশি মনে মেনে নিতে পারেনি। এই সব প্রশ্নে কমরেড শিবদাস ঘোষের বৈপ্লবিক দৃষ্টিভঙ্গি, দৃঢ়তা, উদারতা ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য কমরেড তপন রায়চৌধুরীকে অনুপ্রাণিত করে। তাঁর জীবনের টার্নিং পয়েন্ট হিসাবে এটা বিরাট প্রভাব ফেলেছিল।
‘কমসোমল’ পুস্তিকায় প্রয়াত শ্রদ্ধেয় কমরেড নীহার মুখার্জীর আলোচনায় আপনারা একটি ঘটনার উল্লেখ পাবেন– একটা বাচ্চা ছেলে কমরেড শিবদাস ঘোষের সাথে ক্যারাম খেলত, বারবার হারত, আর কাঁদত। একজন কমরেড বলেছিলেন, ওকে জিতিয়ে দিন। উনি বলেছিলেন– না, ও হারুক। তাতে ওর জেতার জেদ বাড়বে। আমিই সেই যে এই প্রস্তাব দিয়েছিল, আর এই বাচ্চাটিই হল কমরেড কৃষ্ণা সেনের পুত্র। কমরেড ঘোষ বাচ্চাটিকে খুব ভালবাসতেন। সেও খুব সুন্দরভাবে গড়ে উঠছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে সোমেশ দাশগুপ্ত তাকে নিয়ে যান। কমরেড ঘোষ এতে খুবই আঘাত পান। কিন্তু কিছু করারও ছিল না। কৃষ্ণাও খুব কষ্ট পান। আবার কৃষ্ণাও তপন রায়চৌধুরীর সান্নিধ্যে এসে দলের কাজকর্মে আরও আত্মনিয়োগ করতে থাকেন। পরবর্তীকালে মহিলা সংগঠনের দায়িত্ব পালন করেন। আমি এটাও লক্ষ করেছি। বিবাহিত জীবনে কৃষ্ণা তপন রায়চৌধুরীর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে কখনও বাধা দেওয়া দূরের কথা, আগাগোড়াই সহায়কের ভূমিকা পালন করে গেছেন। এমনও হয়েছে, কোনও কারণে তপন রায়চৌধুরীর কোনও মানসিক অশান্তি দেখা দিলে, কমরেড কৃষ্ণা আমার সাহায্য নিয়েছেন। ইতিমধ্যে একটা দুঃখজনক ঘটনায় কমরেড স্বপন রায়চৌধুরী আঘাত পান এবং মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। কমরেড স্বপনের অসুস্থতা এবং তাঁর চিকিৎসা নিয়ে তপনের সাথে কমরেড শিবদাস ঘোষের বহু আলাপ-আলোচনা হয়। এই অবস্থায় তপন এবং কৃষ্ণারাই রোগগ্রস্ত স্বপন রায়চৌধুরীর দায়িত্ব অনেকটাই বহন করেন। এই দুটি ঘটনায় কমরেড তপন রায়চৌধুরী কমরেড শিবদাস ঘোষের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে এসেছিলেন। তাঁর মহান চরিত্রের, মহত্বের, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের স্পর্শ পেয়েছিলেন। এই দুটি ঘটনা কমরেড তপন রায়চৌধুরীর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা নেয়। সকলেই জানেন, কমরেড শিবদাস ঘোষ যতদিন জীবিত ছিলেন, দলের সমস্ত কমরেডকেই– সে কলকাতার হোক, অন্য জেলার হোক, অন্য রাজ্যের হোক– প্রত্যেককেই উন্নত হতে সাহায্য করেছেন। এর জন্য দিবারাত্র পরিশ্রম করেছেন।
শিক্ষক আন্দোলনে কমরেড তপন রায়চৌধুরীর ভূমিকার কথা শোক প্রস্তাবে বলা হয়েছে। তখন এবিটিএ ছিল একমাত্র শিক্ষক সংগঠন। তখন এবিটিএ-র নেতা ছিলেন সর্বজনশ্রদ্ধেয় শ্রী সত্যপ্রিয় রায়, যিনি আমাদেরও শিক্ষক ছিলেন। আমি তখনও দলে যুক্ত হইনি, দক্ষিণ কলকাতার যে কালীধন ইনস্টিটিউটে আমি পড়তাম, সেই স্কুলের তিনি প্রধান শিক্ষক ছিলেন। স্কুলে প্রথম ইউনিয়ন গঠনের উদ্যোগ নিই আমি এবং ছাত্রদের দাবিপত্র নিয়ে তাঁর কাছে যাই। তিনি দাবিপত্রটি ছিঁড়ে ফেলে দেন। এরপর আমি প্রস্তাব করি, ইউনিয়ন নয়, সাংস্কৃতিক সংগঠন করব। এতে তাঁর আপত্তি ছিল, তা সত্ত্বেও বারবার অনুরোধ করায় তিনি মেনে নেন। শেষ পর্যন্ত সাংস্কৃতিক সংগঠন আমরা গড়ে তুলি। এর কয়েক মাস পরেই দলের সাথে আমার যোগাযোগ হয়। আমি এবং আমার পাঁচজন সহপাঠী দলে যোগ দিই। কমরেড শিবদাস ঘোষ ঠাট্টা করে বলতেন– পঞ্চ পাণ্ডব। কৃষ্ণ চক্রবর্তী, অসিত ভট্টাচার্য, ভবেশ গাঙ্গুলী– এঁরাও এই সাংস্কৃতিক সংগঠনে যুক্ত হয়ে পরবর্তী সময়ে পর পর দলে যুক্ত হন। সেইসময় শ্রী সত্যপ্রিয় রায় কোনও দল করতেন না এবং পশ্চিমবাংলায় তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয় একজন শিক্ষক-নেতা ছিলেন। ১৯৫২ সালে কমরেড শিবদাস ঘোষ যখন কমিউনিস্ট চিন থেকে ঘুরে আসেন, তখন তাঁর অভিজ্ঞতা শোনার জন্য ওই স্কুলে একটি সভার প্রস্তাব করি। প্রধান শিক্ষক শ্রী সত্যপ্রিয় রায় প্রথম দিকে গররাজি হলেও শেষ পর্যন্ত তাঁরই সভাপতিত্বে এই সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং এই সভায় কমরেড শিবদাস ঘোষের সংক্ষিপ্ত বক্তব্য আমার উপর এবং উপস্থিত শিক্ষক ও ছাত্রদের উপর বিশেষ প্রভাব সৃষ্টি করে। তখন শ্রদ্ধেয় শ্রী সত্যপ্রিয় রায় দল বহির্ভূত লিবারাল ডেমোক্র্যাট ছিলেন। ১৯৫৪ সালে যে ঐতিহাসিক শিক্ষক-আন্দোলন হয়েছিল, তিনি তাঁর নেতৃত্বে ছিলেন। এই এবিটিএ সংগঠনে দলমত নির্বিশেষে সমস্ত শিক্ষকরা যুক্ত ছিল। উনিও এবিটিএ সংগঠনের সর্বজনস্বীকৃত শিক্ষক-নেতা ছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে তিনি সিপিআই-এর সাথে, পরে সিপিএম-এর সাথে যুক্ত হন এবং তাঁরও অনেক পরিবর্তন হয়। যে চন্দননগর কনফারেন্সের কথা শোকপ্রস্তাবে বলা হল– সেই সময় কৃষ্ণ চক্রবর্তী একদিকে ডিএসও-র সেক্রেটারি, আর এক দিকে স্কুলশিক্ষক ছিলেন। যদিও শিক্ষকতার কাজ তিনি নিজের বা পরিবারের প্রয়োজনে নয়, নিয়েছিলেন দলের প্রয়োজনে। দলের তখন টাকার প্রয়োজন ছিল এবং শিক্ষকতা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কমরেড কৃষ্ণ চক্রবর্তী পার্টির হাতে তাঁর উপার্জনের টাকা তুলে দিয়েছেন। এমনকি ডিএসও সংগঠনের বহু খরচ ওই× টাকাতেই চলত। কৃষ্ণ চক্রবর্তীর নেতৃত্বেই চন্দননগরে ১৯৬৮ সালে সত্যপ্রিয় রায়ের সাথে প্রথম সংঘাত শুরু হয়, যখন সিপিএম পুরো এবিটিএ-কে কুক্ষিগত করতে চাইল। এই এবিটিএ-তে আমরা সহ আরএসপি, ফরোয়ার্ড ব্লক, সিপিআই, কংগ্রেস সকলেই ছিল। সিপিএমের নেতা-কর্মীদের অনেকেই তখন রাজ্যের মন্ত্রী। এবিটিএ-র সংবিধান সিপিএম সংশোধন করালো। সংবিধানে ছিল শিক্ষকরাই এবিটিএ-তে সভাপতি এবং সম্পাদক হবে। ওরা সংবিধান পরিবর্তন করে আনল– রিটায়ার্ড টিচাররাও সভাপতি এবং সম্পাদক হতে পারবে, যাতে সিপিএম তাদের পছন্দমতো রিটায়ার্ড শিক্ষক দু’জনকে সভাপতি ও সম্পাদক করতে পারে। কমরেড কৃষ্ণ চক্রবর্তী বলিষ্ঠভাবে এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করেন। তাঁরাও প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেন। এখান থেকেই এবিটিএ-র ভাঙন শুরু।
এখানে আমি আর একটা কথা বলতে চাই। কমরেড শিবদাস ঘোষ যুক্ত আন্দোলনের ক্ষেত্রে এবং যে কোনও গণসংগঠনের ক্ষেত্রে চাইতেন, রাজনৈতিক মতভেদ থাকা সত্ত্বেও গণতান্ত্রিক ভিত্তিতে বহুদলীয় সংগঠন হোক, যাতে সকলকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করা যায়। বিভিন্ন পার্টির অধীনে শিক্ষক, ছাত্র, যুব, শ্রমিক, কৃষকরা আছেন– সবাই মিলেই ঐক্যবদ্ধভাবে সংগঠন চালাবেন। সংগঠন পরিচালনা করতে হবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এবং ন্যূনতম কর্মসূচির ভিত্তিতে। এই ছিল তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি। বড় দল থাকলে নিচয়ই বড় দল নেতৃত্বে থাকবে। কিন্তু ছোট দলের কণ্ঠরোধ করা চলবে না। ছোট দলকেও তার বক্তব্য বলতে দিতে হবে, ক্লিক করে নেতৃত্ব কুক্ষিগত করা চলবে না। মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে ঐক্য-সংগ্রাম-ঐক্য– এই নীতি নিয়ে চলতে হবে। অর্থাৎ ন্যূনতম কর্মসূচিকে ভিত্তি করে ঐক্য হবে এবং বিভিন্ন মত ও চিন্তার আদর্শগত সংগ্রাম হবে। তার ভিত্তিতে কর্মসূচির ঐক্য উন্নততর ও দৃঢ় হবে। এর ফলে এক দিকে যেমন ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন শক্তিশালী হবে, অন্য দিকে বিভিন্ন দলের কর্মী-সমর্থক ও জনগণ নানা দলের আদর্শ ও সংস্কৃতির পার্থক্যও বুঝতে পারবে। এই প্রস্তাব সিপিএম কোনওদিনই মানেনি। সংকীর্ণ দলীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে দলের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা, জবরদস্তি করা, অন্য দলের কণ্ঠরোধ করা, নিজেদের মত চাপিয়ে দেওয়া, যে ভাবেই হোক নেতৃত্ব দখল করা– সিপিএম এইভাবে তার কর্তৃত্ব চালিয়েছে। যার ফলে প্রায় প্রতিটি গণসংগঠন ও বহুদলীয় সংগঠনের ক্ষেত্রে ওরা এভাবে ভাঙন ঘটিয়েছে। এবিটিএ থেকে বাধ্য হয়ে সিপিএম-বিরোধীরা বেরিয়ে এসে এসটিইএ গড়ে তোলে। এই সময় কমরেড কৃষ্ণ চক্রবর্তী পার্টির কাজে দিল্লিতে চলে যান। শিক্ষক-ফ্রন্টে কমরেড দেবপ্রসাদ সরকার ছিলেন, আমাদের লোকজনও কম ছিল। তারপর কমরেড তপন রায়চৌধুরী সামনের সারিতে উঠে আসেন। এখানে তপন রায়চৌধুরীর যে ভূমিকা ছিল, তা বিশেষভাবে শিক্ষণীয়। দলমত নির্বিশেষে বিভিন্ন মতের লোকজনের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে, সকলের মতামত খোলাখুলি বিচার-বিবেচনা করে সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে কমরেড শিবদাস ঘোষের দৃষ্টিভঙ্গিতে যেভাবে বহুদলীয় সংগঠন পরিচালনা করতে হয়, কমরেড তপন রায়চৌধুরী তা যোগ্যতার সাথে বাস্তবে কার্যকরী করেছেন। তত্ত্বকে বাস্তবে সফলভাবে প্রয়োগ করেছেন। তত্ত্ব বুঝলেও সকলে তা প্রয়োগ করতে পারে না। এই সংগঠনে তপন রায়চৌধুরী অত্যন্ত দক্ষতার সাথে তা করেছেন। যুক্তি এবং আবেগ মিশ্রিত বক্তব্য বিষয় সহজ সরল ভাবে উপস্থিত করার দক্ষতার জন্য তপন রায়চৌধুরীর বক্তব্যের খুবই প্রভাব ছিল।
কমরেড তপন রায়চৌধুরীর দায়িত্ববোধ, কর্তব্যবোধের কথা অনেকেই চোখের জলে স্মরণ করেছেন। যখন তাঁর শেষ সময় উপস্থিত, কমরেড তরুণ মণ্ডল বুদ্ধিজীবী ফোরামের কয়েকজনকে সংবাদটা দিয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে বুদ্ধিজীবী ফোরামের দু’জন নেতৃস্থানীয় সদস্য, বাঁচানো যাবে না এই কথা শুনেই কাঁদতে শুরু করেছেন। তাঁরা বয়স্ক লোক। আমি অনুমান করতে পারি, তাঁর মৃত্যুর খবরে পশ্চিমবাংলার শহরে, গ্রামে, পাড়ায় পাড়ায় অসংখ্য প্রবীণ শিক্ষক, যাঁরা তাঁর সংস্পর্শে এসেছেন, তাঁরা অশ্রুসজল চোখে তাঁকে বারবার স্মরণ করছেন। অনেকে বার্তা পাঠিয়েছেন, বলেছেন, তপন রায়চৌধুরী শিক্ষক আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ছিলেন। তিনি আমাদের শুধু নেতা ছিলেন না, আমাদের অভিভাবক ছিলেন। তাঁর সম্পর্কে যে এই ধরনের শ্রদ্ধা রয়েছে, আগে আমি এতটা জানতাম না। এমনকি দলের লোক নন, এমন বহু শিক্ষকের পারিবারিক জীবনের অনেক সমস্যা সমাধানেও তিনি ভূমিকা পালন করেছেন। বহু দূর দূর জায়গায় চলে যেতেন, কে অসুস্থ তাঁর সাথে দেখা করতে বা কোনও কারণে কোনও সিদ্ধান্ত বুঝতে কেউ ভুল করেছেন, তাঁকে বোঝাতে– তিনি আমাদের দলের লোক হোন বা না হোন। এই যে দরদবোধ, এই যে হৃদয়বৃত্তি, এই কর্মনিষ্ঠা– এসবের দ্বারা অন্যদের গভীর শ্রদ্ধা ও অন্তরের ভালোবাসা অর্জন করেছিলেন, সকলের আপনজন হয়ে গিয়েছিলেন। এই পরিচিতি তাঁকে কোনও খবরের কাগজ দেয়নি। কোনও টিভি চ্যানেল তাঁকে মানুষের কাছে পরিচিত করায়নি। কিন্তু অসংখ্য প্রবীণ, বিচক্ষণ শিক্ষকের অন্তরের শ্রদ্ধা-ভালোবাসা অর্জন করা, তাঁদের আপনজন হওয়া– শুধু নেতা নয়, তাঁদের অভিভাবক হওয়া– এ সহজ কথা নয়, এটা দুর্লভ। এখানে কমরেড তপন রায়চৌধুরী কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষাকে খুবই দক্ষতা ও যোগ্যতার সাথে এবং হৃদয়ের ভালোবাসার সঙ্গে প্রয়োগ করতে পেরেছিলেন। শিক্ষক আন্দোলনে একসময় সত্যপ্রিয় রায় যেমন সর্বজন গ্রহণযোগ্য ছিলেন, অনেকটা প্রায় সমতুল্য পর্যায়ে কমরেড তপন রায়চৌধুরী চলে গিয়েছিলেন। কমরেডদের কাছ থেকে শুনেছি, তিনি কোনও জেলায় গেছেন শুনলে দূরদূরান্ত থেকে শিক্ষকরা খবর পেলে ছুটে আসতেন তাঁর সাথে দেখা করার জন্য, আলোচনা করার জন্য। তিনি পপুলার ছিলেন কিন্তু পপুলিজমের শিকার ছিলেন না। পপুলিজম মানে হচ্ছে হাবেভাবে-ভঙ্গিতে ম্যানেজ করে মানুষকে আকৃষ্ট করা বা প্র্যাগমেটিজমের চর্চা করা, যেটা বুর্জোয়া পেটিবুর্জোয়া আচরণের ধরন। আপাত একটা কার্যসিদ্ধির জন্য একে ওকে ম্যানেজ করা বা এ-কথা সে-কথা বলে চালাকি করা। সোজা-সরল ভাবে পার্টির বক্তব্য, যুক্তিগুলি উত্থাপন করতেন কমরেড তপন রায়চৌধুরী এবং তাতেই অপরের হৃদয় স্পর্শ করতে পারতেন। কিন্তু সস্তায় হাততালি পাওয়া, মানুষের মধ্যে নাম করা, এসব ঝোঁক তাঁর একেবারেই ছিল না, যা কোনও সংগঠনের নেতা হলে, এমএলএ-এমপি হলে, মন্ত্রী হলে, পঞ্চায়েতের প্রধান বা সভাপতি হলে অনেকেরই আসে। কিন্তু তিনি এই ধরনের নেতা ছিলেন না। দলের সব সংগঠনেরই নেতা আছেন, তাঁরা কনফারেন্সে নির্বাচিত হন। কিন্তু তাঁরা কি সকলেই এভাবে হৃদয় জয় করা নেতা হন? কেউ কেউ হন, অনেকেই পারেন না। বিশেষত বহুদলীয় গণসংগঠনের এই ধরনের নেতা হওয়া কত দুঃসাধ্য! কিন্তু কমরেড তপন রায়চৌধুরী দলীয় শিক্ষাকে আয়ত্ত করে সহজ সাবলীল ভাবে এই স্তরে নিজেকে উন্নীত করতে পেরেছিলেন। যাঁরাই তপন রায়চৌধুরীকে জেনেছেন, তাঁর মাধ্যমে তাঁরা এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) পার্টিকে জেনেছেন, কমরেড শিবদাস ঘোষকে জেনেছেন। এ সবই একটা শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত।
গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বহুদলীয় সংগঠন পরিচালনা করা এত সহজ কথা নয়। একটা সময় শিক্ষক সংগঠনের মধ্যে ফরোয়ার্ড ব্লক, সিপিআই, কংগ্রেসের নেতারা ছিলেন। তাঁরা দলীয় সংকীর্ণ দৃষ্টিতে ভেবেছিলেন, সংগঠনের মধ্যে এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট ) দলের প্রভাব বাড়ছে, তাই তপন রায়চৌধুরীকে সরানো দরকার। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তাঁরা নিজেদের দলের বহু কর্মী-সমর্থকদের রাজি করাতে পারেননি। সাধারণ শিক্ষকদেরও পারেননি। এটা আমাদের দলের প্রভাবে কিন্তু হয়নি। আমাদের দলের শিক্ষক-কর্মী সংখ্যায় খুব বেশি ছিলেন না। কমরেড তপন রায়চৌধুরীর যে সার্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা ছিল, তার প্রভাবেই এটা হয়েছে। এটাও একটা শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত। এটাও উল্লেখ করা দরকার, শিক্ষক বা অন্য কোনও সংগঠন হোক অথবা পার্টিরই হোক, কোনও সভায় তিনি উপস্থিত থাকলে খুব অল্প কথায় নিজের বক্তব্য উপস্থিত করতেন। বিপ্লবী তত্ত্বের বা সাহিত্যের বই যা তিনি পড়তেন, সেই তত্ত্বের মূল কথাগুলি সহজ সরলভাবে উপস্থিত করতে পারতেন, যা সকলের কাছেই সহজবোধ্য হত। কঠিন, জটিল তত্ত্ব সহজ ভাবে বুঝতেন বলেই এটা পারতেন।
শ্রদ্ধার্ঘ্যতে উল্লেখ আছে, কমরেড তপন রায়চৌধুরীর এনসিসি ট্রেনিং নেওয়া ছিল, যে জন্য ভলান্টিয়ার বাহিনী সংক্রান্ত টেকনিক্যাল নলেজটা তাঁর ছিল। কিন্তু শুধু এটাই সব নয়। কমরেড তপনের শৃঙ্খলাবোধ, কর্তব্যবোধ এবং প্রবল অসুবিধা ও দুর্যোগের মধ্যেও নিজেকে ধীর স্থির শান্ত রেখে কাজ করার ক্ষমতা ও দক্ষতা ছিল। যার জন্য বিভিন্ন সময় পার্টির বড় কর্মসূচিগুলিতে ভলান্টিয়ারিংয়ের কাজে দক্ষতার সাথে নেতৃত্বকারী ভূমিকা পালন করেছেন। ১৯৮৭ সালে ঘাটশিলায় কমরেড শিবদাস ঘোষ শিক্ষাকেন্দ্র উদ্বোধনে, ১৯৯৭ সালে ঘাটশিলায় কমরেড শিবদাস ঘোষের পূর্ণাবয়ব ব্রোঞ্জ মূর্তি উন্মোচন অনুষ্ঠানের কর্মসূচিতে ভলান্টিয়ারিংয়ের দায়িত্ব তাঁর উপরেই ন্যস্ত ছিল। ১৯৮৮ সালে পার্টির প্রথম কংগ্রেসের আগে কমরেড নীহার মুখার্জীর পরিকল্পনায় বিভিন্ন গণসংগঠনের ভলান্টিয়ার বাহিনী গড়ে তোলা এবং তার ট্রেনিংয়ের দায়িত্বে ছিলেন কমরেড তপন রায়চৌধুরী। ২০০৯ সালে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় পার্টি কংগ্রেসেও তাঁরই উপর ভলান্টিয়ার বাহিনী এবং গার্ড অফ অনারের দায়িত্ব ছিল। তাঁর সহযোগী ছিলেন আর একজন শিক্ষক নেতা কমরেড শঙ্কর গাঙ্গুলী। ১৯৬৭ সাল থেকে শুরু করে যতদিন সুস্থ ছিলেন সেই দীর্ঘ সময় ধরে ২৪ এপ্রিল পার্টির প্রতিষ্ঠা দিবস এবং ১৯৭৬ সাল থেকে কমরেড শিবদাস ঘোষ স্মরণ দিবসে গার্ড অব অনার ও প্যারেডের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে কমরেড তপন রায়চৌধুরীই থাকতেন। ১৯৮০ সালে দিল্লি অভিযানে মিছিল পরিচালনার দায়িত্বেও ছিলেন তিনি। ১৯৯৩ সালে এবং ১৯৯৭ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের কর্মসূচিতেও তিনিই ছিলেন পার্টির ভলান্টিয়ার বাহিনী ও মিছিল পরিচালনার দায়িত্বে। ১৯৯০ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত পার্টির আহ্বানে ন’টি বাংলা বনধে তিনি নেতৃত্বকারী ভূমিকা পালন করেছেন। ১৯৮৩ সালে বাসভাড়া বৃদ্ধি প্রতিরোধ আন্দোলন, ১৯৮৭ সাল থেকে ভাষা-শিক্ষা আন্দোলন, ২০০৬ সাল থেকে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনে তিনি নেতৃত্বের দৃষ্টান্তকারী ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭৫ সালে সিউড়িতে যুব সম্মেলন হচ্ছে, কমরেড শিবদাস ঘোষ ও জয়প্রকাশ নারায়ণজি বক্তা। তা পণ্ড করার জন্য ওই দিনই সি পি এম বাংলা বনধ ডেকেছিল। কংগ্রেস তখন সরকারি ক্ষমতায়। ডেলিগেটদের থাকার জন্য যে সব হল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাড়ি নেওয়া হয়েছিল, নানা অজুহাতে কংগ্রেস সরকার সেগুলি দখল করে নিয়েছিল। এদিকে প্রবল বৃষ্টি ও ঝড় হচ্ছে। প্রকাশ্য সমাবেশের পর দুর্যোগ আরও বাড়ল। ডেলিগেটদের রাতে থাকার জায়গা নেই। নতুনরা কিছু অসুবিধাজনিত ক্ষোভ ব্যক্ত করেছে। এই পরিস্থিতিতে তপন রায়চৌধুরী অন্য কমরেডদের নিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। আমি তখন হাঁপানিতে ধুঁকছি। আমাকে টেনে নিয়ে গেলেন ডেলিগেটদের পরিস্থিতি বুঝিয়ে শান্ত করাতে। এসব ভোলা যায় না।
আমাদের দলের নেতৃত্বে কংগ্রেস ও সিপিএম শাসনে বহু গণআন্দোলন হয়েছে, লাঠি-গুলি চলেছে, রক্ত ঝরেছে, রাজপথ রক্তাক্ত হয়েছে। এসব আন্দোলনে ভলান্টিয়ারের দায়িত্বে ছিলেন কমরেড তপন রায়চৌধুরী। ১৯৯০ সালের ৩১ আগস্ট কিশোর কমরেড মাধাই হালদার গুলিবিদ্ধ হয়ে রানি রাসমণি অ্যাভিনিউয়ে প্রাণ হারান, আরও ৩২ জন গুলিবিদ্ধ হন। কাকে কোন হাসপাতালে পাঠাতে হবে, কী করতে হবে, সেখানেও ছিল কমরেড তপন রায়চৌধুরীর দৃঢ় ভূমিকা। যখন ঝঞ্ঝাট-দুর্যোগ নানা অসুবিধা– তখন মাথা ঠাণ্ডা রেখে কী ভাবে কাজ করতে হয়, সেটা তিনি জানতেন। দক্ষতার সাথে এটা করতেন। আবার এ কথা অনেকে জানেন না, ১৯৮৭ সালে তমলুকে দলের রাজ্য সম্মেলনে যখন রাজ্য কমিটিতে তাঁর নাম নির্বাচিত হয়, সে সময় আমি সম্পাদক হলেও হাঁপানির জন্য দু’দিন সম্মেলনে থাকতেই পারিনি। সে অবস্থায় কনফারেন্স শেষ করে আমার ঘরে এসে তাঁর প্রবল কান্না। বললেন, আমার কী যোগ্যতা যে আমাকে রাজ্য কমিটিতে নেওয়া হল? আমি বলি, তুমি তো জান তোমার যোগ্যতা আছে জেনেই নেতৃত্ব তোমার নাম সুপারিশ করেছেন, প্রতিনিধিরা সমর্থন করেছেন। তুমি আরও বেশি যোগ্যতার সাথে দায়িত্ব পালন কর। একই কথা কমরেড সৌমেন বসু তুলেছিলেন, কান্নাকাটি করেছিলেন। আমি তাঁকে কনভিন্স করতে পারিনি। শেষ পর্যন্ত তাঁকে কমরেড নীহার মুখার্জীর কাছে পাঠাই।
এখানে আমি আর একটা ঘটনা বলতে চাই। আমাদের দল পরিচালিত ঐতিহাসিক ভাষা-শিক্ষা আন্দোলনে সেই সময়ের পশ্চিমবাংলার প্রথিতযশা বহু ব্যক্তিত্ব সামনের সারিতে এসেছিলেন। ছিলেন ডঃ সুকুমার সেন, ডঃ সুশীল মুখার্জী, প্রমথনাথ বিশি, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সন্তোষ ঘোষ, প্রতুল গুপ্ত, রবীন্দ্রনাথ গুপ্ত, ডঃ নীহার রঞ্জন রায়, শৈলেশ দে সহ আরও অনেকে। এ ক্ষেত্রে প্রয়াত কমরেড নীহার মুখার্জীর গাইডেন্সে কমরেড মানিক মুখার্জী একটা গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছিলেন। এই শিক্ষা আন্দোলন ছিল মূলত প্রাথমিক স্তরে ইংরেজি ভাষা চালু এবং পাশ-ফেল প্রথা পুনঃপ্রবর্তনের দাবিতে। কমরেড মানিক মুখার্জীর পাশাপাশি তপন রায়চৌধুরীও শিক্ষক সমাজকে সামিল করিয়েছিলেন এবং এই আন্দোলনের একটা পর্যায়ে শিক্ষাবিদদের অবস্থান, আইন অমান্য, তারপর ছাত্র-যুবক-কিশোরদের অবস্থান, প্রাথমিক স্কুল ছাত্রদের অবস্থানের কর্মসূচি, শ্রমিক দিবস, কৃষক দিবস, মহিলা দিবস, ছাত্র-যুব দিবস এই সব বহু কর্মসূচি সংগঠিত করা হয়। সকলেরই স্মরণ আছে এই আন্দোলনের চাপেই শেষ পর্যন্ত সিপিএম সরকার প্রাথমিকে ইংরেজি শিক্ষা চালু করতে বাধ্য হয়। এই আন্দোলনের নানা কর্মসূচি রূপায়ণের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন তপন রায়চৌধুরী। তাঁর কাজকর্ম, দায়িত্ব পালনের মধ্যে আর একটা বৈশিষ্ট্য ছিল– সব কিছু করতেন নীরবে নিঃশব্দে। উনি যে শিক্ষক আন্দোলনের এত বড় একজন নেতা, এটা বাইরে থেকে বোঝার কোনও উপায় ছিল না। তিনি যখন পার্টির নেতৃত্বে এসেছেন, আমি নেতা– এই ভাবটা তাঁর চলন বলন আচরণে কোথাও ছিল না। নেতা, কিন্তু নেতা-নেতা ভাব কথাবার্তায়, চালচলনে নেই, এই চরিত্র অর্জন করা সহজ নয়। ছোট বড় সকলের সাথেই তাঁর আচরণ ছিল বন্ধুর মতো, সকলেই অতি সহজে মন খুলে তাঁকে সব বলতে পারত। নির্দ্বিধায় তাঁর সমালোচনা করতে পারত। ছোটদের থেকেও গ্রহণ করতে পারতেন, কোনও বিরূপ প্রতিক্রিয়া থাকত না। বয়সে বড়দের মান্যতা দিয়ে কথা বলতেন। কারও যখন ভুল ধরিয়ে দিতেন বা সমালোচনা করতেন, তার মধ্যে এমন সহজ সাবলীল, দরদি আবেদন থাকত যে, সেই কমরেড খুশিমনে গ্রহণ করতে পারত, আহত বোধ করত না। ‘আমি কত কিছু করছি, কত লোক আমাকে কী কী প্রশংসা করেছে’– এইসব তাঁর মধ্যে ছিল না। ছোটদের খুব উৎসাহিত করতেন, গুণাবলির প্রশংসা করতেন। কারও মুখ ভার, কোনও ব্যথা নিয়ে বসে আছে, দেখলেই নিজে উদ্যোগী হয়ে সব শুনে মন ঠিক করে দিতেন বা নেতৃত্বকে জানাতেন। কমরেড তপনের মধ্যে এতটুকু আত্মম্ভরিতা, অহমিকা আমি দেখিনি, আত্মপ্রচারের প্রশ্নই ওঠে না। কোথাও একটু প্রশংসা করেছি শুনলে লজ্জা পেতেন। অনেক সময় তো এমন হয় যে, আমরা কারও উপর রেগে গেছি, কিন্তু রাগ কন্ট্রোল করছি, বাইরে প্রকাশ করিনি, এটা এক রকম। আর একটা হচ্ছে আমার রাগই হয়নি। দুটোর মধ্যে পার্থক্য আছে তো? ও হচ্ছে দ্বিতীয় দলের। ওর আচরণগুলি এমনই ছিল– রুচি সংস্কৃতিটা অত্যন্ত সহজ সরল সাবলীল ভাবে প্রবাহিত হত, অপরের ওপর তার প্রভাব ফেলত। কমরেড সৌমেন বয়সে ওঁর থেকে ছোট, তিনি যখন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সেক্রেটারি, তাঁকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে গ্রহণ করেছিলেন। ওঁকে খুব ভালোবাসতেন। বন্ধুত্বের সম্পর্কও ছিল। তৎকালীন রাজ্য কমিটিতে আমি যতটুকু লক্ষ করেছি, কমরেড সৌমেন বোসের ডান হাত বলতে যা বোঝায় তা ছিলেন কমরেড তপন। বহু বিষয়ে ওঁকে সাহায্য করতেন, সেটাও বোঝার কোনও উপায় ছিল না।
আরেকটা জিনিসও তাঁর ছিল– মিটিংয়ে তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে, উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হচ্ছে, পরিবেশ গুরুগম্ভীর, গুমোট ভাব, সেই সময় অত্যন্ত সুন্দর উইট-হিউমার করে পরিবেশটাকে সহজ স্বাভাবিক করতে পারতেন। কিন্তু হালকা ছিলেন না। খুব সুন্দর রসিকতা করতে জানতেন। আমি আজ পর্যন্ত কোনও কমরেডকে পাইনি যে কমরেড রায়চৌধুরী সম্পর্কে কোনও অভিযোগ নিয়ে এসেছে। অনেক নেতা সম্পর্কে অভিযোগ নিয়ে অনেকেই আসে। অন্য দিক থেকে ওঁকেও দেখিনি কারও সম্পর্কে অভিযোগ নিয়ে আমার কাছে আসতে। এটা আমি জানি– কোনও কোনও নেতা ভুল রিপোর্ট শুনে তাঁকে অযৌক্তিকভাবে সমালোচনা করেছেন। পাল্টা কোনও উত্তর দেননি, কাউকে জানানওনি, সহ্য করেছেন নীরবে। বাইরে কোনও কিছু প্রকাশ করেননি। কিছু কর্মী, তাঁরা অনেকেই প্রয়াত, একজন পার্টিবিরোধী হয়ে এখন কুরুচিকর আচরণ করছেন, এঁরা একসময় ঈর্ষা থেকে তাঁর সম্পর্কে অনেক নোংরা কথা বলেছেন। একজন কমরেড তাঁকে বলেছেন, আপনার সম্পর্কে নোংরা কথা বলেছে। উত্তরে তপন বলেছেন, এসবে কান দিচ্ছ কেন? এইসব নিয়ে পাল্টা কোনও দিন কোনও মন্তব্য করেননি। ওদের সাথেও পাল্টা খারাপ ব্যবহার করেননি। সংস্কৃতির কিছু সুর অত্যন্ত বিস্ময়করভাবে আয়ত্ত্ব করেছিলেন কমরেড তপন। আমি মনে করি কমরেড শিবদাস ঘোষের সাথে তাঁর যে সংযোগ স্থাপন হয়েছিল, অনেক আলাপ আলোচনা হয়েছিল, তাঁকে ঘনিষ্ঠভাবে দেখার সুযোগ হয়েছিল, তারই একটা সুদূর প্রসারী প্রভাব থেকেই এসব আয়ত্ত্ব করেছিলেন। আবার কমরেড শিবদাস ঘোষের সাথে যাঁরাই ঘনিষ্ঠভাবে ছিলেন, এমনকি দীর্ঘদিন ছিলেন, তাঁরা কি সবাই এভাবে শিখতে পেরেছিলেন? কেউ পেরেছিলেন, কেউ পারেননি। এখানেই অন্তর্দ্বন্দ্বের বিশেষ ভূমিকা– আমি কতটা, কী ভাবে গ্রহণ করছি, নিজেকে পাল্টাচ্ছি, অথবা পাল্টাচ্ছি না। কেউ বহুদিন বড় নেতাদের কাছে থেকে, অনেক কথা শুনেও নিজেকে পাল্টাতে পারে না, শিখতে পারে না। আবার কেউ দূর থেকে বক্তব্য শুনে, পড়ে বা অল্পদিন কাছে থেকে অনেকটা পাল্টায়, এগিয়ে যায়।
আমাকে তপন খুব ভালোবাসতেন, শ্রদ্ধা করতেন। আমি কী চাই, আমি বিশেষ কিছু না বললেও বুঝতে পারতেন, সেইভাবে চেষ্টা করতেন, বেশি বলতে হত না। কোনও মিটিংয়ে আমি বত্তৃতা দেওয়ার সময় ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে, আমি দেখতাম পাশে দাঁড়িয়ে উদ্বেগের সাথে খেয়াল রাখছেন, যাতে বৃষ্টি আমার গায়ে না পড়ে। যখন যা তাঁকে করতে বলেছি, পারব না এ কথা কখনওই উচ্চারণ করেননি। বা কী করে পারব, এই অসুবিধা, ওই অসুবিধা কখনও বলেননি। শুধু আমি পারব কি– এ কথা জিজ্ঞাসা করতেন। যখন বলা হত তুমি পারবে, আর দ্বিতীয়বার কোনও আলোচনা করতেন না। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনেও তাঁর বলিষ্ঠ ভূমিকা ছিল। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনে সিপিএম সরকারের গণহত্যা ও গণধর্ষণের প্রতিবাদে শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের একটা ঐতিহাসিক মিছিল হয়েছিল কলকাতায়। নন্দীগ্রামে যখন ধর্ষণ-গুলিবর্ষণ হয়, গোটা বাংলা তখন প্রতিবাদে গর্জে উঠেছিল। এই মিছিলের নেপথ্যে ভূমিকা ছিল কমরেড তপন রায়চৌধুরীর। এর মধ্য দিয়েই বিশিষ্ট বামপন্থী কবি, শিক্ষাবিদ প্রয়াত তরুণ স্যানালের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে শিল্পী-সাংস্কৃতিক কর্মী ও বুদ্ধিজীবী মঞ্চ। অনেক নাট্যকার, আইনবিদ, শিক্ষাবিদ এতে সামিল হয়েছিলেন। সে মঞ্চ আজও আছে, গণতান্ত্রিক আন্দোলনে, সাংস্কৃতিক আন্দোলনে ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। এই মঞ্চ গঠনের ক্ষেত্রেও নেপথ্যে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
কমরেড তপন রায়চৌধুরী শুধু মাধ্যমিক শিক্ষকদের নয়, পার্টির পক্ষ থেকে প্রাথমিক ও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সংগঠন পরিচালনার দায়িত্বেও ছিলেন। প্রাথমিকে বেসরকারি বৃত্তি পরীক্ষা পরিচালনার সংগঠনে, কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতাল পরিচালনার সংগঠনেও তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। যখন শিক্ষক নেতা হিসাবে শিক্ষক আন্দোলনে প্রতিষ্ঠিত, রাজ্য কমিটিতেও একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছেন এবং শিল্পী-সাংস্কৃতিক কর্মী-বুদ্ধিজীবী মঞ্চে এ রকম একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছেন, সে সময় পার্টি থেকে তাঁকে বলা হল, তুমি দক্ষিণ ২৪ পরগণায় যাও। সেখানে তখন পার্টির নানা সমস্যা হচ্ছে। ওখানকার পার্টির স্তম্ভস্বরূপ জেলা সম্পাদক কমরেড ইয়াকুব পৈলান অসুস্থ। সিপিএমের ক্রিমিনাল বাহিনীর আক্রমণে আর এক বিশিষ্ট নেতা কমরেড আমির আলি হালদার খুন হয়েছেন। বহু নেতা-কর্মী খুন হয়ে গেছেন। বহু অঞ্চলের নেতা খুন হয়ে গেছেন। মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে অনেককে কারারুদ্ধ করা হয়েছে। এই অবস্থায় তাঁকে বলা হল, তুমি এখন মূলত দক্ষিণ ২৪ পরগণাতে থাকো। একবারও বলেননি, শিক্ষক আন্দোলনের কী হবে বা এখানকার কাজগুলোর কী হবে। দক্ষিণ ২৪ পরগণা ছিল তাঁর কাছে অপরিচিত। এর আগে তিনি সেখানে কাজ করেননি। ওখানে গিয়ে তপন ধীরে ধীরে ওখানকার মাটি বোঝেন। ওটা পার্টির একটা গণভিত্তির জায়গা, আবার সাংগঠনিক বহু সমস্যাও আছে। আর আক্রমণের পর আক্রমণে বিধ্বস্ত দক্ষিণ ২৪ পরগণা পার্টির অনেকটা নেতাহীন অবস্থা। এই অবস্থায় তিনি সেখানে গেলেন এবং ধীরে ধীরে সংগঠনের সাথে যুক্ত হলেন। কর্মী এবং সমর্থকদের হৃদয় জয় করলেন। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন– এটা সকলেই জানেন, কমরেড দেবপ্রসাদ সরকার অত্যন্ত সৎ নির্মল চরিত্রের মানুষ হিসাবে সর্বজন শ্রদ্ধেয়। কিন্তু দক্ষিণ ২৪ পরগনার জনগণ তাঁকে সংগঠক হিসাবে পায়নি। পৈলান সাহেব অসুস্থ হয়ে ২০১৪ সালে মারা যান। তখন দেবপ্রসাদ সরকার জেলা সম্পাদক হিসাবে নির্বাচিত হন। কিন্তু তিনি এর আগে সংগঠক হিসাবে কোনও দিন কাজ করেননি। এই কমরেড দেবপ্রসাদ সরকারকে সাহচর্য দিয়ে তিনি ধীরে ধীরে সাংগঠনিক কাজে ইনভলভ করান এবং কমরেড দেবপ্রসাদ সরকার দক্ষিণ ২৪ পরগণায় গুরুত্বপূর্ণ সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন।
আবার কমরেড দেবপ্রসাদ সরকার মাঝে মাঝে অসুস্থ হতেন। তাঁর চিকিৎসা করানো, তাঁর সেবাযত্নের ব্যবস্থা করা, এসব করতেন কমরেড তপন রায়চৌধুরী। দু’জনের বন্ধুত্বও ছিল গভীর। এই জায়গায় কমরেড তপন রায়চৌধুরী অসাধারণ একটা ভূমিকা পালন করেছেন। পৈলান সাহেবের মৃত্যুর পর এলাকাগুলি কিছুটা ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গিয়েছিল। উনি যেভাবে যোগাযোগ রাখতেন, তা ধরে রাখার কেউ নেই। জনগণ আছে, কর্মী আছে, কিন্তু অনেকটা বিচ্ছিন্ন অবস্থায়। এই বিচ্ছিন্ন সংগঠনগুলিকে একত্রিত করা, কমরেড দেবপ্রসাদ সরকারকে নিয়ে এই দুরূহ কাজটা তিনি করেছিলেন। কমরেড ইয়াকুব পৈলান অদ্বিতীয় নেতা ছিলেন। তিনি নির্দেশ দিতেন, বাকিরা কাজ করত, এইভাবে মূলত কাজ হত। কমরেড তপন রায়চৌধুরী ওখানে গিয়ে নেতৃস্থানীয় সংগঠকদের নিয়ে আলাপ আলোচনার ভিত্তিতে যৌথ সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়া চালু করেন। আজও সেটা চলছে। রাজনৈতিক ক্লাস, আলাপ-আলোচনা এগুলো তিনি আরও ভালভাবে চালু করেন। ওখানকার অফিস সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চলে। জনগণের অফিস, কিন্তু অত্যন্ত অগোছালো ছিল। সে অফিসকে সুশৃঙ্খল করার ক্ষেত্রে তপন রায়চৌধুরী একটা ভূমিকা নেন। আবার বিভিন্ন অঞ্চলের জটিল সমস্যা, কর্মীদের মতানৈক্য, মতভেদ, ভুল বোঝাবুঝি, যেগুলো অনেক সময় সংগঠনে হয়, সেগুলি ধৈর্যের সাথে সমাধান করেছেন। গণভিত্তিক সংগঠন হলে তো আরও সমস্যা হয়। সে সব ক্ষেত্রে ছুটে গেছেন। থাকতেন এলাকায়, মাসের পর মাস দক্ষিণ ২৪ পরগনায় কাটিয়েছেন। দু-একটা বত্তৃতা দিয়ে চলে এসেছেন, তা নয়। কমরেড দেবপ্রসাদ সরকারের পাশের ঘরে থাকতেন ও সংগঠন দেখতেন।
আগে তপন রায়চৌধুরী গণসংগঠনের নেতা ছিলেন, পার্টি সংগঠন করেননি। গণসংগঠন ও পাটি সংগঠনের কর্মপদ্ধতি এক নয়। গণসংগঠনে এক ধরনের ডেমোক্রেটিক ফাংশনিং, এক ধরনের কর্মপদ্ধতি থাকে, সেটা তিনি শিখেছেন, করেছেন। কিন্তু পার্টি সংগঠনের কাজ ভিন্ন ধরনের। পার্টি সংগঠনে সর্বহারা গণতন্ত্র, পার্টি দৃষ্টিভঙ্গি, পার্টি সংস্কৃতি, পার্টির যৌথ প্রক্রিয়া– এই দিকগুলো দ্রুত আয়ত্ত করতে এবং প্রয়োগ করতে তাঁর কিন্তু বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয়নি।
প্রথম জীবনে পরিবারের সাথে কমরেড তপনের আপস ছিল, এই আপসের বন্ধনগুলো একটু একটু করে ছিন্ন করে ক্রমাগত এগিয়েছেন। এগিয়ে পার্টির সাথে একাত্ম হওয়ার, বিপ্লবের সাথে একাত্ম হওয়ার সংগ্রামে একটা অগ্রণী জায়গায় পৌঁছেছেন। যার ফলেই তৃতীয় পার্টি কংগ্রেসের প্রাক্কালে স্টাফ মেম্বারশিপ পেয়েছিলেন। বাড়ি ছেড়ে পার্টি সেন্টারে শেষ জীবনে দীর্ঘ দিন কাটিয়েছেন।
একটা কথা বলতে চাই, আমরা কেউই সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত নই। কমরেড শিবদাস ঘোষ বলতেন, সকলেই দোষে গুণে মানুষ, স্তর ভেদে গুণ-দোষের পার্থক্য থাকে। কমরেড তপন রায়চৌধুরীরও ত্রুটি ছিল, সেটা এখানে আলোচ্য বিষয় নয়। কিন্তু তপন রায়চৌধুরী ক্রমাগত নিজেকে ত্রুটিমুক্ত করে এগোচ্ছিলেন। এই শিবপুর সেন্টারে যাঁরা বসে আছেন, আমি জানি প্রত্যেকের বুকে তাঁর প্রভাব আছে। কারণ শেষজীবন এখানেই কাটিয়েছেন। এটা ভাল লক্ষণ যে, এ রাজ্যে এবং অন্য রাজ্যেও কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষায় আকৃষ্ট হয়ে নতুন করে বহু শিক্ষক, অধ্যাপক, ডাক্তার, বিজ্ঞানী, শ্রমিক, কৃষক, বিশেষভাবে ছাত্র-যুবক দলের সাথে যুক্ত হচ্ছেন। এর একটা বিরাট অংশ কমরেড তপন রায়চৌধুরীর সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হওয়ার সুযোগ পাননি। ফলে এই বক্তব্য থেকে তাঁরা কিছুটা তাঁকে জানতে, বুঝতে পারবেন, শিখতে পারবেন।
আরেকটা ঘটনা না বললে আমার বক্তব্য অসম্পূর্ণ থাকবে। আমি তখন রাজ্য সম্পাদক, টালিগঞ্জ সেন্টারে থাকি। হঠাৎ একদিন কমরেড কৃষ্ণা সেন আমার কাছে উপস্থিত, তপন পাঠিয়েছেন তাঁকে। বললেন, আমরা দুজনে মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমাদের মেয়েকে আপনার কাছে পাঠাব, আপনি ওকে মানুষ করবেন। আমার জীবনে এরকম ঘটনা ঘটেনি– কোনও বাবা-মা একমাত্র সন্তানকে পার্টির হাতে তুলে দেওয়ার প্রস্তাব দিচ্ছেন। দলের প্রতি কত আস্থা, সন্তানকে বিপ্লবী হিসাবে গড়ে তোলার কত ঐকান্তিক আকাঙক্ষা! তার মানে এই কথা বলতে চাই না যে, এমন কোনও কমরেড নেই, যার মনের মধ্যে এইরকম ইচ্ছা নেই। আমি রাজি হতে পারিনি। আমি বলেছি, দেখ এখানে যারা থাকে তারা সব যোগমায়াদেবী কলেজের ছাত্রী। আর ছেলে কমরেড কিছু থাকে, তারাও অনভিজ্ঞ। এরা সকালে বেরিয়ে যায়, রাত্রে ফেরে। বয়স্ক কেউ যদি থাকতেন তাহলে সেটা সম্ভব হত। ওঁদের খুব আশা ছিল, মেয়ে দলের ভাল কর্মী হোক এবং আমার সাহায্য নিয়ে হোক। আমি সেদিন সম্মত হতে পারিনি। যদিও আমি শুনেছি ওদের কন্যা দলের খুব ভাল সমর্থক এবং চরিত্রের দিক থেকে খুব ভাল। কমরেডদের কাছ থেকে শুনেছি, বাবার প্রতি শ্রদ্ধাশীল, মায়ের প্রতি দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে।
এ কথা আমি বলতে পারি, কমরেড তপন রায়চৌধুরী খুবই বিরল গুণের অধিকারী ছিলেন। আমি কমরেডদের বলব, সমস্ত স্তরের নেতা-কর্মী বিশেষত নবাগতদের বলব, কমরেড তপন রায়চৌধুরী যে ভাবে সংগ্রাম করে ধীরে ধীরে পারিবারিক জীবন থেকে নিজেকে মুক্ত করে পার্টির সাথে একাত্ম হওয়ার সংগ্রামে এগিয়েছিলেন, বিভিন্ন দুরূহ দায়িত্ব পালন করেছেন, চিন্তা-ভাবনা-রুচিতে-সংস্কৃতিতে ক্রমাগত অগ্রগতি অর্জন করেছেন– এসবের থেকে শিক্ষা গ্রহণ করুন। আমি মনে করি এটাই তাঁকে যথার্থ স্মরণ করা, শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করা।
কমরেড তপন রায়চৌধুরী লাল সেলাম