এবারের কেন্দ্রীয় বাজেট জনমুখী, না কর্পোরেটপন্থী? বাজেটে স্বাস্থ্যখাতে যে টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে তার দ্বারা কি জনগণের চিকিৎসার খরচ মিটবে, না কি চিকিৎসা ব্যবসায়ীদের সুযোগ করে দেওয়াই তার উদ্দেশ্য?
করোনার প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ঢেউয়ে স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর অভাবে যেভাবে হাজারে হাজারে মানুষ কার্যত বিনা চিকিৎসায়, বিনা অক্সিজেনে মারা গেল, তার থেকে শিক্ষা নিয়ে যে ধরনের জনমুখী স্বাস্থ্য বাজেট প্রয়োজন ছিল, এবারের স্বাস্থ্য বাজেটে তার ছিটেফোঁটা প্রতিফলনও দেখা গেল না। অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়, স্বাস্থ্যক্ষেত্রের বুনিয়াদি জায়গা থেকে বাজেট বরাদ্দ ছাঁটাই করে অর্ধেক করে দেওয়া হয়েছে। তা হলে চিকিৎসা হবে কী দিয়ে? এই স্বাস্থ্য বাজেটে কার্পণ্য কি সরকারের অর্থের অভাবের জন্য? তা হলে প্রতিরক্ষা খাতে ৫.২৫ লক্ষ কোটি টাকা বরাদ্দ হল কী ভাবে যা মূল বাজেটের ১৩.৪ শতাংশ? স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ করা হয়েছে মাত্র ২.২৬ শতাংশ যা গতবারের বরাদ্দ ৩.৩৭ শতাংশের থেকেও অনেক কম। ২০১৭-র তৃতীয় জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি যেখানে বলছে ২০২৫ সালের মধ্যে স্বাস্থ্যখাতে জিডিপির ২.৫ শতাংশ বাজেট বরাদ্দ করতে হবে, সেখানে এবছর সর্বসাকুল্যে দাঁড়িয়েছে জিডিপির মাত্র ০.৩৪ শতাংশ। এর দ্বারা কি দেশের ১৪০ কোটি মানুষের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সম্ভব?
অর্থমন্ত্রী স্বাস্থ্য বাজেট পেশ করে সগর্বে ঘোষণা করলেন, গত বছরের তুলনায় স্বাস্থ্যক্ষেত্রে ব্যয়বরাদ্দ ১৬ শতাংশ বৃদ্ধি করা হল। ঘোষণা শুনে মনে হতে পারে, এ তো অনেক বৃদ্ধি! কিন্তু সত্যিই কি এতটা বেড়েছে? না কি হিসাবে জল মেশানো আছে! সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী গত বছর স্বাস্থ্য বাজেট ছিল ৭৩ হাজার ৯৩১ কোটি টাকা, সেখানে এ বছরে সমগ্র স্বাস্থ্যক্ষেত্রের জন্য বরাদ্দ করা হল ৮৬২০০.৬৫ কোটি টাকা। যা অঙ্কের হিসাবে গত বারের প্রাথমিক বরাদ্দের চেয়ে ১৬ শতাংশ বেশি। কিন্তু এখানে যে গোঁজামিল রয়েছে তা সরকার গোপন করে গেল। গত বছর জনমতের চাপে স্বাস্থ্য বাজেট সংশোধিত করে ধার্য করা হয়েছিল ৮৬০০০.৬৫ কোটি টাকা। এবার তার থেকে মাত্র ২০০ কোটি টাকা বাড়ানো হয়েছে। শতাংশে বৃদ্ধি মাত্র ০.২৩ শতাংশ। যার মধ্যে অঙ্গনওয়াড়ি, পুষ্টি, স্যানিটেশন, আয়ুষ্মান ভারত, স্বাস্থ্যের ডিজিটালাইজেশন এবং নানা কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার খরচকেও ধরা হয়েছে। অথচ এর বেশিরভাগটাই অন্য ক্ষেত্রের বিষয়!
এবারের বাজেটে মেডিকেল ও পাবলিক হেলথ খাতে বরাদ্দ ভীষণ ভাবে কমানো হয়েছে। গত বছর এই খাতে বরাদ্দ ছিল ৭৪ হাজার ৮২০ কোটি টাকা। এ বছর তা দাঁড়িয়েছে মাত্র ৪১ হাজার ০১১ কোটি টাকা। অর্থাৎ স্বাস্থ্যক্ষেত্রের মূল বুনিয়াদি জায়গায় বরাদ্দ ৪৫ শতাংশ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। অর্ধেকের কাছাকাছি করা হয়েছে (৪৫.১৯ শতাংশ কমানো হল)। এর ফলে হাসপাতালে বিনা পয়সায় চিকিৎসা পাওয়ার এখনও যতটুকু সুযোগ আছে তা বন্ধ হবে। মার খাবে কিউরেটিভ অর্থাৎ হাসপাতাল বেড, পরিকাঠামো নির্মাণ এবং প্রিভেন্টিভ অর্থাৎ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার জন্য তৈরির কর্মসূচি।
এছাড়াও কেন্দ্রীয় ভাবে গৃহীত যেসব প্রোগ্রাম বিভিন্ন রাজ্যে পরিচালিত হয়, সেখানেও বাজেট ভীষণভাবে কমানো হয়েছে। এই খাতে গত বছর বরাদ্দ ছিল ৫০ হাজার ৫৯১ কোটি টাকা, এ বছর কমিয়ে তা করা হল ৪৭ হাজার ৬৩৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ এই খাতেও কমানো হলো ৫.৯ শতাংশ। এই অর্থ দিয়ে মূলত মাতৃস্বাস্থ্য, শিশু স্বাস্থ্য থেকে শুরু করে টিবি, ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু সহ সমস্ত প্রতিরোধযোগ্য রোগের বিরুদ্ধে প্রোগ্রামগুলি পরিচালিত হয়। করোনা অতিমারির মধ্যে করোনা বহির্ভূত সমস্ত স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং জনস্বাস্থ্য প্রোগ্রামগুলি ভীষণভাবে মার খেয়েছে। ফলে যক্ষ্মা এবং ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট টিবি যাতে মৃত্যুহার প্রায় একশো শতাংশের কাছাকাছি তা বেড়ে গেছে ইতিমধ্যেই। বাড়ছে শিশু মৃত্যু ও মাতৃমৃত্যুর সংখ্যা। সামগ্রিকভাবে মৃত্যুর হারও বাড়ছে। ইতিমধ্যে হাসপাতালের বেশিরভাগ বেড করোনা বেডে পরিণত করার ফলে অ-করোনা রোগীর মৃত্যুর হার দ্রুত গতিতে বাড়ছে। এই পরিস্থিতিতে মানুষের প্রত্যাশা ছিল করোনা পরবর্তী পরিস্থিতিতে এই খাতে ব্যয়বরাদ্দ উল্লেখযোগ্য ভাবে বাড়ানো হবে। অথচ বিজেপি সরকার করলো ঠিক তার উল্টো।
গত বছর স্বাস্থ্য বাজেটে অতিরিক্ত ৩৯ হাজার ০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল কোভিড টিকাকরণের জন্য। এ বছর কমিয়ে তা করা হয়েছে মাত্র ৫০ হাজার কোটি টাকা। বাকি ৩৪ হাজার কোটি টাকা কিন্তু স্বাস্থে্যর কোনও বিষয়ে এমনকি করোনা সংক্রান্ত কোনও বিষয়েও বরাদ্দ করা হল না, অর্থাৎ এ ক্ষেত্রেও বরাদ্দ কমানো হল ৩৪০০০ কোটি টাকা যা মূল বাজেটের ৪০ শতাংশ, যখন করোনা বিধ্বস্ত স্বাস্থ্যক্ষেত্রে কেবল প্রলেপ লাগাতে এর বহুগুণ টাকা প্রয়োজন ছিল!
এবছর সক্ষম অঙ্গনওয়াড়ি এবং প্রধানমন্ত্রীর হলিস্টিক পুষ্টি প্রকল্প বা পোষণ (POSHAN) বাবদ বরাদ্দ করা হয়েছে ২০ হাজার ২৬৩ কোটি। দেশ জোড়া অপুষ্টি যেখানে বাড়ছে, এইখাতেও সেখানে বাড়ানো হয়েছে মাত্র ৩.১ শতাংশ। আয়ুষ্মান ভারত আরোগ্য যোজনা খাতে বরাদ্দ করা হয়েছে ১০ হাজার ২৩৪ কোটি।
বিভিন্ন কেন্দ্রীয় প্রকল্পে ১৫১৬৩.২২ কোটি। প্রধানমন্ত্রী স্বাস্থ্য সুরক্ষা যোজনা বাবদ ১০ হাজার কোটি। ন্যাশনাল ডিজিটাল হেলথ মিশন বাবদ ২০০ কোটি টাকা। এ ছাড়াও জোর দেওয়া হয়েছে টেলিমেন্টাল হেলথ সার্ভিসের উপর।
মোদি সরকার ন্যাশনাল ডিজিটাল হেলথ মিশনের মাধ্যমে গোটা স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকেই ডিজিটালাইজড করার চেষ্টা করছে। চালু হচ্ছে প্রতিটি রোগীর জন্য ইউনিক আই ডি। প্রত্যেক পরিষেবা দাতা এবং স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের ডিজিটাল রেজিস্ট্রেশন তৈরি করা হবে। অর্থাৎ এই বাজেটে সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্য পরিষেবাকে ডিজিটালাইজড করার জন্য এবং বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে কেন্দ্রীয়ভাবে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্যই বেশিরভাগ ব্যয় বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যথার্থ স্বাস্থ্য পরিষেবা সেখানে ভীষণভাবে উপেক্ষিত হয়েছে।
এই বাজেটের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকার কার্যত ২০১৭ সালের তৃতীয় জাতীয় স্বাস্থ্যনীতির রূপায়ণকে সম্পূর্ণ করতেই বেশি সচেষ্ট। সরকার সমগ্র স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে ইউনিভার্সাল হেলথ কভারেজের নামে পুরোপুরি বিমানির্ভর ও কর্পোরেটমুখী করতে চাইছে। আর এই সার্বিক বিমানির্ভর স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য চাই স্বাস্থে্যর ডিজিটালাইজেশন। তার জন্যেই আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্পের উপর এতটা জোর দেওয়া হয়েছে। আয়ুষ্মান ভারত কিংবা পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসাথী এসবই হল স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে বিমানির্ভর ও কর্পোরেটমুখী করে তোলার পদক্ষেপ। বর্তমান স্বাস্থ্য বাজেটে ব্যয় বরাদ্দে তারই প্রতিফলন ঘটেছে। জনগণের ট্যাক্সের টাকা দিয়ে তৈরি বাজেটে জনসাধারণের মৌলিক প্রয়োজনগুলিকে ছাঁটাই করে বিমামুখী ও কর্পোরেটমুখী ব্যয়বরাদ্দ বহুগুণে বাড়ানো হল। ফলে এর মধ্য দিয়ে জনগণের স্বাস্থে্যর অধিকার ও সুযোগ যতটুকু ছিল তাও বহুগুণে সংকুচিত হবে। জনস্বাস্থ্য নয়, এই বাজেট কর্পোরেট স্বাস্থ্য ব্যবসায়ী ও বিমা ব্যবসায়ীদের অধিক মুনাফাকেই সুনিশ্চিত করবে।