প্রতিবারের মতোই গালভরা প্রতিশ্রুতি নিয়ে বাজেট পেশ হল। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে অর্থমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন– টিবি হারেগা, দেশ জিতেগা। অর্থাৎ ২০২৫ সালের মধ্যে দেশ থেকে ক্ষয়রোগ (টিবি) তাঁরা নির্মূল করবেন। কিন্তু কীভাবে?
স্বাস্থ্যখাতে এ বছর বাজেটে বরাদ্দ হয়েছে ৬৯ হাজার কোটি টাকা। এমনিতে দেখলে তা গত বছরের তুলনায় ৩.৯ শতাংশ বেশি। অথচ খোদ সরকারের নীতি আয়োগ গত বছর সুপারিশ করেছিল ২০২৫ সালের মধ্যে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপির অন্তত ২.৫ শতাংশ স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ করতেই হবে। কিন্তু এবছর স্বাস্থ্য বাজেট জিডিপি-র মাত্র ১ শতাংশ। মূল্যবৃদ্ধি ধরলে আসলে বাজেট সংকোচন হয়েছে। অর্থাৎ বিজেপি সরকার স্বাস্থ্যব্যবস্থার হাত-পা বেঁধে দিয়ে সামনে ছুটে যাওয়ার স্বপ্ন দেখাচ্ছে। এই পরিসংখ্যান দেখলে আমাদের চেয়ে পিছিয়ে পড়া প্রতিবেশীদের (শ্রীলঙ্কা জিডিপি-র ২ শতাংশ, থাইল্যান্ড ৩.৬ শতাংশ) থেকেও আমাদের মুখ লুকোতে হয়।
প্রধানমন্ত্রী জন আরোগ্য যোজনার পিছনে ৬ হাজার কোটি টাকা ঢালার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ২০,০০০ হাসপাতালকে প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসার এবং ২০২৪ সালের মধ্যে দেশজুড়ে জনওষধি প্রকল্প চালু করার। প্রথমেই যে কথা বলে রাখা দরকার, এরকম ‘জুমলা’ (মন ভোলানো কথা) বিজেপির প্রথম নয়। ২০১৭ সালের বাজেটেও একই প্রতিশ্রুতি ছিল– প্রাথমিক স্তর পর্যন্ত বিনা খরচায় ওষুধপত্র দেওয়া, নিখরচায় পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা, সারা দেশে হেলথ অ্যান্ড ওয়েলনেস সেন্টার গড়ে তোলা। রয়টার্সের রিপোর্ট বলছে, যখন প্রকল্পগুলি বাস্তবায়নের জন্য স্বাস্থ্যমন্ত্রক অর্থ চাইতে গেল, অর্থমন্ত্রক তার বেশির ভাগটাই নাকচ করে দিল। ফলে জুমলা ফাঁস। এ বছরেও যে তার অন্যথা হবে না, সে কথা হাঁড়ির হাল দেখলেই বোঝা যায়। তা হলে ক্ষয়রোগ নির্মূল হবে কী করে?
সরকার বুক ফুলিয়ে ঘোষণা করেছে, দেশের দ্বিতীয় ও তৃতীয় সারির শহরগুলিতে এই হাসপাতালগুলি গড়ে তোলা হবে। খুব ভাল কথা। দ্বিতীয় সারির শহর কোনগুলি? বেনারস, লক্ষ্ণৌ, আলিগড়, কটকের মতো ১০৪টি শহর। তৃতীয় সারির থেকে একটু পিছিয়ে থাকা শহরগুলি। এই শহরগুলির কোথায় হাসপাতাল নেই? বরং দেশের নামকরা হাসপাতালগুলোর বেশিরভাগ এই দ্বিতীয় সারির শহরগুলোতেই। তা হলে তেলা মাথায়তেল দিয়ে দেশের প্রান্তিক মানুষের কি কোনও উপকার হবে?
তৃতীয়ত, সরকার বলছে সাধ আর সাধ্যের ফারাক মেটাতে তারা বরাত দেবে বেসরকারি সংস্থাগুলিকে (Viability Gap Funding), হাসপাতাল গড়ে উঠবে পিপিপি মডেলে। এই হাসপাতালগুলোতে আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্পের মাধ্যমে চিকিৎসা পাবে সাধারণ মানুষ। তার অর্থ কী? জনগণের থেকে আদায় করা ট্যাক্সে ছ’হাজার কোটি টাকা কৌশলে হাসপাতাল তৈরির জন্য তুলে দেওয়া হবে বেসরকারি মালিকদের হাতে। তারপর স্বাস্থ্য বিমার বরাদ্দ টাকা আর একবার গিয়ে ঢুকবে তাদের পকেটে। সার্বিক বিমা নির্ভর স্বাস্থ্য ব্যবস্থার এই পরিকল্পনাই তারা তৈরি করেছিল ‘স্বাস্থ্য নীতি ২০১৭’ মারফত। বর্তমান বাজেট সেটাই প্রয়োগ করার ব্যাপারে এক ধাপ এগিয়ে গেল। ফলে ‘আয়ুষ্মান ভারত’কে বিশ্বের বৃহত্তম সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যপ্রকল্প বলে যতই ঢাকঢোল পেটাক, আসলে এটা হল সাধারণ মানুষের ট্যাক্সের টাকা জনগণকে ধোঁকা দিয়ে বেসরকারি মালিকের পকেটে তুলে দেবার বৃহত্তম প্রকল্প। তাদের পকেট আরও মোটা করতেই চলতি মাস থেকেই চিকিৎসা সরঞ্জামের উপর সেস বসাচ্ছে সরকার। তাহলে বলুন, সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করা যাদের উদ্দেশ্য তারা চিকিৎসা পরিষেবার কোন উন্নতি করবে? সর্বোপরি অতি সাধারণ রোগে ন্যূনতম চিকিৎসার সুযোগ পায় না যে জনগণ, যাদের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে রোগ নিরাময়ে আজও গোমূত্র পানের দাওয়াই বাতলায় বিজেপি-আরএসএস নেতারা, শহরকেন্দ্রিক হাসপাতালগুলি তাদের কোন স্বার্থ রক্ষা করবে?
আবার ধরা যাক ‘ব্রিজকোর্স’-এর প্রস্তাবটি। চিকিৎসকের সংখ্যার অপ্রতুলতাকে অজুহাত করে গ্রামীণ জনসাধারণ এবং গরিব মানুষদের জন্য অল্প দিন প্রশিক্ষণ দেওয়া আধসেঁকা ডাক্তার তৈরির অমানবিক পরিকল্পনা তাদের অনেক দিনের। সম্প্রতি ন্যাশনাল মেডিকেল কমিশন বিলেও উত্থাপিত এই প্রস্তাব আন্দোলনের চাপে নাকচ হয়ে যায়। এখন স্বাস্থ্যকর্মীদের স্কিল ডেভলপমেন্ট খাতে ৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করে সেই একই জিনিস ফিরিয়ে আনার চেষ্টা হচ্ছে। এর জন্য জেলা হাসপাতালগুলিকে মেডিকেল কলেজের সঙ্গে যুক্ত করে পিপিপি মডেলে পরিকাঠামো তৈরির প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে। এতবার নাকচ হবার পরেও একই জিনিস চালুর জেদকেন? উদ্দেশ্য একটাই– স্বাস্থ্য শিক্ষার বেসরকারিকরণ করে পুরো স্বাস্থ্যক্ষেত্রটা মুনাফাখোরদের মৃগয়াক্ষেত্রে পরিণত করা। অন্যদিকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কেন্দ্র সরকারের অনুদানে চলা বিশেষ চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলি যেমন দিল্লির এইমস, সফদরজং, আর এম এল, পিজিআই চন্ডীগড়, কেরালাতে নিমহানস, ইম্ফলে রিমস, শিলং-এর নেগ্রিমস প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানে বরাদ্দ সংকোচন করেছে বর্তমান বাজেট। মূল্যবৃদ্ধির বাজারে যেখানে বরাদ্দ আরও বাড়ানোর প্রয়োজন ছিল সেখানে এই বরাদ্দ সংকোচনের ফল কী হতে পারে? হয় মানের ব্যাপারে আপস, নয় অবধারিতভাবে তার ব্যয়ভার বর্তাবে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে চিকিৎসা পাওয়া সাধারণ মানুষ এবং পড়াশোনা করা ছাত্রছাত্রীর উপর। তাহলে জনগণের স্বাস্থ্যরক্ষা হচ্ছে কোথায়?
সর্বোপরি একথা বহু পূর্বেই আবিষ্কৃত যে টিউবারকুলোসিসের মতো মারণ ব্যাধির উৎস দারিদ্র, অনাহার, অপুষ্টি, অস্বাস্থ্যকর বাসস্থান। কোনও দেবতার অভিশাপ কিংবা কপাল নয়। এর প্রতিরোধ করতে গেলে প্রান্তিক স্তর পর্যন্ত গড়ে তুলতে হয় স্বাস্থ্য পরিকাঠামো, বজরংবলী মন্দির গড়ে যা হয় না। এ ব্যাপারে সরকারের স্লোগানই ভরসা! ফান্ড এবং সঠিক পরিকল্পনা কোথায়! পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ আজ যে পর্যায়ে পৌঁছেছে তাতে কি উন্নত কি অনুন্নত কোনও পুঁজিবাদী দেশেই শ্রমিক, কৃষক, সাধারণ মানুষ জীবনধারণের ন্যূনতম সুযোগ সুবিধা পায় না। এ দেশের বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকার সেই শোষণ-নিপীড়নকেই আরও মারাত্মক পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে এবং ফ্যাসিস্ট কায়দায় এ দেশের সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির স্বার্থরক্ষার মরিয়া প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। চলতি অর্থবর্ষের বাজেট তারই প্রতিফলন। এই বাজেটে জনগণের নূ্যনতম অর্থনৈতিক সুরক্ষা দেবার প্রতিশ্রুতিনেই, ক্রমবর্ধমান মারাত্মক বেকার সমস্যা সমাধানের কোনও পথ দেখাতে পারেনি, খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থানের সুরাহা করেনি, সাধারণ মানুষের জন্য, গ্রামীণ গরিব মানুষের জন্য নূ্যনতম স্বাস্থ্য পরিষেবার কথা বলেনি, স্বাস্থ্য পরিষেবা গঠনের রূপরেখা তুলে ধরেনি। তাহলে ‘টিবি হারেগা, দেশ জিতেগা’ বলে দিবাস্বপ্ন দেখানোর অর্থ কি? বিগত ছয় বছর ধরে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে বিজেপি যে সব জুমলা প্রচার করছে, এটাও তাই। এবারের বাজেট যদি কারও ক্ষয় প্রতিরোধের প্রতিশ্রুতি তুলে ধরতে চেষ্টা করে, সেটা এ দেশের মুমূর্ষু একচেটিয়া পুঁজির। জনগণকে মারাত্মক ক্ষয়রোগ থেকে উদ্ধার করার প্রতিশ্রুতি নয়।