১১ মার্চ পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার যে স্বাস্থ্য বাজেট পেশ করেছে, তাকে কোনও ভাবেই জনমুখী বলা যায় না। বরং তা জনগণের প্রত্যাশা পূরণের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। দীর্ঘ দু’বছর করোনা মহামারিতে অতিরিক্ত চাপ সামলাতে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্যব্যবস্থা যেভাবে ধসে পড়েছে, করোনা বহির্ভূত রোগের চিকিৎসা যেভাবে ব্যাহত হচ্ছে, সেখানে সরকারের উচিত ছিল স্বাস্থ্য বাজেটে বরাদ্দ প্রভূত পরিমাণে বাড়ানো। কিন্তু বরাদ্দ করা হয়েছে মোট বাজেটের মাত্র ৫.৪৭ শতাংশ। মোট বাজেট ৩ লক্ষ ২১ হাজার ৩০ কোটি টাকা এবং স্বাস্থ্য বাজেট মাত্র ১৭ হাজার ৫৭৭ কোটি। অন্য দিকে সরকারের ধার শোধ বাবদ বরাদ্দ করা হয়েছে ৭০ হাজার কোটি টাকা অর্থাৎ মোট বাজেটের ২১.৮০ শতাংশ। মেলা-খেলা, দান-খয়রাতির জন্যও মোটা অঙ্কের টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। অথচ ভারতকে জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র যারা বলে সেইকেন্দ্রীয় সরকার, বা রাজ্য সরকার কেউই জনগণের প্রয়োজন অনুসারে স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় বরাদ্দ করেনি।
এবছর রাজ্য সরকার স্বাস্থ্যখাতে যে যৎসামান্য অর্থ বাড়িয়েছে তার বেশিরভাগটাই বরাদ্দ করা হয়েছে স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পের জন্য। যদিও বিগত বছরগুলোতে স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পে ২৪.৮৫ লক্ষ মানুষকে পরিষেবা দিতে খরচ হয়েছে ৩ হাজার ২১২ কোটি ৭২ লক্ষ টাকা। অর্থাৎ বর্তমানে ২.২ কোটি পরিবার, যাদের স্বাস্থ্যসাথী কার্ড আছে তার চিকিৎসা খরচ মেটাতে প্রয়োজন হবে কমপক্ষে ২ লক্ষ ৮৫ হাজার কোটি টাকা, যা রাজ্য সরকারের সমগ্র বাজেটের প্রায় সমান। যদিও স্বাস্থ্যসাথী খাতে বরাদ্দ করা হয়েছে মাত্র ২৫০০ কোটি টাকা। বর্তমানে বেসরকারি ক্ষেত্রের বহুলাংশে এবং সরকারি ক্ষেত্রে সম্পূর্ণরূপে স্বাস্থ্যসাথী বিলের টাকা বাকি পড়ে রয়েছে, যা মেটাতে কার্যত সরকারের সম্পূর্ণ স্বাস্থ্য বাজেটের বহুগুণ টাকার প্রয়োজন। ফলে এই সব বকেয়া মেটাতে ইতিমধ্যেই স্বাস্থ্যখাতের অন্যান্য বরাদ্দে টান পড়ে যাচ্ছে। যে কারণে ইতিমধ্যেই সরকারি হাসপাতালে ওষুধের অর্ধেকেরও বেশি ছাঁটাই করা হয়েছে, অদূর ভবিষ্যতে তা আরও বাড়বে। সরকারি হাসপাতালে পরীক্ষা নিরীক্ষা সমেত অন্যান্য যেসব ফ্রি চিকিৎসা পরিষেবা এতদিন ছিল তাও অদূর ভবিষ্যতে টাকার অভাবে বন্ধ হয়ে যাবে। বর্তমানে স্বাস্থ্যখাতে যা খরচ হয় তার ৬৯.৫ শতাংশ সরাসরি রোগীর পরিবারের পকেট থেকে খরচ করতে হয়, তা আরও বহুগুণে বাড়বে এবং চিকিৎসা করাতে গিয়ে ধনে-প্রাণে সর্বস্বান্ত হওয়া মানুষের সংখ্যাও বাড়বে।
সরকার সরাসরি স্বাস্থ্য পরিষেবার দায়িত্ব না নিয়ে স্বাস্থ্যসাথীর নামে তা বিমা কোম্পানির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ফলে স্বাস্থ্যখাতে যৎসামান্য বরাদ্দের টাকা বেশিরভাগটাই ঘুরপথে কর্পোরেট বিমা কোম্পানির পকেটে চালান হয়ে যাবে। মূল বিমা কোম্পানি ও ‘থার্ড পার্টি অ্যাসেসি’ (টিপিএ) কোম্পানির লাভ মেটাতে গিয়ে অধিকাংশ টাকা খরচ হওয়ায় প্রকৃত চিকিৎসার জন্য টাকা প্রায় থাকছে না। এর ফলে মানুষ হারাচ্ছে স্বাস্থে্যর অধিকার। অথচ এই যৎসামান্য টাকাও বিমার মাধ্যমে খরচ না করে সরাসরি খরচ করলে মানুষ অনেক বেশি পরিষেবা পেতে পারত।
এই বাজেটের তীব্র বিরোধিতা করে মেডিকেল সার্ভিস সেন্টারের রাজ্য সম্পাদক ডাঃ অংশুমান মিত্র ও সার্ভিস ডক্টর্স ফোরমের সাধারণ সম্পাদক ডাঃ সজল বিশ্বাস জানান–অবিলম্বে স্বাস্থ্যখাতে ন্যূনতম ১০ শতাংশ অর্থ বরাদ্দ করতে হবে, স্বাস্থ্যসাথীর নামে সরকারি তহবিলের টাকা বেসরকারি বিমা কোম্পানির পকেটে চালান করা চলবে না, স্বাস্থ্য বাজেটের টাকা সরাসরি সরকারকে স্বাস্থ্য পরিষেবার জন্য খরচ করতে হবে, সমস্ত মানুষের ফ্রি ও উন্নতমানের চিকিৎসার দায় সরকারকেই বহন করতে হবে।