Breaking News

স্বাস্থ্যসমস্যার সমাধানে মুখ্যমন্ত্রীর সভা থেকে কিছুই পাওয়া গেল না

ফাইল চিত্র

দীর্ঘ বিলম্বে হলেও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী চিকিৎসকদের নিয়ে ২৪ ফেব্রুয়ারি কলকাতার় ধনধান্য প্রেক্ষাগৃহে একটি বৈঠক করেন। বৈঠকে বিভিন্ন মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপাল, এমএসভিপি এবং জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক সহ গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন বিভিন্ন স্তরের চিকিৎসক এবং জুনিয়র ডাক্তার ও মেডিকেল ছাত্রদের আহ্বান জানানো হয়। ওয়েস্ট বেঙ্গল জুনিয়র ডক্টর্স ফ্রন্ট, সার্ভিস ডক্টর্স ফোরামের মতো সংগঠনগুলি বৈঠক বয়কটের কথা ঘোষণা করে।

পশ্চিমবঙ্গের চিকিৎসা ক্ষেত্র তথা সামাজিক ক্ষেত্র দীর্ঘদিন ধরে যে ভাবে আন্দোলিত হয়ে চলেছে, বিশেষত অভয়াকাণ্ডের ন্যায়বিচার চেয়ে ডাক্তার এবং স্বাস্থ্যজগতে যে দুর্বার আন্দোলন চলছে এবং দাবিগুলি পূরণ না হওয়ায় ঘটনার ছয় মাস পরেও যে অস্থিরতা চলছে, চিকিৎসকদের মধ্যে যে ক্ষোভ-বিক্ষোভ চলছে, মাঝে মধ্যেই যার বহিঃপ্রকাশ দেখা যাচ্ছে, সেই সময়ে চিকিৎসকদের সমস্যা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী সভার আয়োজন করায়, তা রাজ্যের মানুষের মনে অনেক আশার সঞ্চার করেছিল। কিন্তু এই সভায় দায়িত্বশীল এবং স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে লাগাতার কাজ করা সংগঠনের প্রতিনিধিদের বক্তব্য শোনার ব্যবস্থা করাই হয়নি। শুধু মুখ্যমন্ত্রীর কথা শুনেই ফিরে যেতে হয়েছে চিকিৎসকদের। তা সত্তে্বও অনেকের আশা ছিল স্বাস্থ্যক্ষেত্রের মূল সমাস্যাগুলি মুখ্যমন্ত্রী কিছু অন্তত বলবেন। কিন্তু তিনি সমস্যার সমাধান নিয়ে দূরের কথা, সেগুলিকে ধামাচাপা দিতেই নানা কৌশল সাজালেন।

অভয়া খুনের ন্যায়বিচার এখনও হয়নি। গোটা স্বাস্থ্যজগতে, বিশেষত আর জি কর মেডিকেল কলেজে সিন্ডিকেটরাজ, থ্রে্রট কালচার, চুরি-দুর্নীতি সমস্ত সহ্যের সীমা লঙ্ঘন করেছিল এবং তার পরিণতিতেই কর্তব্যরত অবস্থায় ওই হাসপাতালে একজন তরুণী চিকিৎসকের ভয়ঙ্করতম খুন ও ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটতে পেরেছিল। সেই ঘটনার সাথে যারা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে জড়িত ছিল, যারা তথ্য প্রমাণ লোপাট করেছিল এবং যারা এই ঘটনার মদতদাতা, তাদের প্রায় কাউকেই চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হয়নি। ফলে পুনরায় তাদের মধ্যে অনেকেই কলেজে ঢুকে সন্ত্রাস ও ভয়ের পরিবেশ ফিরিয়ে আনছে। গভীর উদ্বেগের বিষয় যে, যে ধরনের ভয় সন্ত্রাসের পরিবেশ চলতে চলতে এই ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক খুন-ধর্ষণের ঘটনা ঘটল, সেই পরিবেশ আবারও ফিরে আসতে শুরু করেছে। ফলে আশা করা গিয়েছিল অভয়াকাণ্ডে জড়িতদের সকলে যাতে দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি পায় এবং স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে যাতে সিন্ডিকেট রাজ, চুরি দুর্নীতি, থ্রে্রট কালচার বন্ধ হয়, সেই মর্মে মুখ্যমন্ত্রী দ্রুত সদর্থক পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা তার ধারকাছ দিয়েও গেল না।

সম্প্রতি ইন্ডিয়ান পাবলিক হেলথ স্ট্যান্ডার্ড-এর সার্ভের তথ্যে উঠে এসেছে, (এই সার্ভের কাজ রাজ্য সরকারের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরাই করেছেন) রাজ্যের কোনও হাসপাতালই পরিকাঠামো এবং ডাক্তার নার্স স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যার দিক থেকে পঞ্চাশ শতাংশ নম্বরও পায়নি। রাজ্যের সমস্ত হাসপাতালেই সাফাই কর্মী এবং গ্রুপ ডি-র পদ সত্তর থেকে আশি শতাংশই ফাঁকা পড়ে রয়েছে। এই সব পদ পূরণের কোনও ঘোষণা মুখ্যমন্ত্রী করলেন না।

সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ড্রাগ কন্টে্রাল অফিস থেকে আচমকা হানা দিয়ে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় জাল ওষুধের সন্ধান পাচ্ছে। রাজ্য ড্রাগ কন্টে্রালের চূড়ান্ত ভগ্ন পরিকাঠামো এবং নিষ্ক্রিয়তার ফলে গোটা রাজ্যই আজ অত্যন্ত নিম্নমানের, এমনকি জাল ওষুধে ছেয়ে গেছে। রাজ্যের সাধারণ মানুষ আশা করেছিল, তাদের জীবনের এবং স্বাস্থে্যর কথা মাথায় রেখে মুখ্যমন্ত্রী ওষুধের গুণমান পরীক্ষার উপর গুরুত্ব আরোপ করবেন এবং পরীক্ষায় পাশ না করা পর্যন্ত কোনও ওষুধই যাতে ব্যবহার না করা হয় তা নিশ্চিত করবেন। নিম্নমানের স্যালাইন ও ওষুধের দায় এবং বিপুল লোকবল ঘাটতির দায় কোনও ভাবেই চিকিৎসকদের উপর চাপাবেন না। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা থেকে এ সব কিছুই পাওয়া গেল না।

দীর্ঘ দু’বছর ধরে পিচমবঙ্গের সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলিতে কালো তালিকাভুক্ত কোম্পানির যে রিঙ্গার্স ল্যাকটেট স্যালাইন চলছে এবং তার কারণেই প্রসূতি মায়েদের মৃত্যু ঘটছে তা নিয়ে প্রশাসন এতদিন কেন নীরব থাকল এবং সেই কোম্পানির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা কেন আজও নেওয়া হল না, বরং ওই কোম্পানিকে ক্লিনচিট দিয়ে দেওয়া হল, তা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর কোনও জবাব পাওয়া গেল না। উপরন্তু দূষিত স্যালাইন দেওয়ার ফলেই যে মায়েদের মৃত্যু তা স্বীকার না করে স্বাস্থ্য দপ্তর মেদিনীপুরে প্রসূতি মৃত্যুর দায় ডাক্তারদের উপর চাপালেন। অবশেষে আন্দোলনের চাপে সভা থেকে শুধুমাত্র ছ’জন জুনিয়র ডাক্তারের উপর থেকে সাসপেনশন প্রত্যাহার করতে বাধ্য হলেন মুখ্যমন্ত্রী।

ধনধান্যের মিটিং গণতন্ত্রের পক্ষে বাস্তবে এক অশনি সংকেত। অভিযোগের নিষ্পত্তি বা গ্রিভ্যান্স রিড্রেসালের নাম করে ছাত্র-ছাত্রী ও চিকিৎসক সমাজকে তাদের কোনও অভিযোগই বলতে দেওয়া হল না, একতরফা বক্তব্য রাখলেন মুখ্যমন্ত্রী। মেডিকেল কলেজের প্রফেসর, ডাক্তার ও ছাত্ররা মূক শ্রোতা হয়েই থাকলেন। এই চিকিৎসককুল অনুগত সেবকের মতো শাসকের কথায় সায় দিয়ে যাবেন–এটাই কি তাঁদের কর্তব্য!

চিকিৎসকদেরকে রাজনৈতিক রংয়ের ঊর্ধ্বে থাকার কথা বলে তাঁদের শাসক দলের আজ্ঞাবহ থাকার বার্তা দিলেন মুখ্যমন্ত্রী, চিকিৎসক সমাজ যা ভাল চোখে দেখছে না। তিনি বললেন, ভাল কাজ করলে ডাক্তারদের ভয় নেই। সরকার তাদের দেখবে। তা হলে তো প্রশ্ন থেকেই যায় যে, আর জি করের নিহত চিকিৎসক ছাত্রী কি ভাল কাজ করেননি? মুখ্যমন্ত্রী কাদের কাজকে ভাল বলে মনে করেন, যে সব চিকিৎসক শাসক দলের হয়ে সিন্ডিকেট রাজ চালায়, অভয়াকাণ্ড ঘটায়?

স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে বিপুল ঘাটতি পদ এবং পরিকাঠামো পূরণের কথা না বলে, বিপুল পরিমাণ উন্নয়নের কিছু অসত্য তথ্য তিনি তুলে ধরলেন। ডাক্তারদের দুর্নীতিগ্রস্ত বদলি প্রক্রিয়া, যার উপর রমরমিয়ে সিন্ডিকেট রাজ চলছে এবং যে অন্যায় বদলি প্রক্রিয়াকে কেন্দ্র করে চিকিৎসকরা সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির শিকার, তার নিষ্পত্তির ব্যাপারে এই গ্রিভ্যান্স রিড্রেসালের মিটিংয়ে একটি কথাও বললেন না মুখ্যমন্ত্রী।

মুখ্যমন্ত্রী চিকিৎসকদের উদ্দেশ্যে যে সব অর্থনৈতিক প্যাকেজ ঘোষণা করলেন, তা কার্যত অভয়াকাণ্ডের ন্যায়বিচার এবং স্বাস্থ্য জগতের সীমাহীন দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে দুর্বার আন্দোলন গড়ে উঠেছে তা থেকে চিকিৎসকের দৃষ্টি অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার লক্ষে্যই করা হয়েছে। যদিও এ রাজ্যের জুনিয়র ডাক্তাররা অন্যান্য রাজ্য ও কেন্দে্রর চেয়ে অনেক কম ভাতায় কাজ করতে বাধ্য হন, তা সত্তে্বও অভয়া আন্দোলনে ভাতা বাড়ানোর দাবি উঠে আসেনি। কলেজে কলেজে খেলাধুলো-উৎসবের জন্য টাকাও আন্দোলনকারীরা চাননি। তাঁরা শুধু চেয়েছিলেন ন্যায়বিচার ও দুর্নীতিমুক্ত কাজের পরিবেশ। অথচ মুখ্যমন্ত্রী রাজ্য জুড়ে মেলা-খেলার নামে ক্লাবগুলোতে টাকা ছড়িয়ে অপসংস্কৃতির প্রসার ঘটাচ্ছেন, মানুষের নৈতিক মানের অধঃপতন ঘটিয়ে মানুষকে কেবল ভোটযন্তে্র পরিণত করছেন। সভায় মুখ্যমন্ত্রীর সেই সুরই শোনা গেল। কিন্তু তিনি জানেন না ঐতিহাসিক অভয়া আন্দোলন চিকিৎসক সমাজে এবং জনসমাজে যে উন্নত নীতি-নৈতিকতার জন্ম দিয়েছে সেখানে আন্দোলন দমনের উদ্দেশ্যে তাঁর এই প্রলোভনে জুনিয়র ডাক্তার ও চিকিৎসক সমাজ আন্দোলনের পথ ছাড়বে না।

সার্বিকভাবে এই মিটিংয়ে চিকিৎসকস্বার্থ, রোগীস্বার্থ, জনস্বাস্থ্য কোনও সমস্যারই সমাধানের রাস্তা খুঁজে পাওয়া যায়নি। রয়েছে কেবল আন্দোলন দমন করার এবং একদল দলদাস তৈরির অপচেষ্টা। অভয়ার নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে আন্দোলনে যাঁরা প্রথম সারিতে ছিলেন সেই সব জুনিয়র ডাক্তারদের বিভিন্ন ভাবে হেনস্থা করার চেষ্টা চলছে, ভয় দেখানোর চেষ্টা চলছে। এই বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের যে বিশেষ নির্দেশ ছিল, ‘আন্দোলনকারীদের ওপর বিশেষ করে জুনিয়র ডক্টরস ফ্রন্টের ওপর অন্যায় ভাবে কোনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না, তাকে পারতপক্ষে বুড়ো আঙুল দেখালেন মুখ্যমন্ত্রী। নবান্ন সভাঘরে জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে আলোচনায় জনসাধারণের সামনে মুখ্যমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, রাজ্যভিত্তিক টাস্ক ফোর্স গঠন করা হয়েছিল। কথা ছিল, এতে প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা থাকবেন এবং জুনিয়র ডাক্তারদের প্রতিনিধিরা থাকবেন এবং মহিলা প্রতিনিধিরাও থাকবেন। এই টাস্ক ফোর্স প্রতি মাসে বৈঠক করবে, রিপোর্ট জমা দেবে। এখনও পর্যন্ত গত ৬ মাসে টাস্ক ফোর্সের একটাও মিটিং কেন হল না? তার জবাবও মুখ্যমন্ত্রীর সভা থেকে মেলেনি।

বাস্তবে এই ধরনের সভার আয়োজন শাসকের ক্ষমতা প্রদর্শন এবং চিকিৎসক সমাজকে দলদাসে পরিণত করবার চেষ্টা ছাড়া আর কিছু না। সভা থেকে কোথাও অভয়ার ন্যায়বিচার, চিকিৎসা ও মেডিকেল শিক্ষার পরিকাঠামোর প্রকৃত উন্নয়ন, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন, মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলিতে সুস্থ গণতান্ত্রিক পরিবেশ, নারী দিবসের প্রাক্কালে মেয়েদের কাছে ভয়মুক্ত ক্যাম্পাস গড়ে তোলার ও সর্বোপরি থ্রে্রট কালচারের মাথাদের বিরুদ্ধে শাস্তি বিধানের কোনও প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেল না।

আশার কথা সার্ভিস ডক্টর্স ফোরাম, মেডিকেল সার্ভিস সেন্টার, নার্সেস ইউনিটির মতো সংগঠনগুলি এই দলদাসত্বের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে চিকিৎসা পেশার মহান আদর্শকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার শপথ নিয়েছে। তাঁরা ২৪ ফেব্রুয়ারি এক সাংবাদিক সম্মেলনে দলমত নির্বিশেষে চিকিৎসক নার্স স্বাস্থ্যকর্মী ও জনসাধারণের সুদৃঢ় ঐক্য গড়ে তুলে গণতান্ত্রিক পথে শাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে অভয়ার ন্যায়বিচারের আন্দোলনকে সামনে রেখে সর্বাত্মক আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন।