১৫ নভেম্বর মহা আড়ম্বরে পালিত হল বিরসা মুণ্ডার জন্মদিন। মুণ্ডা বিদ্রোহ ‘উলগুলান’-এর অবিসংবাদিত নেতা বিরসা মুণ্ডা সম্পর্কে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষের গভীর শ্রদ্ধা ও আবেগের কথা আমরা অনেকেই জানি। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ঢাক-ঢোল পিটিয়ে পালন করেছে বিরসা মুণ্ডার জন্মদিন। কেন্দ্রীয় সরকারের ঘোষণা মতো ওই দিনটিকে কেন্দ্র করে দেশ জুড়ে ‘জনজাতীয় গৌরব দিবস’ পালিত হয়েছে ১৫ নভেম্বর থেকে ২২ নভেম্বর। এ রাজ্যেও সরকারি অফিস, আদালত, স্কুল-কলেজে ছুটি পালিত হল রাজ্য সরকারের নির্দেশ মেনে।
কয়েক মাস আগে দেশের রাষ্ট্রপতি হিসাবে নির্বাচিত হয়েছেন আদিবাসী সমাজের মানুষ দ্রৌপদী মুর্মু। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে শাসক দল ও তার পেটোয়া সংবাদমাধ্যমগুলি এমন প্রচার চালিয়েছে যেন এর ফলে আদিবাসীদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থানের বিপুল উন্নয়ন হবে। বছরভর দেশের শাসক-বিরোধী সমস্ত রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রী ভিড় করেন আদিবাসী গ্রামগুলোতে। কে নেই সেই ভিড়ে–দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে আমাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সবাইকেই দেখা যায়। আসলে ভোট বড় বালাই। সংবাদপত্র, টিভি চ্যানেল এ খবর ঢালাও করে প্রচার করে। এত বিপুল প্রচার সত্ত্বেও খবরের চোরাগলি পেরিয়ে যেটুকু সত্য আদিবাসী সম্প্রদায় সম্পর্কে সামনে আসে তা সভ্য সমাজের যে কোনও মানুষকে লজ্জা দেবে।
জল, জমি, বন, পাহাড়, পশু, পাখি এ সব জিনিস আদিবাসীদের জীবন, জীবিকা, সংস্কৃতি ও বিশ্বাসের সাথে হাজার হাজার বছর ধরে জড়িয়ে। আর ঠিক এই কারণেই এই সম্পদগুলি রক্ষা করা আদিবাসীরা তাদের পবিত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য বলে মনে করে। ২০০৬ সালের আগে পর্যন্ত বনাঞ্চলে আদিবাসী মানুষের বসবাস আমাদের দেশে বেআইনি বলে বিবেচিত হত। আদিবাসীদের লাগাতার আন্দোলনের ফলে ২০০৬ সালে তৎকালীন ইউপিএ সরকার একরকম বাধ্য হয় দি সিডিউলড ট্রাইবস অ্যান্ড আদার ট্র্যাডিশনাল ফরেস্ট ডুয়েলার্স (রেকগনিশন অফ ফরেস্ট রাইটস)-২০০৬ আইন পাশ করতে। এই আইনে বলা হয় বংশ পরম্পরায় বনাঞ্চলে বসবাসকারী আদিবাসী সম্প্রদায় বনভূমির পাট্টা পাবেন ও সমষ্টিগতভাবে বনজ সম্পদ ব্যবহার ও সুরক্ষার অধিকার পাবেন। বিচ্ছিন্ন ভাবে কোনও কোনও রাজ্য সরকার অল্পবিস্তর এই আইন কার্যকর করার চেষ্টা করলেও, অধিকাংশ রাজ্য নানা অছিলায় এই আইন কার্যকর করেনি। আমাদের রাজ্যও এর ব্যতিক্রম নয়। ২০১৪ সালে কেন্দ্রের এনডিএ সরকার আসার পর শিল্পায়ন ও নগরায়নের নামে নানা অজুহাতে রেকগনিশন অফ ফরেস্ট রাইটস-২০০৬ আইনকে নখদন্তহীন করার পদক্ষেপ নিয়েছে এবং এরই ফলস্বরূপ তারা কয়লা শিল্পের সম্প্রসারণের জন্য জনমত গ্রহণের রীতিটি তুলে দিয়েছে শুধু তাই নয়, এমন প্রকল্পের বিরোধিতা করলে ধার্য হয়েছে এক লক্ষ টাকা জরিমানা। দূষণ ঘটায় এমন শিল্প তালুকের উপর যেটুকু নিষেধাজ্ঞা ছিল সেটাও তুলে দেওয়া হয়েছে। বনাঞ্চলে খনন ও খনিজ দ্রব্য উত্তোলনের নামে শুরু করেছে ব্যাপক হারে বৃক্ষনিধন। কমিয়ে দেওয়া হয়েছে ন্যাশনাল বোর্ড অফ ওয়াইল্ড লাইফ-এর ক্ষমতা। শুধুমাত্র পুঁজিপতি শ্রেণির মুনাফার স্বার্থে সরকারের এই অগণতান্ত্রিক নীতির কারণে হাজার হাজার আদিবাসী মানুষকে উদ্বাস্তু হতে হচ্ছে, পাল্লা দিয়ে বেড়েছে আদিবাসী মানুষের উপর বনদপ্তর ও পুলিশের অত্যাচার। আর এরই পরিণতিতে আদিবাসী জনজাতিদের মধ্যে ক্রমশ জনপ্রিয় হয়েছে উগ্রবাদী নানা শক্তি।
বনাধিকার আইন-২০০৬কে কার্যত বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রক এক বিজ্ঞপ্তি মারফত ফরেস্ট কনজারভেশন রুল-২০২২ জারি করেছে। বনাধিকার আইন ২০০৬-এ স্বীকার করে নেওয়া হয়েছিল, দেশের আদিবাসীদের উপর ‘ঐতিহাসিক অন্যায়’ করা হয়েছে। এই আইন অনুযায়ী জঙ্গলের জমি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দেওয়ার আগে সেখানকার অধিবাসীদের মতামত এবং সম্মতি নিতে হত সরকারকে। কিন্তু ২০২২ এর নতুন নিয়মে এসবের আর প্রয়োজন নেই। প্রকল্পের বিস্তারিত রিপোর্ট হাতে পাওয়ার সাথে সাথেই অনুমোদন দিয়ে দেবে কেন্দ্রীয় সরকার। বেসরকারি মালিকের হাতে জমি তুলে দেওয়ার পর জঙ্গলের অধিবাসীদের সম্মতি নেওয়া ও পুনর্বাসনের বিষয়ে আলোচনার কথা বলা হয়েছে।
প্রত্যেকটি জাতির একটি নিজস্ব ভাষা আছে। আদিবাসী সম্প্রদায়ের অন্তর্গত বিভিন্ন জনজাতির–সাঁওতাল, কোল, হৌ, ওঁরাও, মুণ্ডাদের ভাষা আলাদা ও সংস্কৃতি আলাদা। ভাষার নামও আলাদা আলাদা। যেমন সাঁওতালদের ভাষা সাঁওতালি, মুণ্ডাদের ভাষা মুণ্ডারি ইত্যাদি। সুদীর্ঘকাল ধরে আদিবাসী সম্প্রদায়ের বিভিন্ন জনগোষ্ঠী তাদের নিজেদের ভাষার সরকারি স্বীকৃতি ও সংবিধানের অষ্টম তফসিলে তা অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানিয়ে আন্দোলন করে আসছে। বিরসা মুণ্ডাকে নিয়ে বিরাট হৈচৈ চলছে। অথচ তিনি যে জনজাতি গোষ্ঠীর অর্ন্তগত, সেই মুণ্ডা গোষ্ঠীর ভাষা মুণ্ডারিকে আজও কেন্দ্রীয় সরকার সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেয়নি। ২০০৩ সালে আদিবাসী জনজাতির বিভিন্ন ভাষার মধ্যে একমাত্র সাঁওতালি ভাষাকে সরকারি স্বীকৃতি দিয়ে সংবিধানের অষ্টম তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ২০১১ সালে সাঁওতালি ভাষাকে আমাদের রাজ্যে দ্বিতীয় ভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, এরপরও সাঁওতালি ভাষা শিক্ষার উপযোগী কাঠামো গড়ে তোলার বিষয়ে সরকারি উদাসীনতা লক্ষণীয়। প্রয়োজনীয় পাঠ্যপুস্তক ও উপযুক্ত শিক্ষকের অভাব আছে বিস্তর। স্কুলছুটের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে।
দেশের বিভিন্ন প্রান্তে– মধ্যপ্রদেশ, আসাম, ছত্তিশগড়, ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড ও পশ্চিমবঙ্গে জল-জমি-জঙ্গলের অধিকার রক্ষায় আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ লড়াই করে চলছে। একদিকে দেশের সরকার ও বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী, অন্যদিকে সাধারণ আদিবাসী সম্প্রদায়। শিল্পায়নের নামে, উন্নয়নের নামে জমি তুলে দেওয়া হচ্ছে বহুজাতিক কর্পোরেটের হাতে। বাস্তুহারা হচ্ছে লক্ষ লক্ষ আদিবাসী পরিবার। ঝাড়খণ্ডে আদানি গোষ্ঠীর হাতে বনাঞ্চল তুলে দেওয়ার প্রতিবাদে আদিবাসী মানুষজন আন্দোলনে নামলে পুলিশ ও আধাসামরিক বাহিনী দিয়ে তা দমন করা হয়েছে। এ রাজ্যের বীরভূম জেলার ডেউচা-পাঁচামিতে কয়লা খনির নামে বাস্তুহারা হতে চলেছে অসংখ্য আদিবাসী পরিবার। ওড়িশা, আসাম, ছত্তিশগড়েও একই অবস্থা।
বেশ কয়েকবছর আগের কথা। ২০০৪ সাল। আমাদের রাজ্যের শাসন ক্ষমতায় তখন বামফ্রন্ট সরকার। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার আমলাশোল গ্রাম তখন খবরের শিরোনামে। শবর-মুণ্ডা অধ্যুষিত এই গ্রামে প্রবল অনাহারে-অপুষ্টিতে মারা যায় আদিবাসী সম্প্রদায়ের পাঁচ জন মানুষ। খবরে উঠে আসে কুরকুটের (এক ধরনের পিঁপড়ের ডিম) কথা, যা খেয়ে থাকে আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষজন। সেদিনকার সরকার অনাহারে মৃত্যুর খবর স্বীকার করতে রাজি হয়নি। অবশ্য কোনওকালে কোনও শাসকই অনাহারে মৃত্যু মেনে নিতে চায় না। এরপর অনেক বছর পার হয়েছে। ২০১১ সালে রাজ্যে সরকার পরিবর্তন হয়েছে। আদিবাসী উন্নয়নে বর্তমান সরকার ঘোষণা করেছে নানা প্রকল্প। এতে কিছু পরিবর্তন যে হয়নি এমন নয়, তবে ফাঁক আছে বিস্তর। আবারও অভিযোগ উঠেছে, অনাহারে মৃত্যুর। কিন্তু মানতে চাইছে না সরকার। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের প্রতীচী ইনস্টিটিউট ও এশিয়াটিক সোসাইটি পরিচালিত ‘পশ্চিমবঙ্গের আদিবাসীদের বিশ্বে তদন্ত’ শীর্ষক এক গবেষণাপত্রে প্রকাশিত হয়েছে যে, আদিবাসী পরিবারগুলোর মধ্যে খাদ্যের অভাব রয়েছে।
গত ১৫ নভেম্বর ঝাড়গ্রাম সফরে গিয়েছিলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, আলাপচারিতা করেছিলেন একটি আদিবাসী পরিবারের সাথে মুখ্যমন্ত্রী একজন আদিবাসী মহিলাকে অন্য অনেক কথার সাথে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তাঁর বাড়িতে কী রান্না হয়েছে। উত্তরে ওই মহিলা জানান, ‘লাউ আর ফেনা ভাত’। অসংখ্য প্রকল্পের ভিড়ে এটাই আসলে আদিবাসী উন্নয়নের চিত্র। এটা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। আদিবাসী মানুষজনের পাতে এর থেকে ভালো কিছু জোটে না। সারা দেশেই আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষের অবস্থা মোটামুটি এইরকমই। কালাহাণ্ডি বা আমলাশোলের মতো ঘটনা হয়ত প্রতিদিন ঘটছে না। তবে স্বাধীনতার ৭৫ বছর কেটে যাওয়ার পর আদিবাসী উন্নয়ন পৌঁছেছে পিঁপড়ের ডিম থেকে লাউ আর ফেনা ভাতে।